মজুরি ও মজবুরি / Handbook Of Statistics on Indian States by RBI

সম্প্রতি বীরসা মুণ্ডার জন্মদিন উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমে সব থেকে বেশি ফুটেজ খেলেন রাজ্যের শাসক ও বিরোধীদলের নেতা-নেত্রীরা!

অবস্থা এমনই যে আপামর বঙ্গবাসীকে বীরসা মুণ্ডার কোন ছবি দেখালে হয়তো তাঁকে চিনতে পারবে না, কিন্তু তার জন্মদিন উপলক্ষে চপ ভাজলো কে, তা বাঙালী জানে! আদিবাসী সদ্যজাতকে কোলে নিলেন কে বাঙালী জানে! এমন কি আদিবাসী উঠোনে পাত পেড়ে ভাত খেলো কে তাও বাঙালী জানে! শুধু বীরসা মুণ্ডা কে জিজ্ঞেস না করলেই হলো! কারণ তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে তিনি বাদে বাকি সবকিছুই খবর! সংবাদমাধ্যমের কেউ কেউ আবার আদিবাসীদের নিয়ে শাসক ও বিরোধীদলের যুগলবন্দীতে নির্মিত হঠাৎই এমন একদিনের আদিখ্যেতাকে ‘আদিবাসী ভোটে শান দেওয়া’ বা ‘নিবিড় আদিবাসী জনসংযোগে’র মত ইতিবাচক আঙ্গিকে পরিবেশনও করে ফেললেন। মানে গ্রাম-গরীব-আদিবাসী, এক ঢিলে তিন পাখি মেরে দেওয়ার চেষ্টা আর কি!

কিন্তু সত্যি কি মারা গেল! নাকি আদি অনন্তকাল ধরে মরে চলা গরীব জনতা এখনও রুটি-রুজির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে মরছে। এসব বুম-ক্যামেরার দাপাদাপি তাদের কাছে ‘এক রাত কি চাঁদনি’র মত! কিন্তু সেসব কথা জানবেন কি করে! কারণ সংবাদমাধ্যম তো তা জানাচ্ছে না! তাহলে উপায়! উপায় আছে। আর সেই পথের সন্ধান দিতেই তো রাইজ অফ ভয়েসেস জন্মেছে। গত ১৯ শে নভেম্বর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রতি বছরের মত এবছরেও ‘হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিস্টিক্স অন ইন্ডিয়ান স্টেটস’ প্রকাশ করেছে। আর সেখানেই উঠে এসেছে আরও অনেক তথ্যের পাশাপাশি দেশের ২০টা রাজ্যের দিন আনা দিন খাওয়া প্রান্তিক মানুষগুলোর মজুরি ও মজবুরির বাস্তবচিত্র! আর সেখানেই আমাদের রাজ্য, গরীব মানুষগুলোর রুটি-রুজির সন্ধান দিতে পারার নিরিখে দেশের আর-পাঁচটা রাজ্যের থেকে ঠিক কতখানি এগিয়ে বা পিছিয়ে পাওয়া গেছে, তার সুলুক সন্ধানও। তারজন্য ক্যামেরা বুম হাতে নেতাদের পেছনে ছুটোছুটি করবার দরকার নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে গেলেই হবে। অথচ কোন অজ্ঞাত কারণে সেই খবরটাই প্রকাশিত হওয়ার পর দুদিন কেটে গেলেও কোন প্রথম শ্রেণীর সংবাদমাধ্যম আপনাদেরকে দেয়নি। তাই ভাবলাম আমরা দিয়ে দিই।

এ প্রসঙ্গে শুরুতেই জানিয়ে রাখি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই প্রথম তাদের রিপোর্টে নির্মাণ শ্রমিক, ক্ষেত মজুর এবং অকৃষিক্ষেত্রে জড়িত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির তথ্য তুলে ধরেছে। রিপোর্ট বলেছে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে বাংলার ক্ষেতমজুরদের দৈনিক মজুরি হল ৩০৫ টাকা ৩০ পয়সা, যা জাতীয় গড় ৩২৩ টাকা ২০ পয়সা থেকে অনেকটাই কম। দেশের ২০ টা রাজ্যের মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলার স্থান ১২ নম্বরে। এই স্থান আদৌ গৌরবজনক কি না সে বিচার আপনারা করবেন। শুধু এই সূত্রে জানিয়ে রাখি গুজরাটে এই দৈনিক মজুরির হার মাত্র ২২০ টাকা ৩০ পয়সা। মানে বাংলার অনেক পিছনে। আর বাম শাসিত কেরল প্রথম যেখানে একজন ক্ষেতমজুর আয় করেন ৭২৬ টাকা ৮০ পয়সা।

এবার আসা যাক নির্মাণ শ্রমিকদের ২০২১-২২ অর্থবর্ষের দৈনিক মজুরির খতিয়ানে। বাংলার নির্মাণ শ্রমিকেরা এই মুহুর্তে দৈনিক ৩৩৩ টাকা ৪০ পয়সা মজুরি পান যেখানে জাতীয় গড় ৩৭৩ টাকা ৩০ পয়সা। এক্ষেত্রেও কেরল দেশের মধ্যে প্রথম, যেখানে একজন নির্মাণ শ্রমিক দৈনিক ৮৩৭ টাকা ৭০ পয়সা আয় করেন। আর গুজরাটে সেই মজুরিটা অনেকটাই কম। মাত্র ২৯৫ টাকা ৯০ পয়সা। ২০ টা রাজ্যের মধ্যে বাংলার স্থান ১৫ আর গুজরাটের স্থান ১৯।

কৃষিকাজ এবং নির্মাণ শিল্পের বাইরে শিল্পক্ষেত্রে মজদুরি করা শ্রমিকদের চিত্রটাও আগের গুলোর মতই, অনেকটা একই। শুধু সংখ্যার সামান্য হেরফের। আমাদের রাজ্যের দৈনিক মজুরি যেখানে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ৩০৫ টাকা ৮০ পয়সা সেখানে জাতীয় গড় ৩১৫ টাকা ৩০পয়সা। গুজরাটের শ্রমিকরা পান মাত্র ২৩৯ টাকা ৩০ পয়সা। দেশের ২০ টা রাজ্যের মধ্যে বাংলার স্থান আট নম্বরে। আর কেরালা ফের প্রথম। সেখানে একজন শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিক দৈনিক মজুরি পান ৬৭৭ টাকা ৬০ পয়সা।

এমনকি বেকারত্বের হারও বাংলায় ক্রমশঃ উর্ধমুখী। গ্রামাঞ্চলে নারী-পুরুষদের মিলিয়ে বেকারত্ব ২০০৯-১০ সালে যেখানে ছিল প্রতি ১০০০ জনে ১৯ জন, সেটাই ২০২০-২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩২-এ। শহরাঞ্চলে সেই সংখ্যাটা ৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৪। অথচ লক্ষ করলেই দেখা যাবে বাম আমলের শেষ দশ বছর সময়কালে বেকারত্বের হার শহর এবং গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই ধারাবাহিক ভাবে কমছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পালা বদলের পর শহরের ক্ষেত্রে তা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে এবং কিছুটা হলেও উর্ধমুখী। আর গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার বিগত এক দশকে হু-হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ওপরের এই তথ্যগুলোই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কেন গ্রাম বাংলার একটা বড় সংখ্যক মানুষ আজ পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন বেছে নিয়েছে। অপ্রতুল দৈনিক মজুরি আর কাজ না পাওয়ার মজবুরি, এই উভয় সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েই তারা একরকম বাধ্য হয়েছেন পরিবার পরিজনকে গ্রামে ফেলে মজদুরি করতে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে।

সামনেই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। এমন জ্বলন্ত ইস্যু সংবাদমাধ্যম সামনে আনবে কি না জানি না। তবে আমাদের মনে হয় আনা হবে না। কারণ এই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট জনসমক্ষে চলে এলে এবং তা নিয়ে চর্চা শুরু হলে বাংলার শাসক ও প্রধানবিরোধী উভয়ই বিপদে পড়বে। গুজরাট মডেল চকচকে মলাটে মোড়া জরাজীর্ণ পান্ডুলিপি কি না সে প্রশ্ন যেমন উঠবে তেমনই এর পাশাপাশি তৃণমূল সরকারের বিগত এক দশক শাসণকালের কঙ্কালসার চেহারাটাও সামনে চলে আসবে। বর্তমান বাংলার সংবাদমাধ্যম সেই সৎ সাহসটা দেখাতে পারবে কি না সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।

কিন্তু রাইজ অফ ভয়েসেসের কাউকে খুশি করবার মজবুরি নেই। আমাদের মনে হয়েছে বাংলার অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার হাল হকিকত বুঝতে গেলে এই তথ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://www.rbi.org.in/Scripts/AnnualPublications.aspx?head=Handbook%20of%20Statistics%20on%20Indian%20States