দামোদর শেঠের গপ্পো / New Age Damodar Seth

প্রথমেই বলে রাখি “দামোদর শেঠের গপ্পো”র সব চরিত্রই কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়।

শুরু করা যাক গপ্পো।

আজ থেকে ৮৩ বছর আগে কবিগুরু লিখেছিলেন,

“অল্পেতে খুশি হবে,
দামোদর শেঠ কি?
মুড়কির মোয়া চাই,
চাই ভাজা ভেটকি।”

ছেলেবেলায় সহজ পাঠে কবিতাটা যখন পড়েছিলাম, তখন বুঝিনি, এটা যে বড়দের কবিতা। তবে আজ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমায় ভাবাতে বাধ্য করেছে, এটা সত্যিই বড়দের কবিতা। সহজ করে বললে কঠিন পাঠ।

রবি ঠাকুর কবিগুরু, উনি দশ-বারো লাইনের ছন্দে গম্ভীর মর্মার্থ বোঝাতে পারেন। আমাদের মত আনকোরাদের ক্ষেত্রে গদ্যই সম্বল, তাই কবিগুরুর কাছে অগ্রিম মার্জনা চেয়ে লিখতে বসলাম।

আজকের দিনে যদি দামোদর শেঠ থাকতেন, তাহলে উনি কি করতেন, আর কিভাবে মানুষের সব সমস্যার সমাধান করতেন? এক এক করে বলি।

এই যুগের দামোদর শেঠরা পৃথিবীর সর্বত্র এবং সর্বরূপে বিরাজমান। কোথাও তিনি পুরুষোত্তম, কোথাও বিশ্বগুরু, কোথাও তিনি দেবী অথবা কোথাও সর্ব ঘটে কাঠালী।

কবিতার ভাষায় যদি বলা যায়, তবে বলতে হয়:

মোদের শেঠ দামোদর,
চলে আঁকে বাঁকে,
বারোমাস দূর্নীতির,
পাকে ভরে থাকে।

পার করে দেয় গরু,
পার করে বালি,
নীরব আর বিনয়ে
রাজকোষ খালি।

দামোদর শেঠরা সাধারণত খুবই জনপ্রিয় এবং জনদরদী হয়ে থাকেন, তার জন্যে তারা তাদের সাম্রাজ্যের ২০% – ২৫% এর বেশি ঘাটতি হলেও, বাসন কোষন বাজিয়ে জনতাকে মনোরঞ্জিত হতে বলেন। আবার কখনো প্রজাদের খেলাধুলাতে উৎসাহ দিতে মহানন্দে ধুতি তুলে আলের ওপর দিয়ে দৌড়ান, আবার তার কিছু দিন পরে যারা দৌড়াতে বাধ্য করেছিল, তাদের পাশে নিয়ে দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দেন।

তাই এনাদের মাঝে মাঝেই মানুষের জন্যে কাজ করার ইচ্ছা হয়, তাই যেদিক তাদের পাল্লা ভারী বলে মনে হয়, সেদিকে দমবন্ধ করে ঝাঁপ দিয়ে দেন। সফল হলে কথা নেই, কিন্তু ঝাঁপিয়ে আহত হয়ে গেলে, আবার পরবর্তী ঝাঁপের জন্যে প্রস্তুতি নেন।

এনাদের সভাসদরাও খুবই নির্ভরযোগ্য হন, তাই তারা দামোদর শেঠের সব বাক্যবন্ধকে অব্যর্থ বলে বিবেচনা করেন, সেটা অঙ্কের ফর্মুলা (a+b)² হোক, গরু জড়ানো হোক বা নবজাতকের ওজন। সেই একই ফর্মুলাতে এদের সভাসদ থেকে ভক্ত-সমর্থকরা মাঝে মাঝে অনুপ্রাণিত হয়ে ভুল করে এদিক ওদিক ঝাঁপ দিয়ে দেন। কিন্তু এরা ভুল বুঝতে পারলেই কেলো। বেচারাদের ভুলের মাশুল একটু বেশিই দিতে হয়। ঘরে পুনরায় ফিরতে গেলে তারা কেবল দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে পার পান না, কেউ কেউ তাদের ফেরা আটকাতে মিছিমিছি চৌকাঠে শুয়ে থাকেন। তাই ফেরার জন্যে তাদের হরেক রকম পন্থা নিতে হয়। কিন্তু মজার ব্যপার, এক্ষেত্রে সাফল্য তাদের মোটামুটিভাবে নিশ্চিত।

যাই হোক, দামোদর শেঠ এবং তার সভাসদদের নিয়ে বলা যায় অনেক। কিন্তু আমাদের অল্পেতেই খুশি থাকতে হবে। ভালো থাকতে গেলে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকা খুব প্রয়োজন, এটা দামোদর শেঠরা খুব ভালো বোঝেন এবং এনারা অতি অল্প দিয়েই অগণিত মানুষের চোখের মণি হয়ে উঠতে পারেন। তার জন্যে অবশ্যই নানান টেকনিক আছে। ওসব এখন নেটদুনিয়ার দৌলতে অল্পবিস্তর অনেকেরই জানা।

দামোদর শেঠরা অর্থনীতিটা বেশ ভালো বোঝেন। কবিগুরু সেটা জানতেন, তাই সেটাই হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন তার সহজ পাঠে। দামোদর শেঠের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন:

“কলেবর খাটো নয়–
তিন মোন প্রায় ওজন।
খোঁজ নিয়ো ঝড়িয়াতে
জিলিপির রেট কি?”

ঝড়িয়াতে তো কয়লা পাওয়া যায় বলে জানতাম, জিডিপি থুড়ি জিলিপি পাওয়া যায় বলে জানা ছিল না। তবে কবিগুরু যখন লিখেছিলেন, তাহলে দামোদর শেঠ জানবেন কোথায় পাওয়া যাবে জিলিপি, আমাদের ওসব জেনে কাজ নেই। আর ওজনটাও দেখুন, মোটামুটি মিলিয়েই দিয়েছিলেন রবি ঠাকুর।

যাই হোক, আমরা অর্থনীতিকে যতটা কঠিন ভাবি, জিনিসটা অতোটা কঠিন নয়। ধরুন একটা ৫০ টাকার জিনিস, বিশ্বগুরু দামোদর শেঠ সেটা বিক্রি করতে ৩০ টাকা চাপাবে, আর শঠতার, থুড়ি সততার প্রতীক দামোদর শেঠ চাপাবে ২০ টাকা। আর জনতা এই নিয়ে তর্ক করবে কে বেশি নিচ্ছে, কে কম। কেউ বলবে না, কেন হাত ধরাধরি করে দুজন মিলে ৪০ টাকার জিনিস ১০৬.০৩ টাকাতে বিক্রি করছে। তাই দামোদর শেঠরা প্রায় প্রতিদিনই নিজের কোটাতে এক টাকা, দুই টাকা করে লাভ বাড়িয়ে যেতে থাকে। আর জনতা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে যায়, কে বেশি কে কম নিচ্ছে বলে। আরে মশাই, ফেলো কড়ি, মাখো তেল। কথাটা তো এমনি এমনি লোকে বলে না। অল্পতে খুশি থাকতে হবে।

আর মশাই, অর্থের কোন নীতি হয় নাকি, অর্থের সাথে ক্ষমতা বানাতে পারলে, তবেই হওয়া যায় দামোদর শেঠ। আর অর্থ না থাকলে গরিব, ছোটোলোক, ভিখারী ইত্যাদি, ইত্যাদি। ভাবুন, অর্থ না থাকলে কত রূপ, এটা কি দারুন না?

তাই ফালতু চেঁচামেচি করা ছাড়ুন, দামোদর শেঠরা যা করেন, যথার্থ করেন। সারা জীবন তাদের কথা বিশ্বাস করলেই সবার ভালো। যদি দামোদর শেঠের বাড়িতে রসুন ঢোকা নিষেধ থাকে, তবে রসুন খাবেন না। এর ফলে আপনারই লাভ। বেশি দাম দিতে হবে না, তাই সঞ্চয় বাড়বে। জিলিপি বাড়বে.. জিলিপি।

তারপর, দামোদর শেঠরা নানা রকম ভাবে প্রতিদিন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবার কাছ থেকে কর নিয়ে, সবাইকে অল্প দিয়ে নিজেদের অল্প দিনে সমৃদ্ধ করে তুলবে। শুধু জনতা নয়, নানা ছুতোতে প্রকৃতির কাছ থেকেও এরা কর আদায় করে, আর নিজের উন্নয়ন করে। মুড ভালো থাকলে, আমাদের দিকেও একটু ছিটিয়ে দেয়। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে ভাত, ভাতা, বাটা, বাটি, চাকরি সব পেতে পারেন। অল্পতেই তাই খুশি থাকা ভালো, সকলই তেনার ইচ্ছা। যেমন দক্ষিণা চড়াবেন, তেমন ফুল-ফল পাবেন।

কি? বুঝলেন না! আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি। যেমন কল কারখানার ধোয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করতে, পুরোনো কারখানা বন্ধ করা হয়, আর নতুন কারখানা তৈরি করা হয় না, পারলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ভাবে পরিবেশ দূষণ রোধ হয়। দিস ইজ ডেভেলপমেন্ট। ভাবুন দেখি, চারিদিকে কারখানা, শুধু ধোয়া আর ধোয়া। এক ভাইরাসে রক্ষে নেই, আবার ধোয়া দোসর। এখন কি সুন্দর পরিবেশ বলুন? কোনো ধোয়া নেই, আওয়াজ নেই, দূষণ নেই। মুক্ত বাতাস।

আবার কখনো জঙ্গলে বন্যপ্রাণীদের উপদ্রব থেকে মানুষকে রক্ষা করতে, জঙ্গল কেটে বিরাট গর্ত করে দেন। আর ওই গর্ত মাঝে কি সব মাটি না পাথর ওঠে, কে জানে! ওহ, ওই মাটিকে আবার কিছু লোক খনিজ বলে। দামোদর শেঠরা এতো এত ভালো যে, ওই মাটি না খনিজ, ওই সব কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করে নেন। আর কাজ ফুরোলে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে টুকুস করে কর্পোরেটরা “ফকির” সেজে পাড়ি দেন বিদেশে, তারপর দেশে ফিরতেই ভুলে যান। আর তারপর জনগণ দু চারটে ট্যাক্স বেশি দেন, ইকোনমি আবার খাড়া হয়ে যায়। এই আর কি?

এবার আপনি বলতে পারেন, এই মুল্যবৃদ্ধির বাজারে আর কত ট্যাক্স দেওয়া যায়! আরে মশাই, আপনাদের সুবিধার জন্যই তো মুল্যবৃদ্ধি।

আচ্ছা ধরুন আগে ২০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে, এক ব্যাগ বাজার করে রিক্সা করে ভারী ব্যাগ টেনে বাড়ি ফিরতে হত। দামোদর শেঠরা আমাদের এই কষ্ট দেখে এমন ব্যবস্থা শুরু করলেন, যাতে ২০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে আর ব্যাগ নিতে হয় না। এতে কত সুবিধা জানেন? প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে সবাইকে বিরত করা যায়, রিক্সা ভাড়া লাগে না, পয়সা বাচে, তার ওপর ভারী ব্যাগ টেনে কোমর ব্যথা হয় না, ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না, শরীর ভাল থাকে।

কোথাকার সব দেশে যেমন বলে সেভ দা ইয়ে। তেমন দামোদর শেঠের অনুগামীরাও বলেন, যে করে হোক, সেভ দা শেঠ। আটা গোলা জল বা কুকুরের হিসি খেয়ে প্রাণ যাবে তো যাক, দামোদর শেঠ জিন্দাবাদ।

আগে যখন মানুষের রোগ হত, তখন তার থেকে বাচাতে সরকারি তরফে বিনা পয়সায় দু ফোটা দিয়ে দেওয়া হত, তার কোনো সার্টিফিকেট ছিল না। এটা ঠিক ছিল না। এখন পয়সা খরচ করেও নেওয়ার ব্যবস্থা আছে, ফ্রি জিনিস কি আর ভালো হয়? তার ওপর ফ্রি বা পয়সা দেওয়া বা আটা গোলা জল, যাই হোক, সার্টিফিকেট ঠিক পেয়ে যাবেন। সেখানে কি থাকবে জানেন? হয় দামোদর শেঠ খিলখিলিয়ে হাসছেন বা নমস্কার করছেন। এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় কি বলুন?

তাই আমাদের অল্পেতে সন্তুষ্ট থাকাই ভালো, বেশী চাহিদা ভালো নয়, ছোটবেলায় গুরুজনরা বলতেন, এখন দামোদর শেঠরা বলেন। রোজ বলেন।

এই দেখুন, অর্থনীতি নিয়ে বলতে বলতে কিভাবে যে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে ঢুকে পড়লাম কে জানে। দামোদর শেঠরা নিজেরা স্বাস্থ্যের জন্যে কার্ড বিলি করলেও, নিজের চোখের ওপর দিয়ে আরশোলা হেঁটে গেলে আমেরিকা ছোটেন। শেঠ বংশ পাতি হাসপাতালে যাবে, এটা হয় নাকি?

স্বাস্থ্য ছাড়েন, কর্মসংস্থানে আসুন, এখানেও প্রচুর সম্ভবনা। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আপনার হাতে এখন এত স্কীম, তখন ডিএ’র অথবা চাকরির জন্যে রাস্তায় পড়ে থাকার প্রয়োজন নেই। চাকরি করে কী আর হবে, দামোদর শেঠ স্কীম দিচ্ছে তো। আর চাকরী না করতে হলে, পড়াশুনার আর কি দরকার আছে। পড়াশুনার দরকার না থাকলে শিক্ষকের কি দরকার আছে। তাই জন্যে তো সল্টলেকে দামোদর শেঠের পেয়াদারা পেদিয়ে তুলে দেয় পড়াশুনা জানা ঝকঝকে “ভুলভাল” ছেলেমেয়েদের। এতে ভুল আর কি? “বাঘ” সংরক্ষণ করতে হয়, জঙ্গলে হোক বা জেলে। শিক্ষক সংরক্ষণ শুনেছেন কখনো?

বরং দামোদর শেঠদের যেকোন ফরমাইশ পূরণ করতে থাকুন, তাতেই ভালো থাকবেন, ওতেই বেঁচে থাকবেন। ওনাদের বিকল্প কেউ আর আছে কি? থাকলেও মিডিয়া ওসব আপনাকে বলবে না।

“চিনেবাজারের থেকে
এনো তো করমচা,
কাঁকড়ার ডিম চাই,
চাই যে গরম চা।
নাহয় খরচা হবে,
মাথা হবে হেঁট কি?”

ঠিক, যা কিছু হয়ে যাক, দামোদর শেঠরা সচরাচর মাথা নিচু করেন না। সুযুক্তি হোক বা কুযুক্তি, কিছু না কিছু আপনাকে বুঝিয়ে ঠিক তারা তাদের নিজের দলে আপনাকে ভিড়িয়ে নেবেন। তারপরে আপনার দাওয়ায় বসে পাত পেড়ে খেতে বসবেন, তবে কিছু ক্ষেত্রে শুধু ছবি তুলে উঠেও যেতে পারেন। এরকম হলে কিছু মনে করবেন না, ওনাকে ফ্রি-তে দেখা যাচ্ছে, এটাই তো অনেক।

তাই তো বারে বারে বলি দামোদর শেঠ যা করেন, আমাদের ভালোর জন্যই করেন। সে গরু জড়ানো হোক বা সরকারি মঞ্চ থেকে ভুয়ো চাকরি দেওয়াই হোক, ওনারা সবসময় ঠিক।

রবি ঠাকুর সে যুগে এই ব্যপারটা তার মত লিখেছিলেন, আর আজ আমরা সেই কবিতার মর্মার্থ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।

যাই হোক, দোষ নেবেন না রবি ঠাকুর। এসব পড়ে বিদ্যুৎ চমকালে এরপর সেনবাবুর জমি জায়গা নিয়ে টানাটানি হতে পারে। এবার আপনি বলতে পারেন, সেন বাবুর জমি তো আমার কি! হুম, তা বলছি যে, কয়দিন আগে বাড়িতে এসে মিউনিসিপালটি বা পঞ্চায়েতের লোক দলিল, পর্চা থেকে এটা ওটা দেখতে এসেছিল কি? কেন এসেছিল, ডিপলি চিন্তা করেছিলেন কি? এবারও যদি না বোঝেন তবে, ক্যা ক্যা ছি ছি।

সব শেষে আজকের দামোদর শেঠের পরিমার্জিত সংস্করণ।

মোদের শেঠ দামোদর,
চলে আঁকে বাঁকে,
বারোমাস দূর্নীতির,
পাকে ভরে থাকে।

পার করে দেয় গরু,
পার করে বালি,
নীরব আর বিনয়ে
রাজকোষ খালি।

শক্তিগড় থেকে
এনো তো ল্যাংচা,
মিটিংয়েতে ডিম চাই,
চাই যে গরম চা।
ঝালমুড়ি খেয়ে নিলে,
মাথা হবে হেঁট কি?

কলেবর খাটো নয়–
তিন মোন প্রায় ওজন।
খোঁজ নিয়ো বীরভূমে
বালি-পাথরের রেট কি?

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস