হিন্ডেনবার্গ বিতর্ক : চৌকিদার চোর ধরতে রাজি কি? / The Chowkidar Files

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে আমাদের প্রতিবেদন “হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট ও কিছু জরুরী প্রশ্ন” পড়ে আমাদের অনেক পাঠক ও শুভাকাঙ্খীর ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল।

আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিজের শেয়ারগুলি যখন বাজারে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ছে, তখন আমরা বুক ফুলিয়ে যা লেখবার সাহস দেখিয়েছিলাম তার সারমর্ম হলো – এক, যতক্ষণ না সেবি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে ওঠা অভিযোগগুলির নিরপেক্ষ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করছে এবং তাতে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে, ততক্ষণ আদানী গ্রুপ ডুবছে না। দুই, ব্যাঙ্ক ও বিমা কোম্পানিগুলির আদানী গ্রুপকে দেওয়া ঋণ/বিনিয়োগের পরিমাণ তাদের খাতায় থাকা সর্বমোট বিনিয়োগ/ঋণের ১%-ও নয়। কাজেই আদানী গ্রুপ ডুবে গেলেও দেশের ব্যাঙ্ক ও বিমাক্ষেত্রে তেমন কোন আঘাত নেমে আসবে না। তার থেকেও বড়কথা ব্যাঙ্ক এবং বিমা কোম্পানিগুলোর ডুবে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, যেমনটা কেউ কেউ রটিয়ে বেড়াচ্ছেন। কাজেই তাদের গ্রাহকরা এব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। তিন, আদানী গ্রুপকে দেওয়া ঋণের বেশিরভাগ অংশ যথেষ্ট পরিমাণ অ্যাসেট ও ক্যাশ ফ্লো দ্বারা সুরক্ষিত, যার সাথে শেয়ার বাজারে শেয়ারের দাম ওঠা-নামার খুব একটা সম্পর্ক নেই। কাজেই শেয়ার বাজারে শেয়ারের দামে ধস নেমেছে মানেই আদানীদের ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে এমনটা ভাবার সময় আসেনি। তবে ‘এলআইসি’র শেয়ারে করা বিনিয়োগে কিছুটা ধস নেমেছে ঠিকই, তবে সেটায় লাভ কমেছে, ক্ষতি বাড়েনি বা কমেনি। আদানীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে যদি সরকারী স্তরে কোন তদন্ত শুরু না হয়, তাহলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আদানী গ্রুপের শেয়ার গুলির পতন ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে স্থিতাবস্থা চলে আসবে, ফলে একটু ধরে ব্যাট করলে এলআইসি বা অন্য ক্ষুদ্র-মাঝারি শেয়ারহোল্ডাররা তাদের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে পারবেন, এমনকি লাভের মুখও দেখতে পারেন। চার, তাই আদানি ডুবছে ভেবে মোদি সরকারের এপিটাফ লিখনেওয়ালাদের অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাঁচ, আদানীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সরকারী স্তরে যথাযথ নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি, এছাড়া সত্য সামনে আসবে না। কাজেই এই যাবতীয় চিৎকার চেঁচামেচি থেকে ব্যাঙ্ক-বিমা ডুবে যাচ্ছে, মানুষের টাকা উবে যাচ্ছে ইত্যাদি ‘গেলো গেলো’ রাজনৈতিক রব’টা ছেঁটে ফেলে আদানীর বিরুদ্ধে যাতে সরকারী স্তরে যাথাযথ তদন্ত শুরু হয়, তাতে জোর দেওয়া টা জরুরি।

বেশ কিছু মানুষের আমাদের এই প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছিল রাইজ অফ ভয়েসেসের কি হল রে বাবা! এরা কি শেষ পর্যন্ত ঘুরিয়ে মোদির দালালি করতে নেমে পড়লো! নাকি রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করলো, নিজেদের শিড়দাঁড়াটা শেষমেশ আর সোজা রাখতে পারল না! সরকার-কর্তৃপক্ষকে বলে বলে চার-ছয় মারা ব্যাটে কেমন যেন শর্ট রান নেওয়ার মানসিকতা। এমনকি সমাজমাধ্যমে অশালীন মন্তব্য পর্যন্ত ধেয়ে এসেছে আমাদের দিকে! কি সব আলফাল লেখেন! আমরা মুচকি হেঁসেছি আর আজকের দিনটার অপেক্ষায় থেকেছি।

আজ আপানারা যদি শেয়ার বাজারে আদানী গ্রুপ অফ কোম্পানিজের শেয়ার গুলির দিকে ফিরে তাকান, তাহলে দেখবেন তাদের বাজার দরে মন্দার ভাব কাটিয়ে ধীরে ধীরে তেজি ভাব ফিরে আসছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে আসার পর গতকাল এই প্রথম আদানী গ্রুপের শেয়ার গুলো বাজারে প্রায় ১৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি লাভের মুখ দেখলো, যা শতাংশের বিচারে ১.৪৫%। আজ এই লেখা যখন লিখছি , তখন বাজারের যা গতি প্রকৃতি, তাতে আমাদের মনে হচ্ছে আজও লাভের মুখ দেখবে। কাজেই বিগত প্রতিবেদনে আমাদের করা ভবিষ্যৎবাণী মতই আদানী গ্রুপের শেয়ারে ধীরে ধীরে পতন বন্ধ হয়ে স্থিতাবস্থা এসে যাচ্ছে। একে একে কেন্দ্রীয় সরকার, ব্যাঙ্ক ও বিমা কোম্পানিগুলিও জানিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র আদানী গ্রুপের কারণে দেশের ব্যাঙ্কিং ও বিমা ব্যবস্থায় তেমন কোন বিপদ নেই। গতকাল রেটিং এজেন্সি গুলি জানিয়েছে আদানী গ্রুপের ঋণের পরিমাণ বিপদসীমার ওপরে নয়। কাজেই আতঙ্কের কিছু নেই। যদিও ভবিষ্যতে আদানী গ্রুপকে বাড়তি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বা আদানী গ্রুপে বিনিয়োগ করবার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থা গুলোকে সতর্ক থাকবার পরামর্শ দিয়েছে। সিটি, স্টান্ডার্ড চার্টাড বা ক্রেডিট সুইসের মত কিছু বিদেশী ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলি যে আর আদানী গ্রুপকে অদূর ভবিষ্যতে ঋণ দেবে না, তা তারা স্পষ্ট করে জানিয়েও দিয়েছে। আদানী গ্রুপও সেইমত তাদের আগামী ব্যবসা সম্প্রসারনের জন্য দরকারী ‘ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার’-এ হ্রাস টেনেছে। আর এসব জানবার পরে বাজারে আদানী গ্রুপের শেয়ারগুলোর বাজারে ক্রমশঃ ঘুরে দাঁড়ানোয় যে বার্তা সামনে আসছে তা হলো, আপাতত বাজার বা বিনিয়োগকারীরা মনে করছে আদানী গ্রুপের বিপদ কেটে গেছে। আর এমনটাই আমরাও আশঙ্কা করেছিলাম আমাদের বিগত প্রতিবেদনে। তাই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাই নি। অহেতুক ‘গেল গেল’ রব তুলে আতঙ্ক ছড়াইনি। বরং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ‘সত্যি’টা বলবার সাহস দেখিয়েছি।

কিন্তু পাশাপাশি বিগত প্রতিবেদনে সোচ্চারে এই দাবীও জানিয়েছি যে আদানীদের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটা অভিযোগের সরকারী স্তরে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হওয়া জরুরি। শেয়ার বাজার নিয়ামক সংস্থা সেবি এভাবে চুপ থাকতে পারে না। অথচ গতকাল ও আজকে শেয়ার বাজারে আদানী গ্রুপের শেয়ারগুলোর তেজি মনোভাব যে বার্তা দিচ্ছে, তা হলো হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ গুলোর সরকারী স্তরে কোন নতুন করে তদন্ত শুরু হবে এমনটা বিনিয়োগকারীরা আশা করছে না! তারমানে বাজার নিশ্চিত, আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে যখন রাষ্ট্রপতি ভাষণের ওপর ধন্যবাদজ্ঞাপক সূচক ভাষণ দেবেন, তখন গতকাল রাহুল গান্ধীর দেওয়া ভাষণের ও হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর হয় উত্তর দেওয়ার চেষ্টাই করবেন না, অথবা উত্তর দিলেও তা হবে নিতান্তই চটকদারী রাজনৈতিক ভাষণ, এমনকি ‘ভারতের উন্নতিতে ঈর্ষাণ্বিত হয়ে পশ্চিমী দুনিয়ার পরিকল্পিত আক্রমণ’ টাইপের নাটুকে জাতীয়তাবাদের মিশেলও থাকতে পারে, কিন্তু কাজের কাজ কোন তদন্তের নির্দেশ তিনি কিছুতেই দেবেন না! কারণ সেরকম কোন তদন্তের নির্দেশ দিলে আবার ধস নামবে! ফলে সেরকম কোন ধস সামনে নেই বলেই মনে করছে বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ আর তাই এমন তেজি মনোভাব!

তবে কি ‘চৌকিদার চোর ধরতে চায় না’, দেশবাসী এমন কদাকার সত্যিটা জেনে ফেলেছে এবং মেনেও নিয়েছে! যদি তাই হয়, তবে তা দেশের জন্য খুবই লজ্জার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর! আমরা দেখছি এই বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অনেকে আবার খামোখা এসবিআই ও এলআইসির বিভিন্ন শাখা অফিসের সামনে প্রতীকি প্রতিবাদ করছেন বা ধর্না দিচ্ছেন যা নিতান্তই বাতুলতা! কারণ আদানী গ্রুপে তাদের বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের সীমা ও পদ্ধতি, নিয়ামক সংস্থার গাইডলাইন এবং তাদের নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ নিয়ম কানুন মেনেই হয়েছে বলে প্রাথমিক রিপোর্ট এসেছে। কাজেই চোর যদি সত্যিই ধরতে চান তাহলে, বিরোধী দলগুলোর উচিৎ একজোট হয়ে সেবির অফিসের সামনে বিক্ষোভ-অবরোধ করা, আর সংসদের ভেতরে এবং বাইরে লাগাতার প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে সরকার তথা চৌকিদারকে তদন্তের দাবী জানিয়ে চেপে ধরা! তা না হলে এই চৌকিদারের সরকারকে দিয়ে চোর ধরানো মুশকিল!

আদানী বড়লোক থেকে গরীব হলেন নাকি গরীব থেকে বড়লোক সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তিনি ও তাঁর সংস্থা আদৌ কোন নিয়ম ভেঙেছেন কি না সেটা দেশবাসীর জানা জরুরি। পাশাপাশি দেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যদি তিনি কোন নিয়ম কানুন ভেঙ্গে থাকেন তবে তার জন্য তাঁকে ও তাঁর সংস্থাগোষ্ঠীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানও অবশ্য কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। আর তারজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি ‘তদন্ত’।

কিন্তু চৌকিদার কি তাতে রাজী হবেন! সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস