এক ‘বিড়ি’ গপ্পো / The Tobacco Files

লেখার শুরুতেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর!

আর তারপর বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে আজ সিগারেট না ধরিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়েছি লেখাটা গুছিয়ে লিখবো বলে! যদিও জানিয়ে রাখি ঘটনাচক্রে লেখার বিষয়টিও বিড়ি সংক্রান্ত! তাই ভাবলাম একটা বিড়ি টানতে টানতে চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে থরে থরে আগে সাজিয়ে নিই, তারপর বিড়ি ফেলে হাতে কলম নেবো।

কিন্তু আপনারা যারা আমাদের নিয়মিত পাঠক তাদের মনে হতেই পারে, এত কিছু থাকতে আজ রাইজ অফ ভয়েসেস খামোখা বিড়ি নিয়ে পড়লো কেন! এটা কি আমাদের সাব-অলটার্ন টার্ন! তাই সেই সমস্ত পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যে বিড়ির পেছনে ‘যকের ধন’ পাওয়া যায় তাকে মোটেই আর সাব-অলটার্ন বলে হেলাফেলা করা যায় না। রীতিমত ‘মেইন স্ট্রিম’ হিসেবে গণ্য করে আলোচনার কেন্দ্রে জায়গা দিতে হয়। আমরাও সেটাই দিচ্ছি।

বিড়ি শিল্পের একটা নির্দ্দিষ্ট পিকিউলিয়ারিটি আছে। বিড়ি তৈরির কারখানা গুলোতে মূলতঃ বাঁধা বিড়ির ঝাড়াই-বাছাই, প্যাকেজিং আর লেবেলিং হয়। আসল বিড়ি বাঁধার কাজটা হয় ঘরে ঘরে যা মূলতঃ কুটিরশিল্পের আওতায়। বিড়ি বাঁধা মানে ২৭০ গ্রাম তামাকপাতার চূর্ণ চৌকো করে কাটা শুকনো কেন্দুপাতার আবরণে মুড়ে লাল কালো সুতো দিয়ে বাঁধা। আর এই কাজটা করেন মূলতঃ বাড়ির মেয়ে-মহিলারা। এই কাজে পুরুষের সংখ্যা খুবই কম। তার একটা বড় কারণ হল পুরুষালি হাতের চাপে শুকনো কেন্দু পাতা ভাঁজ করবার সময় ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যারফলে উৎপাদনের খরচ বাড়ে। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন সিটু’র হিসেবে ৯০ শতাংশ বিড়ি শিল্পের শ্রমিকই বাড়িতে থেকে বিড়ি বাঁধেন, মানে মহিলা। বিড়ি বাঁধার কাঁচামাল মানে তামাকপাতার গুঁড়ো, কেন্দুপাতার বান্ডিল এবং সুতো, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করে বিড়ি কারখানার মালিকের নির্বাচিত ঠিকাদার বা মুন্সীরা। দক্ষ কম বয়সি মহিলারা দৈনিক দেড় থেকে দু হাজার বিড়ি বাঁধতে পারেন। কিন্তু বয়স বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মেই সংখ্যাটা কমে আসে ৫০০ থেকে ৭০০ তে। ফলে কমে উপার্জন। তাছাড়া তামাক পাতার সংস্পর্শে বিড়ি শ্রমিকদের কাজ করতে হয় বলে এদের মধ্যে বয়সকালে যক্ষ্মা রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এছাড়াও নানাবিধ ফুসফুস জনিত রোগেও এরা ভোগেন বেশি। তাও এদের জন্য কোন বিশেষ ‘স্বাস্থ্যবিমা’র ব্যবস্থা বিড়ি কারখানার মালিক বা সরকার পক্ষ আজও ভেবে উঠতে পারেন নি। এমনকি মালিকের তরফে নেই প্রভিডেন্ট ফান্ড সহ অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধাও। কারণ এঁরা প্রায় সবাই ঠিকাদার/মুন্সির অধীনে কাজ করা অসংগঠিত অস্থায়ী শ্রমিক। মানে বান্ডিল বেঁধে ১০০০ বিড়ি দাও, মজুরি নাও, কথা ফুরিয়ে গেল। এই হিসাব-নিকাশটা হয় সাধারনতঃ সাপ্তাহিক ভিত্তিতে। এই মজুরি নির্ধারিত হয় বার্ষিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে সরকারি মধ্যস্থতায় জেলা/ক্লাস্টার ভিত্তিক ভাবে। মজার ব্যাপার হলো সেই মজুরি রাজ্য সরকারের নির্দেশিকাতে উল্লেখিত ন্যুনতম মজুরির থেকে কম হয়। যেমন ধরুন, রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে প্রতি এক হাজার বিড়ি বেঁধে শ্রমিকদের ২৬৭ টাকা ৪৪ পয়সা পাওয়ার কথা। অথচ মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিকরা মজুরি পান হাজার বিড়ি প্রতি ১৭৮ টাকা। আবার বর্ধমানে হাজার প্রতি মজুরি হওয়ার কথা ৩৪০ টাকা, অথচ দেওয়া হয় ১৪০- ১৬০ টাকা। ইদানীং মজুরির সে টাকাও সারা বাংলায় কোথাও পুরোটা পাওয়া যায় না। কাঁচামাল নষ্টের কারণে বা বিড়ি বাঁধায় ত্রুটির কারণে কিছু টাকা কেটে নেওয়া হয়। মানে ১০০০ বিড়ির বদলে জমা নেওয়া হয় হাজার প্রতি অতিরিক্ত ১০০ থেকে ১৫০ টা বিড়ি। মানে সোজা কথায় ১১৫০ টা বিড়ি বাঁধিয়ে মজুরি দেওয়া হয় ১০০০ বিড়ির। এছাড়াও হাজার প্রতি ১০-১৫ টাকা কাটা হয় মুন্সী/ঠিকাদারদের কমিশন হিসেবে। এমনকি বাকিতেও কাজ করানো হয়। আবার বিড়ি শ্রমিকদের সপ্তাহে যে রোজ কাজ দেওয়া হয় তাও নয়। মুন্সীরা হয়ত প্রথমে সপ্তাহে ৩ দিন কাজ করবার মত কাঁচামাল দিলেন। কাজ শেষে ফের কাঁচামাল দিতে বললে অনেকেই শর্ত চাপান , বাকি ৩ দিন কাজ করবার মত কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে যদি শ্রমিকেরা কম মজুরিতে কাজ করতে রাজি থাকে তবে! মানে বিড়ি শ্রমিকরা কার্যত কারখানার মালিক ও মুন্সী/ঠিকাদারদের হাতের পুতুল! সেভাবে দেখলে সারা বাংলায় বিড়ি শ্রমিকরা মজুরি পান এক হাজার বিড়ি বেঁধে গড়ে ১৫০ টাকারও কম।

এখন এই মজুরি দেওয়া থেকে কাঁচামাল কেনা অনেকটাই আগে হতো নগদে। ফলে প্রথম যখন ‘নোটবন্দি’ হলো তখনই বিড়ি শিল্পের সমস্যার কথা শোনা গেছিল। এছাড়া পরবর্তীতে মহামারীর জন্য উপর্যুপরি লকডাউন পর্বে এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিড়ি শিল্পের ওপর জিএসটি চালু করায় ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে বিড়ি শিল্পের মালিকদের তরফে দাবীও করা হয়। আর তাই বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি বা অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা বা স্বাস্থ্যবিমার মত প্রয়োজনীয় দাবি-দাওয়া পেশ হলেই মালিকেরা আপত্তি জানাতে থাকেন। বিড়ি শ্রমিক সংগঠক মহম্মদ আজাদ জানাচ্ছেন, রাজ্যে ২২ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক আছে। তার মধ্যে পিএফ আছে মাত্র ৩ লক্ষ ৬৮ হাজার শ্রমিকের। পিএফ না পাওয়ায় একটা বয়সের পর এঁদের অনাহারে মরতে হয়। অথচ রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। যদিও জানলে অবাক হবেন, বাংলার বিড়ি শিল্প থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার যৌথ ভাবে বার্ষিক জিএসটি আদায় করে ২৫০০ কোটি টাকা।

পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় বিড়ি কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ৯০টি। অন্তত ২০ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক কাজ করেন সেগুলিতে (কারখানা শ্রমিক ও বাড়ি থেকে কর্মরত শ্রমিক)। বাংলায় বিড়ি শিল্পের ‘হাব’ হল মুর্শিদাবাদ। আরও নির্দ্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলা যায় জঙ্গিপুর মহকুমার কথা । এই একটি মহকুমাতেই ১০টি বড়ো ফ্যাক্টরি ও ৫০টি ছোটো ফ্যাক্টরিতে প্রায় ১০ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক কাজ করেন। এঁদের হতদরিদ্র জীবনযাত্রা নিয়ে বহু লেখাপত্তর/অডিও/ ভিডিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইন্টারনেটে সমাজমাধ্যমে। কিন্তু এই সবকিছুকে চাপা দিয়ে দেওয়া হয় ‘বিড়ি শিল্পের সঙ্কট’ নামক একটা গুরুগম্ভীর আলোচনা দিয়ে! সেখানে সেই ঘুরে ফিরে আসে ‘নোটবন্দি-লকডাউন-জিএসটি’র চর্বিত চর্বন। ইদানীং তার সাথে যুক্ত হয়েছে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা ইত্যাদি।

অথচ বিড়ি শিল্পের মালিকদের আর্থিক উন্নতির গ্রাফ কিন্তু থামছে না। প্রত্যেকেই যে পরিমাণ সম্পত্তি বানিয়েছেন বিগত এক দশকে তা দেখে ‘যকের ধন’ বলে ভ্রম হতে পারে। মনেই হবে না ‘সাব অলটার্ন’ বিড়ি বেচে তদের জীবনে এত বড় টার্ন বা মোড় এসেছে। মুর্শিদাবাদ বাংলার বিড়ি শিল্পের ভরকেন্দ্র হওয়ায় বেশিরভাগ নামকরা ‘বিড়ি মার্চেন্ট’ও ঐ জেলার বাসিন্দা। তবে আরেকটি সমাপতনও আছে। এনারা প্রায় প্রত্যেকেই ওই মুর্শিদাবাদ জেলা থেকেই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ অথবা বিধায়ক।

যেমন ধরুন- তৃণমূল নেতা ও সুতি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস। ইনি জঙ্গিপুরের ঔরঙ্গাবাদে ‘জাহাঙ্গির বিড়ি’ ফ্যাক্টরির মালিক। তার কারখানায় দৈনিক দেড় কোটি টাকার বিড়ি উৎপাদন হয় বলে খবর রয়েছে। তার বিশাল কারখানা আর প্রাসাদোপম বাড়ি দেখলে কে বলবে বিড়ি শিল্পে সংকট চলছে।

আবার ধরুন ‘নূর বিড়ি’র মালিক খলিলুর রহমান। ইনি আবার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত তৃণমূল সাংসদও। তিনি আজকে ঘোষিত কোটিপতি! অঘোষিত সম্পত্তির কথা বা ওনার কোম্পানির সম্পত্তির কথা আর নাই বা বললাম! শুধু এটুকু জেনে রাখুন ওনার নূর বিড়ির কারখানায় কাজ করেন প্রায় ১৪ হাজার বিড়ি শ্রমিক।

অথবা আসা যাক জঙ্গিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তথা শিব বিড়ির মালিক জাকির হোসেনের কথায়। ইনি হলেন বাংলার বৃহত্তম বিড়ি মার্চেন্ট। তাঁর নির্বাচনী হলফনামার হিসেবে ঘোষিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মোট প্রমাণ ৪০ কোটি টাকার বেশি। তিনি তৃণমূলের ধনীতম বিধায়কদের একজন। তার কারখানার দৈনিক বিড়ি উৎপাদন ক্ষমতা ৫ কোটি টাকার বেশি। তিনি হলেন মুর্শিদাবাদ জেলার সর্বোচ্চ করদাতাও! সে কথা উনি বুক ঠুকে জাহিরও করে থাকেন। আর হ্যাঁ, এনার বাড়ি ও অফিসেই আয়কর দপ্তর গত বুধবার রেড করে নগদ ১৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছেন। এই টাকাটা সাদা না কালো সে বিচার আয়কর দপ্তর করবে, কিন্তু এত নগদ টাকা যার ব্যবসায় খাটছে সেই শিল্পপতির পয়সা নেই শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি দেওয়ার এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!

এইসব বিড়ি ব্যবসায়ীদের অনেকেরই আবার বিড়ির কারখানা ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল/নার্সিংহোম, স্কুল -কলেজ, চালকল ইত্যাদি নানাবিধ ব্যবসা রয়েছে যে গুলি হয়েছে মূলত বিগত ৫-৭ বছরে এই বিড়ি শিল্পের পয়সায় । যেমন জাকির হোসেনেরই রয়েছে নিজস্ব চালকল, বিএড কলেজ। কাজেই বিড়ি শ্রমিকদের দুর্দশা কতটা শিল্পের সঙ্কট আর কতটা মালিকদের তৈরি করা ‘ম্যানমেড’ ট্র্যাজেডি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

তার ওপর জাকির হোসেন নগদ ১৫ কোটি টাকা উদ্ধার হওয়ার পর যে নগদ ব্যবসায়িক কেনা-বেচার গাওনা গাইছেন তা আরও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল এবং তাঁর ও অন্যান্য বিড়ি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল। কারণ বিড়িতে জিএসটি চালু হওয়ার পর নগদে ব্যবসা করলে ঠিক কিভাবে জিএসটি দেওয়া হচ্ছে সে প্রশ্ন উঠবেই । আর আজকাল গ্রামের দিকে বেশিরভাগ মহিলার নিজের নামে অ্যাকাউন্ট আছে। কারণ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা কন্যাশ্রীর টাকা বা যাবতীয় সরকারি ভাতা/সুযোগসুবিধা এখন অনলাইনে সরাসরি উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে যায়। কাজেই বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রেও, যাদের একটা বড় অংশ মহিলা, এত নগদ টাকার প্রয়োজন পড়বার কথা নয়। যদিও আমরা এসবের মধ্যে ঢুকতে চাইছি না। সাদা-কালোর ব্যাপারটা আয়কর দপ্তর বুঝে নিক।

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস শুধু জানতে চাইছি, শাসকদলের টিকিটে জেতা বিধায়ক-সাংসদ-নেতা-মন্ত্রীরা যদি বিড়ি শিল্পের মালিক হন, তাহলে সেই সরকারের পক্ষে বিড়ি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করা আদৌ সম্ভব! তাই কি সরকার ঘোষিত ন্যুনতম দৈনিক মজুরিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বিড়ি শিল্পের মালিকেরা তার প্রায় অর্ধেক টাকায় ব্যবসার কাজে গ্রাম বাংলার মহিলাদের খাটিয়ে নিচ্ছেন!

সত্যিটা জানতে চায় বাংলা!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://nagorik.net/economics/biri-workers-in-dire-straits/
b) https://www.ganashakti.com/news/dhulian-biri-workers-conference
c) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-12-16/202212152311543.jpg&category=0&date=2022-12-16&button=
d) https://www.anandabazar.com/west-bengal/nadia-murshidabad/it-claims-that-they-have-recovered-huge-money-from-former-state-minister-jakir-hossains-place-at-murshidabad-dgtld/cid/1398913?utm_source=twitter&utm_medium=social&utm_campaign=daily
e) https://eisamay.com/west-bengal-news/bahrampur-news/beedi-workers-wage-increased-after-4-years-in-west-bengal/articleshow/86609277.cms