দুয়ারে ‘আফিম’ থুড়ি ‘পোস্ত’ / Pop Pop Poppy

রাজ্যে পোস্ত চাষের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। আলু পোস্ত, পোস্ত বড়া, ঝিঙে পোস্ত, পোস্ত বাটার সাথে বাঙালির সম্পর্ক বহুদিনের। মুখ্যমন্ত্রী যদি বাঙালির পাতে সস্তায় পোস্ত তুলে দিতে পারেন, তবে তো খুব ভালো কথা! তাহলে আমরা হঠাৎ প্রতিবেদন লিখতে বসলাম কেন?

আশঙ্কা! আশঙ্কার থেকেই আজ লিখতে বসা। আসলে রাজ্য সরকার এখন যা যা করছেন, সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে সরকারের ঘরে। ফলে একের পর এক ঘটনার ঘনঘটায় জেরবার রাজ্যের শাসক দল। এই পরিস্থিতিতে আইনস্বীকৃতভাবে রাজ্যে যেচে আফিম থুড়ি পোস্ত চাষের আবেদন আবার নতুন কোন সমস্যা ডেকে আনবে না তো!

এই মুহূর্তে দেশের তিন রাজ্যে ১৯৮৫ সালের এনডিপিএস আইন মেনে হয় আফিম চাষ। মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশ।

কিন্তু আফিম বা পোস্ত চাষে এত কড়াকড়ি কেন? কারণ হেরোইনের একটি উৎস আফিম। মিডিয়া চ্যানেলের এক অ্যাঙ্করের বিখ্যাত লাইন ছিল, “মুঝে ড্রাগস দো, মুঝে ড্রাগস দো”। সেই ড্রাগস পাওয়া যায় আফিম থেকে, মরফিন, ল্যাটেক্স, কোডাইন এবং প্যানানথ্রিনের বীজ থেকে তৈরি হয় শক্তিশালী অ্যালকালয়েড। আর দাম? আফিমের প্রতি কেজি অনেক সময় লাখ টাকার ওপরেও পৌঁছে যায়। সেটা অবশ্য চাহিদার ওপরে অনেকটা নির্ভরশীল।

আমাদের দেশে আফিম চাষ করতে গেলে মানতে হয় অনেক নিয়মনীতি। কৃষকদের প্রথমে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ নারকোটিক্স থেকে লাইসেন্স নিতে হয়, তারপর হাজারো নিয়ম মেনে চাষ। বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর, নিমচ, রাজস্থানের কোটা, ঝালাওয়ার, চিতোরগড়, ভিলওয়ারা এবং উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়, লখনউ ও বারাবাঙ্কিতে আফিম চাষ হচ্ছে। যার টোটাল এরিয়া মোটামুটি সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর। এর বাইরে আফিম চাষ সম্পুর্ণভাবে বেআইনি। ধরা পড়লেই কেলো। কেবলমাত্র কারাবাস বা আর্থিক জরিমানা নয়, নিয়ম কানুন না মানলে আইন মোতাবেক মৃত্যুদণ্ডেরও বিধান রয়েছে।

আমাদের আশঙ্কা অবশ্য অন্য জায়গায়, গত বছর রাজ্যে পাট চাষীদের জন্য এক শোচনীয় বছর গেছে, রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষকদের এমআরপি’র থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে ইউরিয়া, পটাশ ইত্যাদি সারচালে চলছে দেদার কালোবাজারিআলু, পেঁয়াজ চাষীরা চাষ করে লাভের মুখ দেখছে না। চাষাবাদ পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় অলাভজনক হয়ে যাওয়ায়, চাষিরা পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে, আর যারা যেতে পারছেন না, তাদের অনেকেই মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির থেকে ঋণ নিয়ে দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ তো আবার মহাজনের কাছে করে বসেছেন, “বউ বন্ধকী লোন”। তাতেও না হলে, কারো কারো ভরসা ফলিডল। এই ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন কেবল কৃষকরা না, আমরা রোজ যারা বাজার হাটে যাই, তারাও। অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক চড়া দাম শাক সবজির। ব্যাঙ্কে ইন্টারেস্ট কমছে, চার্জ বাড়ছে, সরকারি চাকুরেদের ডিএ নেই, বেসরকারি চাকুরেদের ঠিক ঠাক ইনক্রিমেন্ট নেই, শ্রমিক-মজুরদের শ্রমের দাম নেই, ৮,২০৭টি সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল বন্ধের মুখে, শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা রাস্তায় বসে আছেন, দুর্নীতির দায়ে একের পর এক মানুষের চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার লিস্ট মাসে দুবার তিনবার করে বেরোচ্ছে।

ঠিক করলে তো, অনেক কিছুই ঠিক করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ফোকাস হটাৎ আফিম বা পোস্ত চাষে কেন? প্রশ্ন কিন্তু উঠে গেছে। কিন্তু জবাব দেবে কে?

শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও পোস্ত চাষের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে। কারণ, পোস্তদানা আসলে বীজ। পোস্ত বঙ্গ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হলেও মূল ফলটি থেকে তৈরি হয় মাদক। আবার ওই ফলের ভিতর থেকে যে আঠালো তরল বার হয় সেই ‘ল্যাটেক্স গাম’ ব্যাথানাশ, ক্যান্সার ইত্যাদির ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। আবার সেই তরল দিয়েই তৈরি হয় নানা রকম মারাত্মক মাদক। এখানেই প্রধান আশঙ্কা।

এই মুহুর্তে রাজ্যের সরকারের যা ছবি মানুষের সামনে এসেছে, সেটা গর্ব করার মতন নয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় যে কেলেঙ্কারি হতে পারে, তা বঙ্গবাসী এক দশক আগেও কল্পনা করতে পারত না। দুর্নীতি আজ গ্রাস করেছে বাংলার প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে, পঞ্চায়েতে। শিক্ষা ছাড়াও, বালি, কয়লা, জমি, পুকুর, গাছ, সার, পাহাড় সবেতেই কেলেঙ্কারি, তাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। পোস্ত চাষের নামে যদি আফিম ইন্ডাস্ট্রি লাভবান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ফল হতে পারে ভয়ংকর।

এই বাংলায় এখন চাষবাস অনেক ক্ষেত্রেই আর লাভজনক নেই। এটাও আশঙ্কার কালো মেঘ দেখাচ্ছে। পূর্ব বর্ধমানের সিপিআইএম জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন আমাদের প্রতিনিধিকে জানালেন, “পশ্চিমবঙ্গ গোটা ভারতকে ভাত খাওয়াতে পারে, এই মাটি আফিম চাষ করবে কেন?” তিনি আরও বলেন, “আসলে একের পর এক এক কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে চলে আসায়, তৃণমূলের প্রধান ক্যাশ ফ্লো প্রায় বন্ধ হতে বসেছে, তাই পোস্ত চাষের আড়ালে এরা দুর্নীতির নতুন পথ খুঁজছে।”

জানেন কি, ভারতের পূর্ব পাড়ের পড়শী দেশ ময়ানমারে এখন আফিম চাষ বেড়েছে। ২০২১ সালে জুন্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে ব্যাপকভাবে আফিমের উৎপাদন বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষকেরা আফিম চাষে ঝুঁকছেন। গত জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধ বিষয়ক সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছিল। আর পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান, আফিম চাষে ওরাই এক নম্বর। এদের মাঝখানে একমাত্র ভারতবর্ষই আছে, যেখানে ১৯৮৫ থেকে কঠিন আইন মোতাবেক আফিম বা পোস্ত চাষ নিয়ন্ত্রিত হয়।

এবার আসি আমাদের রাজ্যে, সেন্ট্রাল নারকোটিক্স এবং আবাগরি দফতর গত এক মাসে বেআইনিভাবে করা আফিম বা পোস্ত চাষ ধরতে অত্যন্ত নাড়াচাড়া শুরু করেছে। নিচে আমরা কয়েকটি প্রতিবেদনের লিঙ্ক দিলাম:
ক) দামোদরের চরে পোস্ত চাষের রমরমা, কড়া পদক্ষেপ আবগারি দফতরের
https://www.etvbharat.com/bengali/west-bengal/state/paschim-bardhaman/excise-department-destroyed-25-bigha-poppy-land-in-durgapur/wb20230209185523778778224
খ) গোঘাটে বিঘার পর বিঘা বেআইনি পোস্ত চাষের অভিযোগ, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
https://eisamay.com/west-bengal-news/hooghly-news/illegal-poppy-seed-cultivation-for-making-drugs-going-on-in-hooghly-goghat-area/articleshow/98315529.cms
গ) পুরুলিয়ায় রমরমিয়ে চলছিল বেআইনি পোস্ত চাষ, অভিযান আবগারি দফতরের
https://eisamay.com/west-bengal-news/others/police-and-excise-department-destroyed-illegal-poppy-farming-in-purulia/articleshow/98501345.cms

রাজ্যের গরু পাচার কান্ড প্রকাশ্যে চলে আসার পরে এবং অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারের পর, কোথাও কোথাও কেউ কেউ বলছেন, “গোটা গরু রপ্তানি আইনসিদ্ধ করে দিলেই তো সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, কোনো সমস্যা থাকে না।” এরপর হয়ত এরাই বলবেন, “তাহলে কি আমরা কম দামে পোস্ত খাব না, খাব না আমরা পোস্ত।” আসলে এনারা দেশের প্রাণীজসম্পদের চোরাচালান নিয়ে চিন্তিত নন, এনারা হয়ত চিন্তিত কয়লা চোর, গরু চোর, বালি চোর, গাছ চোর, পুকুর চোরদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলার উর্বর মাটিতে ধান, সবজির ফলন হওয়াই বাঞ্ছনীয়, আফিম নয়।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস