পরিযায়ী কৃষক / Migrant Farmers

মন রে, কৃষিকাজ জানো না!

বিগত কয়েকদিন হলো, এই পুরানো রামপ্রসাদী গানটা সুপারহিট! সৌজন্যে কবি শ্রীজাতর ‘মানবজমিন’ এবং অরিজিত সিং ও শ্রেয়া ঘোষাল!

গানটা শহুরে সান্ধ্য আড্ডায় সিঙ্গল মল্ট বা চিভাস রিগালে চুমুক দিতে দিতে আপনাকে স্মৃতি মেদুর মুর্ছনায় দুলিয়ে দিতেই পারে! তা বলে ‘যাই একটু গ্রামের দিকে নিরিবিলিতে বেড়িয়ে আসি’ ভেবে সেখানে গিয়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠবেন না যেন!
কারণ স্থানীয় রসিক গ্রামবাসীদের কেউ শুনতে পেলে পাল্টা গেয়ে উঠতে পারে ‘কৃষিকাজ জেনেও গুরু, লাভ হবে না, লাভ হবে না….’

হ্যাঁ! শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই এই মুহুর্তে গ্রাম বাংলার বাস্তব ছবি।

এর পেছনে একদিকে যেমন আছে বন্যা, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মার, অন্যদিকে তেমনই আছে মান্ডিতে ফসল কেনাবেচায় ব্যপক দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ, মান্ডিতে গিয়ে ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রি করতে না পেরে শেষে কম দামে ফড়ে/দালালদেরকে ফসল বিক্রি করে দেওয়া, গ্রামীণ সমবায় ব্যবস্থা লাটে উঠে যাওয়ায় চড়া সুদে ঋণ প্রদানকারী বেসরকারী মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থাগুলির দৌরাত্ম, সারের কালোবাজারি ইত্যাদি নানাবিধ ‘ম্যানমেড’ কারণগুলি।

তাই বাংলার কৃষক সম্প্রদায় আজকাল আর খুব একটা চাষবাস করতে চায় না। এদের অনেকেই প্রবল ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে দেনার দায়ে চাষের জমি-জমা বেচে এই মুহুর্তে কৃষক থেকে ভাগচাষী বা ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়েছেন। আর একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে অথবা ভিনদেশে! বিভিন্ন ইমারতি অথবা পরিকাঠামোগত নির্মাণ কাজে, কোলিয়ারিতে অথবা ছোট-খাটো কলকারখানায় দক্ষ- অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

তবে ইদানীং শুনছি নাকি একটা নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। বাংলার অনেক কৃষক আজকাল ভিনরাজ্যে গিয়ে অন্যের জমিতে ক্ষেতমজুর হিসেবে চাষ আবাদ করছে অথচ বাংলায় চাষ-আবাদ করতে তাদের তেমন কোন আগ্রহ নেই, কারণ তাতে নাকি শুধুই আর্থিক লোকসান! কিন্তু যখন নজরে পড়লো একসময় যাকে ‘ধানের গোলা’ বলা হতো সেই বর্ধমান জেলার চাষিরাও আজকাল দলবেঁধে ধান রোয়ার কাজে ভিনরাজ্যে যাচ্ছে, তখন আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। আসলে আমরা তো আর ‘ভাতের কারখানা’র জমিতে ‘গাড়ির কারখানা’ চাই না’ বলে কেঁদেকেটে বাংলা থেকে শিল্প তাড়ানো ‘রুদালী’ নই। সেরকম কেউ হলে এদ্দিনে নিজেদের চ্যানেল/খবরের কাগজ চালু করে ফেলতাম। সেক্টর ফাইভের ঝাঁ-চকচকে অফিসে বসে শাসকের হয়ে ‘পজিটিভ’ নিউজ করতাম!

রাইজ অফ ভয়েসেস হলো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সেই সমস্ত খবর তুলে আনা হয় যা বাংলার মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয় না, বা হলেও যথাযথ ‘গুরুত্ব’ পায় না। তাই যখন মোবাইলে অ্যালার্ট এলো ‘ফের দুই পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু’ অথচ একদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখলাম কাগজ বা চ্যানেলগুলোতে কোন সাড়াশব্দ নেই তখন বাধ্য হয়ে কলম ধরতে হল।

প্রথমে আসা যাক খবরটাতে। পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী থেকে ১৪ জন কৃষকের একটি দল গত ডিসেম্বর মাসে অন্ধ্রপ্রদেশে গিয়েছিল ধান রোয়ার কাজ করতে। সেখানেই খাবারে বিষক্রিয়া জনিত কারণে দলের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে, ফলে দলটি ফেরত চলে আসে। তাদেরই মধ্যে দুজন, সুকুমার মাঝি ও খোকন মাঝি নামে দুই ভাই যথাক্রমে গত রবিবার ও সোমবার মারা গেছেন। ঐ দলের আরও কয়েকজনের অবস্থাও নাকি আশঙ্কাজনক! জেলা স্বাস্থ্যদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রোগীদের চিকিৎসা ও মৃত্যুর আসল কারণ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস বুঝতে চাইছিলাম ‘ধানের গোলা’ হিসেবে খ্যাত বর্ধমান জেলার চাষীদের দলবেঁধে ধান রোয়ার কাজ করতে হঠাত অন্ধ্রপ্রদেশে যেতে হলো কেন!

আর একটু খোঁজ খবর করতেই উঠে এলো সেই পুরানো গল্পগুলো, যা আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস এক বছর আগেও একাধিক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিলাম। যাঁরা প্রথম এলেন আমাদের পাতায়, মানে নতুন, তাদেরকে বলবো আমাদের লেখা ‘চালবাজি’, ‘সার-কথা’, ‘মাইক্রোফিন্যান্স মহাজন’ অথবা ‘দুয়ারে ক্ষেতমজুর’ প্রতিবেদনগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে। তাহলেই কারণগুলো বিশদে জানতে পারবেন। বর্তমান প্রতিবেদনের একদম শুরুতেও ছোট করে দু-তিন লাইনে বাংলাজুড়ে চলা এই কৃষিসঙ্কটের মূল কারণগুলোতে আলোকপাত করেছি। তাই সেই ‘এক ঢোল এক কাঁসি’ আর বাজাতে চাইছি না। বরং যাকে বলে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’, সেই বিষফোঁড়ার খবরটা দিয়ে দিই আপনাদেরকে।

আমরা সবাই জানি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ‘মানবিক’। কেউ কেউ হয়তো মানেন না। কিন্তু অনেকেই মানেন। তাদের মনে হতে পারে, হতেই পারে এরকম কিছু ব্যতিক্রমী মৃত্যুর ঘটনা, ‘মানবিক’ সরকার নিশ্চয়ই বাংলার ধান চাষীদের পাশে দাঁড়াবেন। নিশ্চিত করবেন যাতে ধান চাষীরা সরকারি মান্ডিতে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন। এটুকু করলেই বাংলার কৃষকদের ক্ষেতমজুর হয়ে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হবে না।

কিন্তু কোথায় কি! বাস্তবচিত্র একদমই বিপরীত। রেশনে চাল দিতে চলতি মরশুমে রাজ্য সরকার চাষীদের থেকে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল ৫৫ লক্ষ টন। মোট ১ লক্ষ ৬৩ হাজার কৃষক মান্ডিতে গিয়ে ধান বিক্রি করবার জন্য নথিভুক্ত হয়েছিলেন। অথচ নভেম্বর থেকে ধান কেনা শুরু করে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ধান কেনা হয়েছে মাত্র ১৮ লক্ষ ৮৬ হাজার টন যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৪%। অর্থ্যাৎ ৬৬% ঘাটতি। এই ঘাটতির মানে হলো কৃষক মান্ডিতে ধান বিক্রি করতে না পেরে যথারীতি মান্ডির বাইরে অভাবী বিক্রি করছে। কারণ সময় মতো হাতে পয়সা না এলে তাদের পক্ষে যেমন সংসার টানা দুষ্কর ঠিক তেমনই আগামী মরশুমে চাষবাসের প্রস্তুতির জন্য মানে বীজ কেনা, সার দেওয়া ইত্যাদির জন্য হাতে পয়সা থাকে না। আর এই পয়সার টানাটানি এড়াতেই ভিনরাজ্যে যাওয়া! আরও শুনলে অবাক হবেন। পূর্ব বর্ধমানের মত ‘শস্যগোলা’তে (যে জেলাতে এই মৃত দুই পরিযায়ী কৃষকের বাস) মাত্র ৬০০০ হাজার কৃষক মান্ডির মাধ্যমে ধান বিক্রি করতে নথিভুক্ত হয়েছেন। এর মানে ইতিমধ্যেই বর্ধমানে ধানচাষীদের একটা বড় অংশ হয় আর ধান চাষ করছেন না, জমি-জমা বেচে পরিযায়ী শ্রমিক বা অন্য পেশায় চলে গেছেন অথবা সরকারি মান্ডিতে ধান বেচবার দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির কারণে ফড়ে/দালাল/আড়তদারদের কাছে সরকারি ন্যায্য মূল্যের থেকে কুইন্টাল প্রতি ১০০-১৫০ টাকা কমদামে ধানের ‘অভাবী বিক্রি’ করছেন। ফলে এদের কতজন আগামী বছরও ধানচাষ করবেন তা ‘মা-গঙ্গা’ই জানেন!

তা বলে ‘গঙ্গাসাগর মেলা’ বা ‘গঙ্গা আরতি’ নিয়ে লাফালাফি করে এই সমস্যার সুরাহা কিছু হবে কি! না। হবে না। কিন্তু তাও এগুলো নিয়েই বাংলার মিডিয়া নাচানাচি করবে, যাতে পূর্ব বর্ধমানের দুই পরিযায়ী কৃষকের মৃতদেহর সামনে বেআব্রু হয়ে পড়া বাংলার ধানচাষীদের দুর্দশার দিকে আপনাদের চোখ না যায়।

পরিশেষে, আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস স্পষ্ট করে বলতে চাই, এনারা ‘পরিযায়ী কৃষক’, যাঁরা এঁদেরকে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ বলছেন শুধরে নিন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার অপচেষ্টা আমরা বরদাস্ত করবো না। আর সিঙ্গুর আন্দোলনে ‘ভাতের কারখানা’র জয়গান গাওয়া বাঙ্ময় মুখগুলো কেন সোনার ফসল ফলানো পরিবর্তনের বাংলায় ‘পরিযায়ী কৃষক’ নামক নতুন ‘উলুখাগড়া’গুলোকে দেখতে পাচ্ছেন না, জানতে চায় বাংলা।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://www.uttarbangasambad.com/2-migrant-workers-died-after-returning-home-due-to-illness-panic-in-purvasthali-village-of-burdwan/
b) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-01-11/202301102354047.jpg&category=0&date=2023-01-11&button=