মন্ত্রীমশাই / The Pramanik Files

গতকাল সারাদিন ধরে টিভি-ক্যামেরা বুম নিয়ে যেভাবে চপ ভাজা হল, মাটির বাড়ির উঠোনে পাত পেড়ে খাওয়া হল অথবা গাঁয়ের সদ্যজাতকে কোলে তুলে দোল খাওয়ানো হল এবং দিনের শেষে সেটাকে আমাদের সংবাদমাধ্যমের বন্ধুরা জনসংযোগ বলে চালিয়ে দিলেন, তাতে এখন আর আমরা অবাক হই না। কারণ নেতা ফুটেজ খাবেন আর মিডিয়া ফুটেজ খাওয়াবে এটাই এখন খবর-সাংবাদিকতার দস্তুর।

ফলে এই খাওয়া-খাওয়ির দুনিয়ায় ইদানীং অনেক চাঞ্চল্যকর খবরই আমরা সেভাবে পাচ্ছি না। কোন কোন সংবাদমাধ্যম ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মত খবরটি দায়সারা ভাবে ছোট করে দেখিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ আবার ভেতরের পাতায় চালান করে দিচ্ছে। সঙ্গে যেভাবে তার উপস্থাপনায় বস্তাপচা রাজনৈতিক কচকচানির ধুঁয়ো তোলা হচ্ছে, তাতে খবরটি জনসমক্ষে যথেষ্ট গুরুত্ব বা সম্ভ্রম আদায় করতে পারছে না। আর আজ সেরকমই একটা খবর আপনাদেরকে দেব বলে এই প্রতিবেদন।

সেটা ২০০৯ সাল। রাজ্যে তখনও পালা বদল হয়নি। বাম আমল। মে মাসের গোড়ার দিক। সেসময় আলিপুরদুয়ার শহরের বাদল নগরের জয়গুরু জুয়েলার্সে একটি চুরির ঘটনা ঘটেছিল। ২রা মে আলিপুরদুয়ার থানায় অভিযোগ জানান দোকানের মালিক রতন ঘোষ। এরপর দিন-দশেক যেতে না যেতেই ১৩ই মে ফের সোনার দোকানের চুরির অভিযোগ জমা পড়ে আলিপুরদুয়ার থানায়। এবার ঘটনাটি ঘটে বীরপাড়ার পাল জুয়েলার্সে।

এখন আপনাদের মনে হতেই পারে রাইজ অফ ভয়েসেসের হঠাৎ একি মতিভ্রম হল! পাতি ছিঁচকে চুরি-ডাকাতির খবর দিচ্ছে! আর এখানেই লুকিয়ে রয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি। চোর হিসেবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই ব্যক্তি যে আদৌ ছিঁচকে নন। তিনি যে দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক! এখন তিনি বিজেপির সাংসদ হলেও চুরির ঘটনার সময় ছিলেন উত্তরবঙ্গের উদীয়মান তৃণমূল নেতা। আরও জানিয়ে রাখি, রীতিমত দল পাকিয়ে পরপর দুটি সোনার দোকানে চুরির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মানে নিশীথবাবু একা নন, ওনার সঙ্গে আরও কয়েকজন অভিযুক্তর নাম রয়েছে তালিকায়।

কিন্তু ২০১১ সালে পালাবদলের পর মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী যেদিন খোদ নিজে গিয়ে ভবানীপুর থানায় ঢুকে অপরাধীকে ছাড়িয়ে আনলেন, সেদিনই কার্যত স্পষ্ট বার্তা অধীনস্থ পুলিশ বিভাগে চলে গিয়েছিল, কাকে ধরতে হবে আর কাকে ছাড়তে হবে। ফলে যথারীতি নিশীথবাবু তৎকালীন তৃণমূল নেতা হওয়ায় কেসটি ধাম চাপা পড়ে যায়।

কিন্তু এরপর তিস্তা নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। নিশীথবাবু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এসেছেন। কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে ভোটে জিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। আর খুব সম্ভবতঃ তারপরেই ওপর মহলের অঙ্গুলি হেলনে কেসের তদন্ত গতি পায়। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, ২০১৯ সালে সাংসদ হওয়ার পর এই মামলাটি নিশীথবাবুর অনুরোধেই বারাসাতের বিশেষ এমপি-এমএলএ আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়। এমনকি চলতি বছরের ১২ জুলাই সেখানেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মশাই এই মামলাতেই আত্মসমর্পণ করে পাঁচ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন নিয়ে যান। যদিও সেসময় ঘটনাটির কথা কাকপক্ষীও টের পায়নি। মিডিয়াও কোন অজ্ঞাতকারণে সেসময় একদম স্পিকটি নট ছিল।

আমরা যতদূর জানতে পারছি, এরপর আবার ফের নিশীথবাবুর আবেদনের ভিত্তিতেই মামলাটিকে আলিপুরদুয়ার নিম্ন আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়। আর সেখানেই গত শুক্রবার কোর্টে শুনানির সময় মন্ত্রী মশাই এবং তাঁর আইনজীবী কেউই উপস্থিত ছিলেন না। আর তাতেই জারি হয়েছে মন্ত্রী মশাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা! যদিও এবারও খবরটিকে খুব সন্তর্পণে চেপে দেওয়ার চেষ্টা যে হয়েছিল সেটা স্পষ্ট। তাই পরোয়ানা জারি হওয়ার পর চার চারটে দিন কেটে গেলেও আমরা জানতে পারিনি। শেষে গতকাল রাতে খবরটা চাউর হয়ে যায়।

এখন আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস আইনি প্যাঁচপয়জার জানি না। তাই আমাদের প্রশ্নগুলো খুবই সাদামাটা এবং সোজাসাপ্টা!

  • এক, যাঁর বিরুদ্ধে দল পাকিয়ে দু-দুটি সোনার দোকানে চুরির অভিযোগ রয়েছে, যেগুলি আদালতে বিচারাধীন তাঁকে কি আদৌ স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ বলা যায়?
  • দুই, বাম আমলে তৎকালীন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে থানায় দায়ের হওয়া চুরির অভিযোগের যে সারবত্তা ছিল এবং তাতে আদৌ যে কোন রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল না সেটাই কি বর্তমান তৃণমূল সরকার ও তার পুলিশ ঘুরিয়ে প্রমাণ দিল?
  • তিন, এমন একজন চুরির অভিযোগে বিদ্ধ ব্যক্তি অপরাধমূলক কাজ করবার পরেও প্রায় এক দশকের ওপর তৃণমূল কংগ্রেসের মত একটি দল, যারা নাকি একসময় অলিতে গলিতে সততার প্রতীক ব্যানার টাঙাত, করলো কি করে?
  • আর এরই সাথে এই ঘটনায় যেটা স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণিত হল, সেটা হল বিজেপি আসলে মুখেই ‘সনাতনী’ ভাবধারার প্রচার করে, কিন্তু আদতে ক্ষমতার মোহে যার বিরুদ্ধে আদালতে বিচারাধীন দু-দুটি চুরির অভিযোগ রয়েছে তাকেও ভোটে টিকিট দিয়ে জিতিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বানাতে পিছপা নয়!

এপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি অনেকেই হয়তো ভাববেন রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকে বিপক্ষ দল বা সরকারের তরফ থেকে নানা রকমের উদ্দেশ্যপ্রোনোদিত মামলা/অভিযোগ করা হয়, যার বেশিরভাগ গুলিরই সূত্রপাত হয় রাজনৈতিক বিক্ষোভ-সমাবেশ, আন্দোলন বা আইন অমান্য জাতীয় দলীয় কর্মসূচীর থেকে। এপ্রসঙ্গে সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরী সহ একগুচ্ছ সিপিআই(এম) সমর্থককে সম্প্রতি বর্ধমান জেলার আইন অমান্য কর্মসূচীতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৪ দিন জেলও খাটানো হয়!

কিন্তু নিশীথ প্রামাণিকের ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন! এক্ষেত্রে অভিযোগ সরাসরি দল পাকিয়ে দু-দুটি সোনার দোকানে চুরি ও লুঠপাটের। কাজেই এঘটনাটির তাৎপর্য আলাদা। এটি আদৌ আর-পাঁচটা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার মত নয়।

এখন রাজনৈতিক দলগুলি যে এসব নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয় তা তাদের আচার ব্যবহারেই স্পষ্ট। তাই আমাদের মত সাধারণ ভোটদাতাদেরই ভোটদানের সময় আরও সতর্কতা ও সচেতনতা দেখাতে হবে!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র

a) https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/warrant-against-union-mantri-nisith-pramanik-in-09-theft-cases/articleshow/95543529.cms
b) https://www.outlookindia.com/national/arrest-warrant-against-union-minister-nisith-pramanik-in-2009-jewellery-theft-case-news-237898
c) https://www.ndtv.com/india-news/arrest-warrant-against-union-minister-nisith-pramanik-in-2009-jewellery-stores-theft-case-3526679/amp/1
d) https://zeenews.india.com/bengali/state/a-court-issues-arrest-warrant-against-bjp-mp-nisith-pramanik-in-alipurdua_449535.html
e) https://www.amarujala.com/india-news/arrest-warrant-against-union-minister-nisith-pramanik-in-2009-jewellery-theft-case
f) https://www.anandabazar.com/west-bengal/north-bengal/alipurduar-court-issued-arrest-warrant-against-nisith-pramanik/cid/1384677