বেহাল লাইব্রেরি / First Free Public Library Of India
আমাদের কাছে হঠাৎ একদিন খবর এলো উত্তরপাড়ার বিখ্যাত জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি বন্ধ হতে বসেছে! তারপর গত সপ্তাহে একজন জানালো আর হতে বসেছে নয়, বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে এখন রাজ্য সরকারের নানা রকম সামাজিক প্রকল্পের প্রচারমূলক ক্যাম্প চলে।
এখন যারা ভাবছেন এ আর এমন কি? তাদের উদ্দেশ্যে জানাই এই জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি আর পাঁচটা পাড়ার গ্রন্থাগার নয়। এটি এশিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিগুলির মধ্যে একটি। হুগলি নদীর তীরে একটি ছোট্ট শহর উত্তরপাড়াতে গঙ্গার তীরবর্তী ভূখণ্ডে এই গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৮৫২ সালে এই গ্রন্থাগারটি জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এটি হলো ভারতের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি । সম্ভবতঃ এশিয়ারও।
গঙ্গার তীরে বাঁধানো ঘাট, বিশাল খেলার মাঠ সমন্বিত বহুতল এই গ্রন্থাগারটির এই পরিকাঠামো আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারের সমতুল।
তবে উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরিতে শুধু বইয়ের স্তূপ ছিল না। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির মিলনস্থল ছিল এই স্থানটি। তাঁরা আসতেন, থাকতেন, পড়তেন, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলত। ১৮৬৬ সালে বিদ্যাসাগর এই লাইব্রেরীতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মেরি কারপেন্টারকে সঙ্গে নিয়ে। কিছুকাল পরে যখন তাঁর বই “Six months in India” প্রকাশিত হয়, সেখানে এই লাইব্রেরীর একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। মিস কারপেন্টারের ভাষায়, “বাড়িটির নিচের তলায় ছিল গ্রন্থাগার, এবং উপরের তলার ঘরগুলি বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের (ভিজিটর) থাকার জন্যে এবং সভাসমিতি করার জন্যে রাখা হয়েছিল। আর অতিথিদের তালিকাটি দেখলেও চমকে যাবেন অনেকে। কে নেই সে তালিকায়। বিদ্যাসাগরের কথা তো বলেইছি। তাছাড়াও মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬৯ এবং ১৮৭৩ সালে দুবার পরিবারসহ মাসাধিক কাল কাটিয়ে গেছেন। এসেছেন স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার, জন এইচ এস কানিংহাম, রেভারেন্ড জেমস লং, স্যার আর্থার ওয়েলেসলী, স্যার অ্যাসলী ইডেন, স্যার এডুইন আর্নল্ড, স্যার রিভারস থম্পসন, মারকুইস অব ডাফরিন এবং আভা ডাফরিন এর মত বই পিপাসু বিদেশী জ্ঞানী গুণিজন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জ্জী, কেশবচন্দ্র সেন এবং বিপিন চন্দ্র পালের মত স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও পদধূলি পড়েছে এই গ্রন্থাগারে। ১৯০৯ সালে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দও এসেছেন। বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ তাঁর বিখ্যাত “উত্তরপাড়ার ভাষণ” এই লাইব্রেরি র মাঠে দাঁড়িয়েই দিয়েছিলেন। এমন কি ডোভার লেনের পর বাংলার সব থেকে বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাৎসরিক আসরও বসে এই লাইব্রেরির মাঠে।
ঘটনাচক্রে এই প্রতিবেদনের লেখকের শিশুকালের কিছুটা সময় কেটেছে উত্তরপাড়াতে। ফলে আপামর উত্তরপাড়াবাসীর মত তারও আবেগ জড়িয়ে আছে জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির সাথে। শুধু গ্রন্থাগার নয়, লাইব্রেরির মাঠ এবং বাঁধানো গঙ্গার ঘাট হল তার শৈশবের নস্টালজিয়ার অন্যতম।
১৯৬৪ সালে লাইব্রেরিটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করে। তারপরেও এই সেদিন পর্যন্ত লাইব্রেরিটি চলেছে রমরম করে। বাম আমলে লাইব্রেরিটির দেড়শো বছর উদযাপনও হয়েছে ধুমধাম করে। আর সেই লাইব্রেরিটি কি না বিগত কয়েক বছরে যথাযথ সরকারি সহায়তা না পেয়ে কর্মী/লাইব্রেরিয়ানের অভাবে, বই সংরক্ষণের অপ্রতুলতার কারণে ধুঁকতে ধুঁকতে বন্ধ হওয়ার মুখে। এখন সেখানে চলছে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের প্রচারমূলক ক্যাম্প অফিস।
একটু তত্ত্ব তল্লাশ করতেই বেরিয়ে এল রাজ্যজুড়ে চলা গ্রন্থাগারগুলির কঙ্কালসার চেহারাটা। বস্তুত এই খন্ডচিত্র শুধু উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ গ্রন্থাগারের নয়, এটাই এখন রাজ্যের সার্বিক ছবি। বহু গ্রন্থাগারে কর্মীর অভাবে শুধু তালাই পড়েনি, কোথাও স্রেফ একজন নিয়ে বন্ধের দিন গুনছেন কতৃর্পক্ষ। কোথাও আবার অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক নেহাতই বিবেকের তাড়ণায় বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে লাইব্রেরিটি চালু রেখেছেন। কারণ তার জায়গায় নতুন কর্মীর নিয়োগ হয়নি।
বাম আমলের শেষের দিক থেকেই অবশ্য গ্রন্থাগারগুলোর প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব দেখা দিতে থাকে। তবে তার কারণ ছিল মূলত রাজনৈতিক পালা বদলের হাওয়া ওঠার কারণে তৈরি হওয়া প্রশাসনিক স্থবিরতা! সরকারি বা প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবকে সেভাবে দায়ী করা যায় না। কিন্তু এই মুহুর্তে রাজ্য জুড়ে গ্রন্থাগারগুলোর যা অবস্থা তাতে কিন্তু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই কাঠগড়ায় তুলতে হবে। একথা কেন বলছি, একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাম আমলে রাজ্যে কর্মীর অভাবে যেখানে অন্তত ৯০টি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেখানে পরিবর্তন বা রাজনৈতিক পালা বদলের পর বিগত এক দশকে সেই সংখ্যাটা ঠেকেছে ১২০০ তে। অন্তত রাজ্য গ্রন্থাগার দফতর সূত্রে খবর তেমনই। আর আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করি ৯০ আর ১২০০ সংখ্যা দুটির মধ্যে কোন তুল্যমূল্য বিচার চলে না।
কিন্তু এখানে আমরা পাশাপাশি মনে করিয়ে দিতে চাই ১২০০ সংখ্যাটির একটা অন্য তাৎপর্য আছে। রাজ্য সরকারের তত্বাবধানে সারা রাজ্যে প্রায় ২৪৮০টি গ্রন্থাগার ছিল বলে গ্রন্থাগার দপ্তর সূত্রে খবর। তার মধ্যে ১২০০টিরও বেশি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানে বর্তমান সরকারের জমানায় রাজ্য সরকারের অধীনস্থ প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি গ্রন্থাগারে তালা পড়েছে। আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করবার মত। গ্রন্থাগারগুলিতে গ্রন্থাগারিকসহ অন্যান্য সহকারি কর্মীদের শূন্যপদগুলির কমবেশি ৪৫% পদ পরিবর্তনের জমানায় শুরু থেকেই সব সময় খালি রয়ে গেছে। নিয়োগ হয়নি। ফলে তৃণমূল সরকারের আমলে কমবেশি ৫০% গ্রন্থাগার যে বন্ধ হয়ে যাবে কর্মীর অভাবে, তাতে আর আশ্চর্য্যের কি! কিন্তু যেটা আশ্চর্য্যের সেটা হলো খুঁড়িয়ে চলা বাকি গ্রন্থাগারগুলির অধিকাংশই এখন ‘বাংলা সহায়তা কেন্দ্র’। দুর্ভাগ্যের কথা হলো এই দ্বিতীয় ক্যাটিগরিতে পড়ছে উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির মত ঐতিহ্যশালী গ্রন্থাগার, যেটিকে কিনা এক সময় রাজ্য সরকারের তরফে জাতীয় হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণার জন্য তদ্বিরও করা হয়েছিল।
আরও শুনবেন! তা প্রায় দু বছর হতে চলল অর্থ দফতরের সবুজ সঙ্কেত পেয়েও বিভিন্ন জেলায় সরকার পোষিত গ্রন্থাগারগুলিতে ৭৩৮টি শূন্য পদে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের কাজ ঝুলে আছে। কথা ছিল ‘সার্চ কমিটি’ বা সন্ধান কমিটি গঠন থেকে মূল তালিকা প্রকাশ পর্যন্ত পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার কথা ছিল চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে। কিন্তু মাসের পর মাস পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, গ্রন্থাগার দফতর এখনও সেই সন্ধান কমিটিই গড়ে তুলতে পারেনি বলে অভিযোগ। এটিকে কি বলবেন! সদিচ্ছার অভাব বলবেন না! এমনকি রাজনৈতিক বিরোধীদের অনেকে এর পেছনে বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্রন্থাগারের জমি-বাড়িগুলির ওপর শাসক ঘনিষ্ঠ সিণ্ডিকেট রাজের নজর রয়েছে বলে মনে করছে। পাহাড়-নদীর চর বা জঙ্গল যেখানে মাফিয়াদের হাতে চলে যাচ্ছে সেখানে জেলার কোন এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রন্থাগারের বাড়ি-জমি কি আর এমন বড় ব্যাপার! আপনি আমি জানতেও পারবো না। নেতাদের বাকযুদ্ধ-কুকথার চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো এবং নিজেকে সবজান্তা ভাববো।
এখন আমরা যারা হঠাৎই ট্যুইটার স্যাভি, ফেসবুকপ্রেমী হয়ে পড়েছি তারা কি শুধু “বুক” মানে বইয়ের কদর করতে ভুলে গেলাম! রাজ্য সরকারের তরফে যথাযথ কর্মী /গ্রন্থাগারিক নিয়োগ না করে জেলায় জেলায় লাইব্রেরি গুলোর হাতপায়ে বেড়ি পরিয়ে যেভাবে চূড়ান্ত অবহেলায় অব্যবস্থায় ফেলে রাখা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আমরা কোন কথা কি বলবো না! সরকারি পারিতোষিকে তুষ্ট বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে মঞ্চ আলো করে বসে থাকা কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদেরাই বা গেলেন কই! মুখ খুলুন!
এখনও আমরা সবাই যদি মুখ না খুলি, আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারবো তো!
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্রঃ
a) https://www.anandabazar.com/west-bengal/lack-of-staff-at-public-library-1.181334
b) https://www.anandabazar.com/west-bengal/no-recruitments-have-done-in-the-government-libraries-in-west-bengal-despite-the-notification/cid/1385625
c) https://www.telegraphindia.com/west-bengal/open-state-owned-libraries-for-dusting-bengal-government/cid/1791818
d) https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/state-sponsored-libraries-in-shutdown-mode/articleshow/50903979.cms
Comments are closed.