হুঁজুর! দুয়ারে ক্ষেতমজুর! / Field Laborer in Bengal

আগামী ৬ই জানুয়ারী ২০২২।
মানে সামনের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার।

তদ্দিনে আশাকরি আমাদের সবার বড়দিন থেকে বর্ষবরণের যাবতীয় ফুর্তিফার্তা উৎসবের আদিখ্যেতা শেষ হয়ে যাবে। বউ-বাচ্চাকে নিয়ে চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়া অথবা বিড়লা তারামন্ডলে নিয়ম মাফিক বাৎসরিক ঢুঁ-মারাটাও হয়ে যাবে! রেডওয়াইন বা হুইস্কি-রামের সাথে কেক-পেস্ট্রি-পাস্তা-পিৎজা পেঁদানো শেষ করে খেজুড়ে গুড়, চালের গুঁড়ো আর নারকোল মালা জোগাড়ের হিড়িক পড়ে যাবে বাড়িতে বাড়িতে। সমাজের প্রোথিতযশারা টিভির পর্দায় অথবা কাগজের পাতায় তাঁদের বর্ষবরণ কিম্বা পৌষপার্বণের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসবেন!

আর সোয়েটার-শাল গায়ে এমন হ্যাপি গো লাকি ফিল গুড আমেজের ওম নিতে ব্যস্ত মহানগর ঐ ৬ই জানুয়ারী সাক্ষী হবে এই বাংলারই একদল আনহ্যাপি মানুষের জমায়েতের। অবশ্য সাক্ষী হবে এমনটা জোর গলায় বলতে পারছি না। কারণ আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে মুলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমগুলি এমন জমায়েতকে ক্যামেরাবন্দী বা পাতাবন্দী করতে চাইবে না। এর যদি একটা কারণ হয় এরা সমাজের উপান্তে বসবাসকারী প্রান্তিক ক্ষেতমজুর তবে আরেকটা কারণ হল এদের হাতে থাকবে লাল ঝান্ডা! এরা বামপন্থী। আর এইসব উপেক্ষিত অপাংক্তেও মানুষের হয়ে গলা ফাটানো কলম চালানোর জন্যই রাইস অফ ভয়েসেস এর জন্ম! তাই আজ বাংলার খুঁটিনাটিতে এবারের কিস্তি জুড়ে বাংলার ক্ষেতমজুরদের কথা!

তবে শুরুতেই যেটা আমাদের জেনে নেওয়া জরুরি সেটা হল কৃষক আর ক্ষেতমজুর এক জিনিষ নয়। সরকারী সংজ্ঞা অনুযায়ী কৃষক হল কৃষিজমির মালিক। সে তারা নিজেরা হাতে কলমে সে জমিতে চাষ করুক অথবা অন্যকে দৈনিক মজুরি দিয়ে চাষ করাক! আর এই নিয়মের কারণেই অমিতাভ বচ্চন থেকে খগেন রুইদাস দুজনেই চাষী। একটু খেয়াল করে দেখবেন সরকারের তরফে যাবতীয় আর্থিক সুযোগ সুবিধা একর প্রতি জমির পরিমাণ হিসেবে ঘোষণা করা হয় যা সরসারি পকেটে ঢোকে এই কৃষি জমির মালিকের! কিন্তু যারা এই মালিকের জমিতে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাষ-আবাদ করেন বা মজুর খাটেন তাদের কপালে এসব সরকারী সুবিধের ছিটেফোঁটাও যায় না। ক্ষেতমজুর হল সেইসব হতভাগার দল! এদের সহায় সম্বল বলতে দিনের শেষে প্রাপ্ত ঐ মজুরিটুকু। বাংলায় এই মুহুর্তে একজন ক্ষেতমজুরের দৈনিক মজুরি মাত্র ২৬৪ টাকার আশপাশে থাকে! যেখানে জাতীয় গড় ৩১৫ টাকা ৩০ পয়সা।

এটা শুনে যারা “বেগম” বলে গাল পাড়বার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন তাদের জানিয়ে দিই ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যেই ক্ষেতমজুরদের মজুরি জাতীয় গড়ের থেকে কম। গুজরাট বা মহারাষ্ট্রের মত শিল্পোন্নত রাজ্য গুলিতে দৈনিক মজুরি যথাক্রমে ২৩৯ টাকা এবং ২৬২ টাকা যা বাংলার থেকেও কম। উত্তরপ্রদেশে সামান্য বেশি ২৮৬ টাকা আর বিহারে ২৮৯ টাকা। সব থেকে বেশি মজুরি পান কেরলের গ্রামীণ এলাকার মজুর-শ্রমিকেরা। এদের দৈনিক মজুরি থাকে ৬৭৭ টাকার আশেপাশে। তারপর রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর (৪৮৩ টাকা), তামিলনাড়ু (৪৪৯ টাকা), হরিয়ানা (৩৮৪ টাকা) এবং পাঞ্জাব (৩৪৪ টাকা)। এই সর্বভারতীয় অবস্থাটা দেওয়া হল এই কারণে যাতে বুঝতে সুবিধা হয় জাত-ধর্ম নির্বিশেষে এই গ্রামীণ ক্ষেতমজুর সম্প্রদায় বাম শাসিত কেরালার মত হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে প্রায় সর্বত্রই উপেক্ষিত এবং অবহেলিত। যদিও সামাজিক বিন্যাস করলে এদের বেশিরভাগই তফসিলি জাতি- উপজাতি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত!

এখন মনে রাখতে হবে কৃষিকাজ মরশুমি। ফলে সারাবছর কাজ পাওয়া যায় না। বাংলায় এক একজন ক্ষেত মজুরের গড়ে কাজ জোটে বছরে কম বেশি ৪০ দিন। ফলে বছরের বাকি দিনগুলো গুজরানের জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় ১০০ দিনের কাজে এবং অন্যত্র কোন অ-কৃষিক্ষেত্রের ওপর! আমাদের রাজ্যে এই মুহুর্তে ১০০ দিনের কাজের আইনে, যা কিনা ঐ লাল ঝান্ডার লড়াই করে পাওয়া আইন, কাজ পাওয়া যায় ৩৫ -৪০ দিন যদিও আইনি কাজ পাওয়ার অধিকার ১০০ দিনের। ফলে বেশিরভাগ গ্রামীণ মজুর- খেতমজুর পরিবারের হাতে বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে কৃষিক্ষেত্র এবং ১০০ দিনের কাজ ও ছুটির দিন বাদ দিলে গড়পড়তা ২৫০ দিন কোন কাজ থাকে না। কিন্তু উনুনে হাঁড়ি চড়াতে হয় ৩৬৫ দিন। আর তাই বাধ্যহয়ে কাজের খোঁজে গাঁ-উজিয়ে মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দেয় ভিনরাজ্যে ভিনদেশে! কাজ করে নানা রকমের অ-কৃষিক্ষেত্রে। মানে একই গ্রামীণ প্রান্তিক পরিবারের লোকেরা বছরের বিভিন্ন সময় কখনও ক্ষেতমজুর, কখনও ১০০ দিনের কাজ করে, আবার কখনও পরিযায়ী শ্রমিক।

এতটা পড়ে যারা দাঁতখড়কি দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে মাছ-মাংসের টুকরো বার করতে করতে ভাবছেন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন “২০২১ এর এমন হ্যাপি এন্ডিং-এর মুহুর্তে সাপে কামড়ানো সলমন বা কুলতলির বাঘের মত থ্রিলিং টপিক থাকতে আমরা কেন চাষাভুষাদের নিয়ে পড়লাম! আমরা কি ছিপিএম, মানে লাল ঝান্ডা পার্টি!” তাদের জানিয়ে রাখি ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী রাজ্যে ১ কোটিরও বেশি গ্রামীণ মজুর -ক্ষেতমজুরের বাস যা বিগত তিন বছরে আরও বেড়েছে বৈ কমেনি। মানে রাজ্যের কমবেশি প্রায় ১০% মানুষ হলেন এই মজুর- ক্ষেতমজুর শ্রেনীভুক্ত। আর প্রথম সাত বছরের তৃণমূল সরকারের আমলে এই সংখ্যাটা বেড়েছে প্রায় ২৮ লক্ষের ওপর। মানে মা-মাটি-মানুষের সরকারের প্রথম সাত বছরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১০০ মানুষ নতুন করে ক্ষেতমজুরের খাতায় নাম লিখিয়েছেন । যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৯% এর আশপাশে সেখানে ক্ষেতমজুরের সংখ্যা বেড়েছে ৩৮% অর্থ্যাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চারগুণ। আর এভাবে চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ না হলেও ক্ষেতমজুরদের আঁতুড়ঘর হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এমন একটা বৃহৎ অংশের মানুষের হয়ে কথা বলতে টেকনিকালি কোন ঝান্ডার প্রয়োজন পড়বার কথা নয় ! এই যে প্রয়োজন পড়ছে এটাই লজ্জার কারণ হওয়া উচিৎ!

গ্রাম বাংলায় মজুর-ক্ষেতমজুরদের সংখ্যার এই আকস্মিক বৃদ্ধির একটা কারণ যদি এটা হয় যে বহু ক্ষেতমজুর পরিবারের ছেলেমেয়েরা বছরের বিভিন্ন সময় অ-কৃষিক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজকর্মে যুক্ত হওয়ায় তাদেরকে ক্ষেতমজুর গণনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে তবে আরেকটা কারণ হল জমি-জমা হারিয়ে কৃষকের ক্ষেতমজুরে পরিণত হওয়া। এখন তৃণমূল আমলে কৃষকের জমি হারিয়ে ক্ষেতমজুরে পরিণত হওয়ার পদ্ধতিটা বেশ গোলমেলে! শাসকের দলবাজি ও দাপাদাপিতে অনেক কিছুর মত গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে এমনটাই অভিযোগ রয়েছে! আর সরকারী ব্যবস্থাপনায় ঋণ পেতে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা ও শাসকের কাটমানি- কমিশনরাজ। ফলে কৃষক পরিবারের অনেকেই চাষাবাদের কাজে বা বাড়ির মেয়ে-বউরা নানা স্বনির্ভরগোষ্ঠীর কাজে বাধ্য হচ্ছেন চড়া সুদে স্থানীয় মহাজন কিম্বা বিভিন্ন মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার থেকে ঋণ নিতে। বন্ধক রাখছেন জমি। এদিকে সারের কালোবাজারি অথবা ফসলের ন্যয্য মূল্য না পাওয়ার কারণে একদিকে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত মানুষের লভ্যাংশে টান পড়ছে। অন্যদিকে বন্যায় ঘরবাড়ি জমিজমা প্লাবিত হওয়ায় বা নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ায় এদের অনেকেই হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। ফলে নেওয়া ঋণ সময় মত ফেরত দিতে পারছেন না। যাদের জমি বন্ধক রয়েছে তাদের জমি হাতছাড়া হচ্ছে আর যাদের জমি বন্ধক নেই তারা সেই নিজস্ব জমি-জিরেত বেচে ঋণ মেটাচ্ছেন। কৃষক থেকে বনে যাচ্ছেন ক্ষেতমজুর। গত একদশকে গ্রাম বাংলায় কৃষকের সংখ্যা হ্রাস এবং ক্ষেত মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধির এই ছবিই বাংলার কৃষি সঙ্কটকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। অথচ কতৃপক্ষ দেখেও দেখছেন না। জিনিষপত্রের অগ্নিমুল্যে ঘরে উনুন জ্বালাতে উঠছে নাভিশ্বাস। মহামারীর কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বাড়ির শিশুরাও এখন ক্ষেতমজুরি করতে শুরু করেছেন দু-পয়সা রোজগারের জন্য। বেড়ে গেছে কম বয়সই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা! অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। মানে দেখতে গেলে ধ্বসতে শুরু করেছে আস্ত গ্রামীণ সমাজটাই!

আর এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং দুর্বিসহ সরকারী ঔদাসীন্যের প্রতিবাদে আগামী ৬ ই জানুয়ারী নবান্নের নাকের ডগায় রানী রাসমণি রোডে দুপুর একটায় বামেদের নেতৃত্বে একগুচ্ছ দাবি দাওয়া নিয়ে বাংলার ক্ষেতমজুররা জড়ো হবেন। আগেই বলেছি মূলস্রোতের মিডিয়ায় এসব খবর হয়তো আসবে না বা এলেও ভেতরের পাতার এক কোণে ছোট একটা কলাম লিখে তারা হাত ধুয়ে ফেলবে।

তাই রাইস অফ ভয়েসেস এর তরফে আপনাদের আগাম জানানো হল। পারলে ঐদিন বিকল্প মাধ্যমের দেওয়াল গুলোতে একটু চোখ রাখবেন। আর মনে রাখবেন ঐ জড়ো হওয়া হাজারি দশ হাজারি কিম্বা একলাখি ক্ষেত মজুরের ভিড়টাও আমাদের রাজ্যের বাসিন্দা! এরাও বাঙালী! ওদের অভাব-অভিযোগ জানা এবং ওদের রোজকার লড়াইয়ের পাশে থাকা আমাদের সামজিক কর্তব্য যা শুধু দু একটা ট্যুইট বা ফেসবুক পোস্ট করে সেরে ফেলা যায় না! ওদের হয়েও প্রকাশ্যে গলা ফাটাতে হয়! মনে রাখতে হবে নিজের নিজের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা গুলোকে শুধু নিজের বাড়ির বিজলি-সড়ক-পানির মধ্যে আটকে না রেখে নিজের পাড়ার নর্দমা পরিষ্কার বা জলনিকাশিতে ঘুরপাক না খাইয়ে অপরিচিত ক্ষেত মজুরদের হয়ে গলা তুলে তাদের দাবিদাওয়া গুলো শাসকের দিকে বা শাসক আশ্রিত সংবাদ মাধ্যমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চিন্তাভাবনাগুলোর স্বার্থকতা খোঁজাও জরুরি।

তথ্যসুত্র
a) https://indianexpress.com/article/business/rural-wages-kerala-tops-list-15-states-lag-national-average-7649853/?fbclid=IwAR1jP8aAzjJp2_kgDyrrhPyLhdgda4wnlvxrJUDJXGUHNRjog8okgAjoyb4
b) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-28/202112272325273.jpg&category=0&date=2021-12-28&button=