আশায় চাষা আর বাঁচছে না / Hopeless Farmers

আলু ছাড়া ‘আলুনী’ জীবন আমরা বাঙালীরা ভাবতেই পারি না। আলু বাদ দিয়ে বাঙালী গৃহস্থের কোন তরকারি পদ কল্পনাও করা যায় না। বিউলির ডাল-আলুপোস্ত অথবা লুচি-আলুর দম কিমবা ডাল-ভাত-আলুভাতে খায়নি এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর! এমনকি বাঙালী বিরিয়ানিতেও একটা অর্ধেক বা আস্ত আলুর প্রমাণ সাইজের টুকরো থাকে। অথচ আলুর এত কদর করা বাঙালী ইদানীং জানতেই পারছে না রোদে পুড়ে-জলে ভিজে সেই আলু ফলানো চাষীদের দুর্দশার কথা।

গত মাস খানেক-মাস দেড়েক হলো মাঠে আলু উঠতে শুরু করেছে। আর তারপর থেকেই চাষীরা আলুর দাম পাচ্ছে না এমন অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর বা জলপাইগুড়ি। সারা বাংলাজুড়ে এক ছবি। কোন হেরফের নেই। লাভ দূরে থাক, চাষের খরচটুকুও উঠছে না। আপনি যদি ভেবে থাকেন, এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা তাহলে ভুল ভাবছেন। শুধু আলু নয়, ধানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে বছরের পর বছর। একই অবস্থা পেঁয়াজ বা পাটের মত অর্থকরী শস্যেরও। একের পর এক প্রতিবেদনে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস, সেই সব খবর তুলে ধরেছি। পুনশ্চতে আমাদের সেইসব প্রতিবেদনগুলির লিঙ্কসহ একটা তালিকা দিলাম। যাঁরা আমাদের নতুন পাঠক, তারা বিশদে জানতে লিঙ্কে ক্লিক করে প্রতিবেদনগুলো পড়তে পারেন।

বাংলার সংবাদমাধ্যম শেষ কবে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্য জুড়ে চলা কৃষি সঙ্কট, মান্ডিতে ফসলের দাম না পাওয়া বা সারের কালোবাজারি নিয়ে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী, কৃষি বিপণন মন্ত্রী বা খাদ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছে, প্রাইম টাইমে শো করেছে আপামর বঙ্গবাসীর মত আমরাও মনে করতে পারছি না। অবস্থাটা এতই খারাপ যে আচমকা কোন সাংবাদিককে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন আচ্ছা বলুন তো রাজ্যের কৃষি মন্ত্রীর নাম কি বা কৃষি বিপণন মন্ত্রী কে অথবা খাদ্যমন্ত্রীর নাম কি, দেখা যাবে এঁদের অনেকেই গুগল সার্চ না করে বলতে পারবে না! আসলে বাংলার সংবাদমাধ্যম এই মুহুর্তে পিসি-ভাইপো-কালীঘাটের কাকু-বীরভূমের বাঘ প্রভৃতি মায়াজালে আটকে পড়েছে! ফলে কৃষি সঙ্কটের মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সবার অলক্ষেই থেকে যাচ্ছে। খাতায়কলমে রাজ্যের প্রধানবিরোধী দল বিজেপিও শেষ কবে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রীর বা কৃষি বিপণন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করে রাজপথে বা জনমাধ্যমে হইচই বাঁধিয়েছে সাধারণ মানুষ কোন ছাড়, খোদ রাজ্য বিজেপির নেতারা মনে করতে পারবেন না।

কিন্তু তাবলে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস শুধু একটা গালভরা নাম ঝুলিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকিনি, বরং সেইসব ‘খবর না হওয়া খবর’ আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে তুলে ধরেছি আপনাদের সামনে। আর সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আপানদেরকে জানিয়ে রাখি বীরভূমের বাঘ যেদিন কচুরি-ছোলার ডাল-ল্যাংচা-রাজভোগ সাঁটিয়ে হেলথ চেক আপ করিয়ে প্লেনে চেপে দিল্লি গেলো, ঠিক সেদিনই বাংলার বুকে দুজন আলু চাষী বাজারে আলুর দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। একজনের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের কালনায়, অন্য জনের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায়।

এই মুহুর্তে মান্ডিগুলোতে আলুর যা দাম চলছে তাতে চাষের খরচ, আলুচাষের জন্য নেওয়া ঋণের ওপর সুদ এসব কিছুই উঠবে না। ফলে চাষিরা চাইছেন আলু তুলে হিমঘরে মজুত করতে। কিন্তু হিমঘরে আলু মজুত করবার জন্য যে আলুবন্ড ছাড়া হয়, তা নিয়ে যথারীতি শুরু হয়ে গেছে কালো বাজারি। ফলে আলু চাষিদের হয়েছে উভয় সঙ্কট। ক্ষেতের আলু না পারছেন বেচতে, না পারছেন মজুত করতে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে এই অব্যবস্থা। হচ্ছে অভাবী বিক্রি। ফলে চাষের জন্য নেওয়া ঋণ ও সুদের পাহাড় জমছে প্রায় প্রতিটি চাষীদের ঘরে।আত্মঘাতী দুজনও এর ব্যতিক্রম নন। তবুও ‘আশায় বাঁচে চাষা’ আপ্তবাক্য মেনে এদ্দিন লড়াই জারি রেখেছিলেন দুজনেই। কিন্তু এবারের মরশুমে ফের একবার ‘ফসলের দাম না পাওয়া’র গল্প সামনে আসতেই আর পারলেন না নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে। দুজনেই গলায় দড়ি দিলেন! কালনার ইসমাইল শেখের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। সে তুলনায় চন্দ্রকোণার তাপস রুইদাসের বয়স ছিল খানিকটা কম। মাত্র ৪২।

ইদানীং একশ্রেনীর বাঙালীর উদ্ভব হয়েছে যারা সবকিছুকে জাত-ধর্মের আতসকাঁচের তলায় ফেলে বিচার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাদেরকে জানাই মৃত দুই আলুচাষীর একজন সংখ্যালঘু মুসলমান এবং অন্যজন অনগ্রসর তফসিলি জাতিভুক্ত। আর হ্যাঁ, আমাদের কাছে খবর আছে, এনারা দুজনেই লুঙ্গি পরতেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

পুনশ্চঃ
বাংলা জুড়ে চলা কৃষি সঙ্কট নিয়ে রাইজ অফ ভয়েসেসের প্রতিবেদনের লিঙ্ক সহ তালিকা দেওয়া হলো। আপনি পড়ুন এবং শেয়ার করুন।

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-03-09/202303090836335.jpg&category=0&date=2023-03-09&button=
b) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-03-09/202303090839136.jpg&category=0&date=2023-03-09&button=
c) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-03-09/202303090843412.jpg&category=0&date=2023-03-09&button=