এবং কোমা

আজ একটা রাজনৈতিক গল্প হয়ে যাক। যেহেতু গল্প, তাই এই গল্পের সব চারিত্র কাল্পনিক। কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তি অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কোন মিল খুঁজে পেলে তা অনিচ্ছাকৃত হিসেবে বিবেচনা করবেন।

আশির দশকে তখনও মেদিনীপুর ভাগ হয়নি। চারদিকে রাজনৈতিক হিংসা ও হানাহানি। লক্ষীগড় তাদের মধ্যে ছিল অন্যতম। সেখানেই থাকত আমাদের গল্পের নায়িকা, কোমাগাতা ওরফে “কোমা”। কোমাগাতা নামটা ওর দাদুর দেওয়া, বিখ্যাত কোমাগাতা মারু জাহাজের নামে, যা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ।

যাই হোক, কোমাগাতা বা কোমা, প্রভাবশালী চন্দ্র মিশ্রের দলের অন্যতম এক সদস্য। তার দলের অনেকেই ভাবে, এই মেয়েটি একদিন হয়ে উঠতে পারে, দলের অন্যতম বড় সম্পদ। বিরোধী চঞ্চল চৌধুরীর দলের লোকেরাও তাকে নিয়ে চিন্তিত। তাদের সেই চিন্তা বা দুশ্চিন্তা থেকেই, কোমাগাতার নামকে তারা কোমা বলে জনতার কাছে জনপ্রিয় করে দিয়েছিল ।

যতোই বিরোধীরা কোমাগাতাকে “কোমা” বলুক। ওর এতে হেলদোল নেই। কারণ ও জানে সাম্রাজ্যবাদ কোনোদিন সমাজবাদকে ভালো চোখে দেখে না। তাই নিজের ও দলের শোষণহীন সমাজ তৈরির লক্ষ্যে অবিচল। মাঠে ময়দানে নেমে প্রতিদিন সততার সাথে সেই কাজ ও করে চলে।

দিন আসে, দিন যায়.. এভাবে কেটে যায় ত্রিশটা বছর। এর মধ্যে চন্দ্র মিশ্র চলে যান, তার দলের অন্যতম শীর্ষ পদে, মন্ত্রী হন। আর অন্যদিকে চঞ্চল চৌধুরীও বসেন তার দলের রাজ্য নেতৃত্বের শীর্ষ পদে।

দেখতে দেখতে চলে আসে বিধানসভা নির্বাচন। চরম প্রস্তুতি নেয় দুই পক্ষ। কারণ এবারের লড়াইতে দুজনেই সমান শক্তিধর।

একদিকে চন্দ্র বাবুর আছে ত্রিশ বছরের সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা, আর অন্যদিকে চঞ্চল বাবুর কম যান না। আগের চেয়ে দলের শক্তি ও ঝাঝ একটু কমে গেলেও, এখনও তিনি দুটো জেলার সর্বময় কর্তা, তার সাথে আবার আছে তাদের ছোট বোন, সেই বোন যে একসময় তাদের ত্যাগ করেছিলো। গিলে খেয়েছিল তাদের দলকে। কিন্তু আজ সে ফিরে এসে দাদার হাত ধরেছে নিজের তৈরি দল নিয়ে দাদার কাছে।

কিন্তু, চন্দ্র মিশ্র তা নিয়ে একটুও ভাবিত নয়, কারণ তার কাছে আছে প্রবল সম্ভবনাময়ী কোমাগাতা। এখন সে দুদে রাজনীতিবিদ, একাই ২০০। ঠিক মাথা ভেঙে দেবে বিরোধীদের।

কালচক্রে নির্বাচনের আগে একদিন কলকাতার গড়ের মাঠে একই দিনে, একই সময়ে আয়োজন করা হল দুটো বিরাট সভা। চন্দ্র আর চঞ্চল মুখোমুখি। এমনও হয় নাকি? হ্যাঁ, গল্পে এমন হতেই পারে।

তাই গড়ের মাঠে চন্দ্র মিশ্রের স্টেজ বাম দিকে, আর চঞ্চল চৌধুরীর স্টেজ ডান দিকে। আর মাঝখানে দুই দলের সমর্থকরা। থিকথিকে ভিড়। বেলা গড়াতেই ভিড়ের সাথে বাড়তে লাগলো রাজনৈতিক উত্তাপ। শুরু হল প্রবল সংঘর্ষ।

তারপরে আর কোমাগাতার মনে নেই। আহত হয়ে ও চলে গিয়েছিল কোমাতে। চন্দ্র মিশ্রকে চঞ্চল চৌধুরীর বোনের ছোড়া ইটের আঘাত থেকে বাচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোমাগাতা। ইট লাগেনি চন্দ্র মিশ্রের গায়ে, লেগেছিল কোমাগাতার ইটের আঘাতে মাথা ফেটে গুরুতর আহত হয়ে ভর্তি হয়েছিল এক হাসপাতালে। তারপরে কোমায়।

এরপর কেটে গেছে ১০ বছর।

ফেব্রুয়ারি, ২০২১.. কোমাগাতার ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে। সব মনে পড়ছে, সেই ব্রিগেড, চঞ্চল চৌধুরীর বোনের ছোড়া ইট। কিন্তু বলবে কাকে? ঘরে তো ও ছাড়া কেউ নেই। কাঁপা কাঁপা চোখে, জানলার দিকে তাকিয়ে জানলার তাকে একটা খবরের কাগজের দিকে নজর পড়লো কোমাগাতার। বছরটা ২০২১ দেখে অবাক বনে গেলো কোমাগাতা। আরে, দশটা বছর কেটে গেছে যে। কিন্তু প্রথম পাতায় চঞ্চল চৌধুরীর বোনের ছবি, সে আবার মুখ্যমন্ত্রী। সে কি করে সম্ভব? মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর, দশ বছরে কি হয়েছে ও জানে না, তাই কাগজের পাতাগুলো তাড়াতাড়ি করে ও উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো।

তিনের পাতায় একি! চন্দ্র মিশ্রের সভা। আজকেই। আনন্দে মন ভরে উঠলো। কিন্তু, যাবে কি করে? হাসপাতাল কি ছাড়বে?

ধুর, ধুর, আবেগের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর কি? আর এখনো যখন হাসপাতালের লোকেরা টের পায়নি যে কোমাগাতার জ্ঞান ফিরেছে, তাহলে পাঁচিল টপকে পালিয়ে যাওয়াই যায়। কতো ব্যারিকেড টপকে গেছে এককালে, আজ পারবে না?

যেই না ভাবা, সেই কাজ। পাঁচিল টপকে, লুকিয়ে, দৌড়িয়ে কোমাগাতা পৌছল ব্রিগেড। কত লোক, কত লোক।

অধীর উৎসাহে হাফাতে হাফাতে কোমাগাতা এগিয়ে চলেছে মঞ্চের দিকে। ১০ বছর বাদে ও দেখবে ওর প্রিয় নেতা চন্দ্র মিশ্রকে। শুনবে ওনাকে। ভিড় পেরিয়ে মঞ্চের সামনে গিয়ে কোমাগাতা দেখতে পেলো, চঞ্চল চৌধুরী বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর চন্দ্র মিশ্র পাশে বসে আছেন। সাথে দুই দলের বড় বড় নেতা।

তারপর? তারপর কোমাগাতা ওরফে কোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেদিন চঞ্চল চৌধুরী আর চন্দ্র মিশ্র মঞ্চে একে অপরের বক্তৃতা যথা সময়ে শেষ করেছিলেন।

যাই হোক, বছর দশ কোমায় বা ঘুমিয়ে থাকার কারনে কোমাগাতা ওরফে কোমা জানতে পারেনি রাজ্য রাজনীতির পট পরিবর্তন। বুঝতেই পারেনি যে নিখাদ ফ্যাসিবাদী ধর্ম রাজনীতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন শুরু হয়ে গেছে রাজ্যে। ফলে সে প্রাথমিক ভাবে দেশের হৃদয়ে ক্যানসারের থেকে নিজের মাথার ক্ষতকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তবে মাঠে নেমে দীর্ঘকাল রাজনীতি করেছে কোমাগাতা। আর সমাজবাদের প্রাথমিক অধ্যয়নও তার আছে।

প্রাকটিক্যাল প্র্যাকটিসবিহীন সংগঠনবিহীন সমাজবাদ চর্চা অচিরেই মনগড়া কল্পনার নিখুঁত সমাজবাদী শক্তি হয়ে উঠবে ও বাস্তব পৃথিবীর সাথে বোঝাপড়ার ক্ষমতা হারাবে – এক বিখ্যাত সাম্যবাদীর এই সতর্কবার্তাও ও জানে। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে ও সেটাও উপলব্ধি করতে পারছে খানিকটা।

তাই এখন অজ্ঞাতবাসে কোমাগাতা নিজের মাথার ক্ষততে হাত বোলাতে বোলাতে দেশের হৃদয়ে কি অপারেশন চালিয়ে ক্যানসার দূরীভূত করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে। বাস্তবের মাঠে একটা রাজনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনার স্ট্রাটেজি কষতে গিয়ে কোমা বুঝতে পারছে লোকবল সোর্স সাপ্লাই ও যোগাযোগের মাত্রাটা ঠিক কতটা বড় হওয়া দরকার। তাই মাথা আর না চুলকে, সব বিরোধী শক্তিকে একত্রে এনে লড়াই দেওয়া একমাত্র উপায় বুঝে মাথার গভীর ক্ষত টুপিতে আপাতত ঢাকা দিয়ে, দেশের ক্ষয় মেটাতে সে ঝান্ডা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আর আশেপাশে আরো নানা রঙের ঝান্ডার সমাহার দেখে কোমাগাতা আস্বস্ত বোধ করছে আজ। আশ্বস্ত সে নিজেকে নিয়েও।

নিজের ক্ষুদ্র প্রতিশোধস্পৃহা কে দমন করে সে যে আবার বৃহৎ লড়াইয়ে সামিল হতে পেরেছে, তার জন্য সে তার হাতে পায়ে খেটে তৈরি করা রাজনৈতিক বোধের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছে। ওর লড়াই শুরু হয়ে গেছে।

আপনার?