আদানি কান্ড ও সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফল / Adani Incident and Recent Election Results

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস। আমাদের কোন রাজনৈতিক দলের হাতে টিকি বাঁধা নেই। তাই স্পষ্ট কথায় কোন কষ্ট নেই।

শিয়রে উত্তর-পূর্ব ভারতের তিন রাজ্যের বিধানসভা ভোট দেখেও বিগত একমাস আমাদের দেশের সবকটা বিরোধী দল আদানি নিয়ে যে আদিখ্যেতা করলো তার যে কোন প্রভাব উত্তর-পূর্বের ঐ তিনটি রাজ্যে নেই তা ভোটবাক্সে প্রমাণিত! এমনকি সারা দেশজুড়ে একই সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে যে ছয়টি উপনির্বাচন হয়েছে তার ফলাফলও বলছে কেন্দ্রের শাসক ও বিরোধীদের স্কোর ৩-৩ অর্থ্যাৎ ড্র। মানে সেভাবে দেখলে বাকি ভারতেও যে খুব একটা প্রভাব পড়েছে এমনটা নয়।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কেন পড়লো না! দায়টা কার!

হিন্ডেনবার্গ-আদানি কান্ড নিয়ে ইতিমধ্যেই আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস “হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট ও কিছু জরুরী প্রশ্ন” এবং “হিন্ডেনবার্গ বিতর্কঃ চৌকিদার চোর ধরতে রাজি কি?” শীর্ষক দুটি প্রতিবেদনে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। তা পড়ে আমাদের বহু পাঠকের ভালো লাগেনি। কিন্তু তাতে আমাদের কিছু করার নেই। কারও ‘ভালো লাগা-খারাপ লাগা’র ওপর সত্য নির্ভর করে না। যা ঠিক বা ঘটতে চলেছে বলে আমাদের মনে হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় লিখেছি। আমাদের মধ্যেও অনেকের তা পছন্দ হয়নি, কিন্তু তাতে কলম থামেনি। থামবে না।

যাইহোক, উত্তর-পূর্ব ভারতের তিন রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তা হলো ভোট বাজারে এখনও জাতি-সত্ত্বার রাজনীতি বা এথনিসিটি অফ দ্য সিটিজেন বাকি সমস্ত ইস্যুকে বলে বলে দশ গোল দিতে পারে। আর তাই ধর্ম-জাতপাতের রাজনীতি এবং তার ওপর পোশাক-খাদ্যাভ্যাস-ভাষা-আঞ্চলিকতার মশলা ছড়ানো গার্নিসিং যুগ যুগ জিও! সেখানে ম্যাড়ম্যাড়ে ভাত-রুটির লড়াই বা রোটি-কাপড়া-মকান অথবা বিজলি-সড়ক-পানি নেহাত অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক চেল্লামেল্লি বলে মনে করে বেশিরভাগ ভারতবাসী। আর এসবের মাঝে উটকো আদানি কেলেঙ্কারি খড়কুটোর মত উড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক!

তবুও সেই স্বাভাবিক ঘটনাটাকেই একটু রুটির মত উল্টে পাল্টে সেঁকে দেখাটা জরুরি। এক এক করে জানা উচিৎ কারণগুলো। নাহলে পথিক জানতে পারবে না যে সে পথ হারিয়েছে! সে খালি ‘আদানি আদানি’ চেল্লাতে চেল্লাতে হাঁটতেই থাকবে। ভাববে মানুষের সাথে জুড়ছি, কিন্তু সে জোড়ায় এতটা জোরও থাকবে না যাতে ‘এথিনিসিটি ঝড়’ আটকে যাবে। বলবে ‘সব হাতে কাজ, সব পাতে ভাত’ বা ‘জাতের নয়, ভাতের লড়াই’ কিম্বা “ধান্দাপুঁজির বান্দা মোদী দূর হঠো” অথচ জাত-ধর্মের ককটেলে বুঁদ জনতা ফিরেও তাকাবে না, কারণ তাদের জীবনের এথিনিসিটির সাথে এসব শ্লোগানবাজি আদৌ জুড়তে পারে না। কিন্তু কেন জুড়তে পারে না, আসুন তা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি এক-দুই করে।

এক, ভারতের একটা নগণ্য জনসংখ্যা শেয়ার বাজারের সাথে বা শেয়ার কেনা বেচার সাথে যুক্ত। তারমধ্যেও একটা সামান্য অংশ আদানি গ্রুপের শেয়ার ‘হোল্ড’ করেন। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা মূল অভিযোগটাই হলো আদানি গ্রুপ স্বনামে, বেনামে অথবা ঘুরপথে নিয়ম বহির্ভুতভাবে সেবি নির্ধারিত উর্দ্ধসীমারও অধিক পরিমাণ নিজেদের কোম্পানিগুলির শেয়ার নিজেরা কিনে রেখেছে, ফলে বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হয়েছে অথচ শেয়ারের যোগান নেই আর তাতেই শেয়ারগুলোর দাম এতটা বেড়েছে। মানে আদানি গ্রুপের শেয়ার হোল্ডারদের বেশিরভাগই ঘুরপথে আদানি পরিবারের সদস্য, সাধারণ জনগণ অতি সামান্য। কাজেই হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই আদানি গ্রুপের শেয়ারের দামে যে ধস নামে, তাতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ লোকজনের সংখ্যাটা খুবই কম, ভোটের নিরিখে আদৌ ধর্ত্যব্যের মধ্যে নয়। তাই জন্যেই এই ইস্যু নিয়ে জনসাধারণের একটা বড় অংশের কোন হেলদোল নেই। ফলে শাসক বা প্রধান সেবক কেউই আদানি নিয়ে মন্তব্যই করছেন না। ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি!

দুই, বিরোধীরা আদানি গ্রুপের এই কেলেঙ্কারিটাকে একটা ব্যপক সর্বগ্রাসী রূপ দিতে গিয়ে যে সরকারী ব্যাঙ্ক ও বীমা শিল্পের সঙ্কটের প্রসঙ্গ টানছে তা আদৌ বাস্তব নয়। আমাদের আগের প্রতিবেদনেই আমরা বলেছি যে স্টেট ব্যাঙ্ক বা এলআইসির আদানি গ্রুপে বিনিয়োগ বা ঋণের পরিমাণ তাদের বিশাল ব্যবসার ১% ও নয়। ফলে আদানি গ্রুপ যদি ডুবেও যায় তাতে স্টেট ব্যাঙ্ক বা আলআইসির সঙ্কট নেবে আসবে, সংস্থা দুটো লাটে উঠে যাবে এমনটা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে মানুষ দেখছে স্টেট ব্যাঙ্ক বা এলআইসি ডুবছে না, কাজেই আদানি ব্যাঙ্ক-বীমা সব ডুবিয়ে দিল এমন আর্তনাদ আদৌ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।

তিন, তাছাড়া এই ব্যাঙ্ক ও বিমা কোম্পানিগুলির প্রদেয় ঋণের একটা বড় অংশ আদানি গ্রুপের পরিকাঠামো শিল্পের অন্তর্গত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, এয়ারপোর্ট, পোর্ট ইত্যাদি দ্বারা সুরক্ষিত হওয়ায় কোনোভাবেই পুরো টাকাটা মার যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে এক শ্রেণীর মানুষ যারা সরসারি ব্যাঙ্ক ও বিমা শিল্পের সাথে পেশাগত ভাবে যুক্ত তাঁরা জানেন এই মুহুর্তে আদানি গ্রুপের কারণে স্টেট ব্যাঙ্ক বা এলআইসির কিছুটা আর্থিক ক্ষতি হলেও তেমন কোন সঙ্কটে পড়বে না। কাজেই তাঁরা কাগজে বা টিভিতে সেভাবে মুখ খুলছেন না। স্বভাবতই বিরোধীদের এই সংক্রান্ত দাবী দাওয়া গুলো সেভাবে জনমানসে মান্যতা পাচ্ছে না।

চার, তাও যদি ধরেনি, সেই অসম্ভব দিনটাও এসেছে, তাহলে এবার একটা অন্য হিসেব দিই। আদানি গ্রুপে রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বীমা কোম্পানিগুলির মোট বিনিয়োগ কম বেশি ষাট থেকে আশি হাজার কোটি টাকার মত। স্টেট ব্যাঙ্ক ও এলআইসির মোট সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা ৭৫ কোটি। এদের থেকে নানা ছুতোয় অতিরিক্ত ১০০০ টাকা কেটে নিলেই আদানি গ্রুপ ডুবে যাওয়ার কারণে হওয়া ক্ষতি উসুল হয়ে যাবে, অথচ গ্রাহকদের বেশিরভাগের গায়েও লাগবে না। এমনকি অনেকে জানতেও পারবেও না। যে জনতা ১১০ টাকা প্রতি লিটার পেট্রোল-ডিজেল কিনতে পারে, ১২০ টাকা লিটার কেরোসিন কিনতে পারে, ১২০০ টাকা দিয়ে গ্যাসের সিলিন্ডার কিনতে পারে আর তারপরেও প্রধান সেবকের ভক্ত থাকতে পারে তাদের কাছে ১০০০ টাকা আর কি এমন! তেমন হলে এই হাজার টাকাটা এক বছরে না কেটে আগামী পাঁচ বছরে বছর প্রতি দুশো টাকা কিস্তিতে নিলেও উসুল হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আম-জনতার পকেটে আদৌ তেমন কোন চাপও পড়বে না। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী গত আট বছরে ব্যাঙ্ক গুলি প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ মুকুব করে দিয়েছে অথচ আমি আপনি জানতে পর্যন্ত পারিনি।

পাঁচ, কংগ্রেস সহ বিরোধীদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আদানিদের থেকে কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনুদান নিয়ে তাদেরকে নানা অনৈতিক সরকারী সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। জলের দরে দেশের একের পর এক প্রধানমন্ত্রী নিজে আদানিকে বিদেশের মাটিতে যেমন অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা বা ইজরাইলে আদানিকে ব্যবসার বরাত পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রমাণ কোথায়! বিজেপি যে আদানিদের থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অনুদান নিয়েছে তার কোন প্রমাণ সামনে নেই, কারণ নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে সেই গোপনীয়তার ওপর। অনুদান প্রদাণকারী ও গ্রহণকারী কেউই তাদের নাম-ধাম বিস্তারিত ভাবে জনসমক্ষে জানাতে বাধ্য নয়। ফলে সাক্ষ্য প্রমানের অভাবে জনমানসে আদানিদের টাকায় বিজেপি চলছে এমন ধারণাটা তৈরি হচ্ছে না বা হলেও সেভাবে প্রভাব ফেলছে না। তাছাড়া বিরোধী দলগুলোও এমনকি কংগ্রেস, আপ বা তৃণমূল কংগ্রেসের মত প্রথমসারির বিরোধী দলগুলোও এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অনুদান তোলে। কাজেই তাদের কথায় নির্বাচনী বন্ড নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে জনগনের নেচে ওঠা মুশকিল। একমাত্র ব্যতিক্রম সিপিআই(এম) বা বামেরা। তারাই একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা নির্বাচনী বন্ড প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকেছে। কিন্তু তাদের জনভিত্তিমূলক ক্ষমতা খুবই স্বল্প ও সীমিত। আসমুদ্রহিমাচল জনমত গঠনের ক্ষমতা তাদের নেই।

ছয়, দেশের সংবাদমাধ্যম এই মুহুর্তে কেন্দ্রের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কুক্ষিগত! কাজেই সেখানেও আদানি কান্ডে এক-দুদিন একটু হইচই হওয়ার পর ফের সবাই চুপ। কিছু টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রে তো খোলাখুলি হিন্ডেনবার্গ কান্ডে আদানিদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

ফলে ভোট কুড়োতে গিয়ে শাসক বধে এই মুহুর্তে আদানি ইস্যু আদৌ তেমন বড় ‘শক্তিশেল’ নয়। তবে কি বিরোধীরা ছেড়ে দেবে। না! এক্ষেত্রে বিরোধীদের ধরে খেলতে হবে।

গত সপ্তাহে হিন্ডেনবার্গ-আদানি কান্ডে সুপ্রিম কোর্ট ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়েছে। তাতে আছেন প্রাক্তন স্টেট ব্যাঙ্ক চেয়ারম্যান ও পিঁ ভাট, প্রাক্তন আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের সর্বময় কর্তা কে ভি কামাথ, বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ ও প্রাক্তন ইনফোসিস কর্তা নন্দন নিলেকানি, প্রাক্তন বিচারপতি জে পি দেওধর, বিচারপতি সোমশেখর সুদর্শন এবং প্রাক্তন সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি এ এম সাপ্রে। দু মাসের মধ্যে কমিটি তাদের তদন্ত রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা করবে।

পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট নিয়ামক সংস্থা সেবি’কেও নির্দেশ দিয়েছে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত করে দু মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে রিপোর্ট জমা করতে।

কাজেই আদানিকান্ড শেষ হয়ে যায়নি। এই দুই তদন্ত রিপোর্টগুলোর ওপর আদানি কাণ্ডের পলিটিকাল ডিভিডেন্ড শাসক না বিরোধী কে পাবে তা নির্ভর করছে।

কিন্তু পাশাপাশি বিরোধীদলের মাথাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে আসন্ন বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার ভোট ও উপনির্বাচন গুলোকে পাখির চোখ করে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে, শুধু আদানি নিয়ে বাজার গরম করে ফুটেজ খেয়ে হবে না।

আর আমাদের বাংলার পাঠকদের জন্য একটি বিশেষ সূচনা।
আদানি কান্ডে তদন্ত কমিটি গড়লো সুপ্রিম কোর্ট। মোদির সরকার করেনি। ঠিক যেমন বাংলায় সমস্ত চুরি-চিটিংবাজির তদন্তে হাইকোর্টকে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়, রাজ্য সরকার নিজে থেকে কিছুই করে না।

এরপরও কি বলবেন দিদি-মোদি আলাদা! গ্রেটার-লেসার ভাগাভাগি করবেন! আপনারা চাইলে করতেই পারেন, তবে আমরা আপানাদের এই মতের সাথে সহমত নই।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস