বিনাশের বিকাশ / The Joshimath Files

প্রখ্যাত মার্কিন সমুদ্রিক জীববিজ্ঞানী র‌্যাচেল কার্লসন বলেছিলেন, “মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ, এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ অনিবার্যভাবে নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।”

মাসখানেক আগে আমরা লিখেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ভয়াবহ গঙ্গা ভাঙন নিয়ে। বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক লাভ, সাথে বাহবা কুড়ানোর লক্ষ্যে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিকে বেঁধে ফেলার মাশুল আজ যেমন গুনতে হচ্ছে মালদহ, মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষকে। তেমনই হচ্ছে আজ যোশীমঠে। মনুষ্যসৃষ্ট ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের বোঝা আর নিতে পারছে না সে, তাই যোশীমঠ ভাঙছে। রোজ ভাঙছে।

উত্তরাখন্ডের যোশীমঠ, দেশের এক অন্যতম পর্যটনস্থল। বদ্রীনাথ, হেমকুন্ড সাহিব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স থেকে স্কি রিসর্ট আউলি, এদের প্রবেশদ্বার হেমকুন্ড। অলকানন্দার পাড়ের সেই ছোট্ট জনপদ আজ প্রবল সঙ্কটে।

কেন যোশীমঠ ভাঙছে?

যোশীমঠের ভাঙন আজ হঠাৎ শুরু হয়েছে এমনটা নয়। ইঙ্গিত আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল, তাই সেটাই খতিয়ে দেখতে প্রায় বছর ৫০ আগে, ১৯৭৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার গাড়ওয়ালের তৎকালীন কালেক্টর এমসি মিশ্রকে নিয়োগ করেছিলেন। সেই সময়কার ১৮ সদস্যের কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন, তাতে আজকের পরিস্থিতির পূর্ণ ছবি প্রকাশ পেয়েছিল। রিপোর্টে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা ছিল যে, যোশীমঠ একটি পুরানো ভূমিধস অঞ্চলে অবস্থিত এবং যদি অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন একটানা চলতে থাকে তবে এটি তলিয়ে যেতে পারে এবং যোশীমঠে নির্মাণ নিষিদ্ধ করারও সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! যতো বেশি পর্যটক, তত বেশি লাভ, তত বেশি টাকা।

সরকার আর ব্যবসায়ীদের লাভের গুড় খাওয়ার মাঝেই দেশ বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু যোশীমঠ আজ চরম বিপদের মুখে। যেকোন মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ধ্বসে যাবে যোশীমঠ। প্রকৃতির রোষে আতঙ্কের প্রহর গুনছেন বাসিন্দারা। ঘর-বাড়ি-ধর্মস্থানে দেখা দিয়েছে চওড়া ফাটল। রাস্তা হয়েছে দু’ভাগ। ভিটে ছেড়ে প্রাণভয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে মানুষ। কিন্তু এই বিপর্যয় আসবে তা অজানা ছিল কি?

“না না, কিছু হবে না”, এমন ভাবনা থেকেই বনাঞ্চল ধ্বংস করে তৈরি হচ্ছিল একের পর এক ইমারত। হোটেল থেকে উচু উচু আবাসন, এছাড়া ঘর বাড়ি, দোকানপাট তো আছেই। সব তৈরি হয়েছিল প্রশাসনের নাকের ডগায়, প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। আর সরকার, তারা তৈরি করেছে একের পর এক জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, পর্যটন প্রসারে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সম্প্রসারণ করেছে রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট ফাটিয়ে তৈরি হয়েছে একের পর এক টানেল। আর কত সইবে প্রকৃতি? তাই আজ সে পাল্টা দিয়েছে মরণ কামড়।

যার জেরে, প্রায় সাতশো বাড়িতে দেখা দিয়েছে ফাটল। বিপর্যয় নিয়ে মন্ত্রীসভায় বৈঠক ডাকা হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টে জরুরী আবেদন করা হলেও, কোর্ট শুনানিতে রাজি হয়নি। এখনো অবধি যা জানা যাচ্ছে, পরবর্তী শুনানি হবে ১৬ই জানুয়ারি।

উন্নয়নের ফিরিস্তি

কংক্রিটের জঙ্গল আজকের যোশীমঠ। প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছ অত্যাচারের ফল ফলছে। প্রকৃতি তাই আজ হাত তুলে নিয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রিনি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সুড়ঙ্গ খোঁড়ার জন্য এরকমটা ঘটছে, কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ হতে পারে না। এর সাথে যোগ হয়েছে দুর্বল মাটির ওপর পরিকল্পনাবিহীন নগরায়ন, ধারণক্ষমতার ওপর লোকের আবাস ও যাতায়াত, নর্দমা ও নিকাশী ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর অপ্রতুলতা। নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলায় মাটি হয়েছে নরম। সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে উন্মুক্ত হয়েছে মাটির তলায় থাকা অ্যাকুইফার। এর মধ্যেই চলছে চারধাম মহাসড়ক নির্মাণের কাজ। সব ট্রেক রুটকে নাকি পাকা গাড়ির রাস্তা করা হবে, আরো চওড়া করতে হবে রাস্তা…আরো…আরো। প্রকৃতি এই সব ভালো ভাবে নেয়নি, ইঙ্গিত সে আগে থেকেই দিচ্ছিল। আর মানুষের সাথে সাথে সরকারও ভেবেছিল, “ও কিচ্ছু হবে না।”

২০২১-এ ঋষিগঙ্গার ফ্ল্যাশফ্লাড বহু শ্রমিকের প্রাণ কেড়েছিল, তার আগে ২০১৩-তে কেদারনাথে সেই ভয়াবহ ফ্ল্যাশফ্লাড, তা ছাড়াও নির্বিচার গাছ কাটা নিয়ে স্থানীয়রা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন, সেগুলো আজ অনেকেরই মনে নেই। আর এখন যখন গোটা শহর ডুবতে বসেছে, তখন মানুষ প্রথামত চোখ মেলে দেখছেন, তার পরে একদিন ভুলে যাবেন।

প্রকৃতির অংশ মানুষ। লোভের তাড়নায়, মুনাফার জন্য প্রকৃতিকে ছিবড়ে করলে মানুষকে তার ফল ভুগতেই হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

শুধু কি যোশীমঠ?

শুধু যোশীমঠ নয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন যেখানেই হোক, সেখানেই প্রকৃতি সময়মত শোধ তুলবে। তা হতে পারে যোশীমঠ, হতে পারে দার্জিলিং, গ্যাংটক, উটি অথবা নৈনিতাল। অপরিকল্পিত নগরায়ন অবিলম্বে আটকাতে না পারলে প্রকৃতি যেদিন সত্যিকারের খেলে দেবে, সেদিন আর কিছুই করার থাকবে না।

যোশীমঠে যখন ভিটেমাটি ছেড়ে একরাশ অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে অন্যত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই নিতে হচ্ছে বাসিন্দাদের, তখন জানা যাচ্ছে কর্ণপ্রয়াগেরও বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে। নেমেছে ধস। বহুগুণা নগর এলাকায় প্রায় ৫০টি বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে, যার জেরে ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

তবে কেবল যোশীমঠ, কর্ণপ্রয়াগই নয়, এমন বিপর্যয় যে কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে উত্তরাখণ্ডের একাধিক এলাকায়। এমন আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অবিলম্বে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিলে ঘানসালি, মুন্সিয়ারি, ধারচুলা, ভাটওয়ারি, পাউরি, নৈনিতাল-সহ উত্তরাখণ্ডের বেশ কয়েকটি শহর বসে যেতে পারে।

কিন্তু কেন? এই প্রসঙ্গে হেমবতী নন্দন বহুগুণা গাড়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ এসপি সতী সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘ওই শহরগুলি থেকে ক্রমাগত ভূমিধসের খবর পাওয়া গিয়েছে। এলাকার ভৌগোলিক দিক বিবেচনা না করেই যত্রতত্র বহুতল নির্মাণ করা হয়েছে।’’

তাহলে সরকার কি করছিল এতদিন? প্রশ্নটা উঠবেই।

প্রশাসনের তরফে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

যোশীমঠের একাধিক বাড়ি, হোটেলে ফাটল দেখা দেওয়ার দরুন উত্তরাখণ্ড প্রশাসন বেশ কিছু বাড়ি ও হোটেল ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাতে বেঁধেছে গোল। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা জানিয়ে মঙ্গলবার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন যোশীমঠের বাসিন্দারা। “আগে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক, তার পর বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙুন” — এই দাবিই জানিয়েছেন তারা।

কোনো আগাম নোটিশ এবং ক্ষতিপূরণ না ঘোষণা করে কেন ঘরবাড়ি ও হোটেল ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল সরকার, সে নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীরা। ভাঙার কাজের জন্য হোটেলগুলিতে বিদ্যুতের লাইন আপাতত কেটে দেওয়া হয়েছে। যার জেরে অন্ধকারে ডুবেছে হোটেল সংলগ্ন এলাকার বাড়িগুলিও। এই মুহূর্তে যোশীমঠের প্রায় ৫০০টি বাড়ি বিদ্যুৎসংযোগবিচ্ছিন্ন।

শেষ খবর যা পাওয়া গেছে তাতে মোট ৮১টি পরিবারকে নিরাপদে অন্যত্র সরানো হয়েছে। যোশীমঠের প্রত্যেক নাগরিককে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিরাপদে স্থানে পৌঁছে দেওয়া এই মুহূর্তে এক বড় কর্তব্য। এখন শীতকাল, বর্ষার কিন্তু খুব একটা দেরি নেই।

শেষে একটাই কথা বলা যায়, নগর ভাঙলে দেবালয় যেমন রক্ষা করা যায় না, তেমনি “বিকাশ” বা “উন্নয়ণের” নামে প্রকৃতি ধ্বংস করার কর্মসূচি নেওয়া হলে, সভ্যতা অথবা অসভ্যতা, কোনটাই রক্ষা করা যায় না।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.amarujala.com/dehradun/joshimath-sinking-five-reports-and-five-reasons-real-reason
b) https://www.thehindu.com/news/national/other-states/joshimath-declared-landslide-subsidence-zone-plea-in-delhi-hc-to-constitute-probe-committee-rehab-residents/article66352945.ece
c) https://www.rediff.com/news/report/ntpc-denies-tapovan-hydel-project-link-to-joshimath-landslide/20230110.htm
d) https://www.cnbctv18.com/india/joshimath-1976-report-warned-that-village-was-on-ancient-landslide-human-activity-poses-danger-15610021.htm
e) https://www.firstpost.com/explainers/joshimath-landslide-subsidence-zone-residents-of-uttarakhand-town-11951692.html
f) https://www.msn.com/en-in/news/newsindia/tapovan-vishnugad-hydel-projects-tunnel-not-responsible-for-landslide-in-joshimath-ntpc/ar-AA168zeo
g) https://www.deccanherald.com/national/north-and-central/joshimath-ignored-warnings-and-a-brewing-crisis-1178834.html
h) https://www.latestly.com/india/news/joshimath-subsidence-supreme-court-refuses-urgent-listing-of-plea-on-uttarakhand-landslide-says-all-important-matters-need-not-come-to-it-4694198.html
i) https://www.news18.com/news/explainers/sinking-joshimath-is-built-old-landslide-shocking-facts-50-year-old-warning-explained-6761575.html