বর্ধমানে জেল / কলকাতায় বেল / Jail Vs. Bail

কাল দুপুরের পর থেকে রাত্রি পর্যন্ত বাংলার সংবাদমাধ্যম যা দেখিয়েছে, তা হল বিজেপির ‘নবান্ন অভিযান’।
অবশ্য সেভাবে দেখলে শুরুটা হয়ে গিয়েছিল পরশুদিন রাত থেকেই, যদিও সেটাকে আমরা ধরছি না। মিডিয়ার বক্তব্য সারাদিন ধরে নাকি বিজেপির নবান্ন অভিযানকে ঘিরে কলকাতার রাজপথ জুড়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধেছে! আগের কয়েকদিন যেরকম ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার হয়েছিল, তাতে বলা হচ্ছিল নাকি লাখ খানেক লোক হবে। অথচ আমাদের টিভি দেখে মনে হয়েছে খুব বেশি হলে মেরে কেটে দশ হাজার! তার বেশি কিছুইতেই নয়। কিন্তু মিডিয়ার তাতে কি! ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তারা চারিদিকে ধুন্ধুমার দেখছিল! এমনকি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, অভিযানের প্রথম ঘন্টাতেই গ্রেপ্তার বরণ করে অথবা অভিযান শেষ করে গাড়ি চেপে বাড়ি বা পার্টি অফিসে ফিরে বিজেপির রাজ্যস্তরের প্রথমসারির অনেক নেতাই টিভিতে এমন ফুটেজ/কভারেজ দেখে নিজেরাই অবাক হয়ে গেছেন!
এমনকি এই সংবাদমাধ্যমই জানাচ্ছে এই নবান্ন অভিযানে বিজেপি কর্মী সমর্থকদের তাণ্ডবে, ইঁট বৃষ্টিতে আহত হয়েছেন ৩০ জনের বেশি পুলিশকর্মী। পুড়েছে পুলিশের জিপ। অথচ দেখা গেল, গতকালকের এই অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া বিজেপির প্রায় সব প্রথম সারির নেতাদেরই কয়েকঘন্টার মধ্যে পুলিশ জামিনে ছেড়েও দিয়েছে।
অবশ্য সারাদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ধরণের ফুটেজ-মিম ঘুরে বেড়ালো তাতে প্রশ্ন উঠে গেল, আদৌ এনারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কি! কারণ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে পুলিশই ঘেরাটোপে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি হাওয়ায় উড়িয়ে ফেসবুক লাইভ পর্যন্ত করতে দেখা গেল। লালবাজারের মধ্যে লকেট-রাহুল-শুভেন্দু, এই ত্রয়ীর বিসলেরির জলে গলা ভিজিয়ে আড্ডা দেওয়ার ছবিও সামনে এসেছে। এমনকি বিজেপি নেতাদের তরফে পুলিশের কাছে “আমাদের কে গ্রেপ্তার করুন” গোছের কাকুতি-মিনতি এবং শেষমেশ কার্যত যেভাবে নিজেরাই পায়ে হেঁটে প্রিজনভ্যানে উঠে পড়লেন, তা দেখে মনে হতে পারে এনারা আদৌ নবান্ন অভিযান করতে আসেননি, বরং কর্মী সমর্থকদের লড়াইয়ের ময়দানে ফেলে লালবাজার যাওয়াই ছিল এনাদের আসল উদ্দেশ্য।
সেভাবে দেখলে নবান্ন অভিযানের নামে কার্যত ‘হাওড়া, সাঁতরাগাছি এবং মধ্য কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোড, এই তিনটে অঞ্চলে তিনদল প্রথমসারির রাজ্যনেতার নেতৃত্বে বিজেপি বিক্ষিপ্তভাবে আইন অমান্য করেছে’ বললেই প্রায় সবটা বলা হয়ে যায়। যদিও এই তিনটে দলের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে যথেষ্ট অভাব রয়েছে, তাও প্রকট হয়েছে সারাদিনে। এমনকি এই দুর্বলতা চাপা দিতে একটি প্রথমসারির দৈনিকের মাধ্যমে ‘সারাদিন ধরে টিভিপর্দায় ভেসে থাকবার কৌশলের যে তত্ত্ব খাড়া করবার চেষ্টা হল তা দেখে বলতেই হচ্ছে, বিজেপির ‘ফুটেজখোর’ নেতাদের ‘ফুট-সোলজার’ হয়ে রাস্তায় নেমে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে!
এদিকে সমাপতন বোধহয় একেই বলে! একদিকে যখন মিডিয়া বর্ণিত ‘ধুন্ধুমার’ নবান্ন অভিযান করেও বিজেপি নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে দিনের দিনই গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে ফের মিডিয়ার সামনে গরম-গরম বাইট দিচ্ছেন, ঠিক তখনই জানা গেল ৩১ শে আগস্ট বর্ধমানে বামেদের আইন-অমান্য আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া আভাস রায়চৌধুরীর মত সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সহ ৩১ জন কমরেড রীতিমত ১৪ দিন জেল খাটবার পর গতকাল আদালতে জামিন পেয়ে ছাড়া পেলেন। এখন দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, আভাসবাবুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর ছিল বলেই জামিন পেতে এতদিন দেরি। মানে সেদিন আইন অমান্য কর্মসূচিতে বর্ধমানে সত্যি সত্যি ধুন্ধুমার বেঁধেছিল।

অথচ সেই ৩১ শে আগস্ট আইন-অমান্যের এমন সারাদিন ধরে ‘ধুন্ধুমার’ প্রচার মিডিয়া করেছিল কি! স্পষ্ট উত্তর ‘না’। কেন করেনি! কিসের এই পক্ষপাতিত্ব! নাকি বাংলার মিডিয়া মনে করে বামেরা লঘু পাপে গুরুদণ্ড পেলেন! যদি তাই হয় তাহলে সেটা নিয়েও হইচই কোথায়? এক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট!
সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন। “চোর ধরো/জেলে ভরো” স্লোগান তুলে আইন অমান্য কর্মসূচি। এ পর্যন্ত বাম ও বিজেপির কর্মসূচিতে তেমন কোন তফাৎ নেই। শুধু তফাৎ হল পঞ্চায়েত ভোটকে পাখীর চোখ করে বামেরা করছে জেলা ধরে ধরে সারা বাংলা জুড়ে। আর সেই উপলক্ষেই ৩১ শে আগস্ট তাদের কর্মসূচি ছিল বর্ধমানে। আর বিজেপি কেন্দ্রীয় ভাবে গতকাল করলো কলকাতায় । কিন্তু ঠিক কি কারণে বাম নেতাদের ‘বর্ধমানে জেল’ হল আর বিজেপি নেতাদের ‘কলকাতায় বেল’ দিল রাজ্য পুলিশ আমরা জানতে চাইছি!
আপনারা কি মনে করেন! এমন ধুন্ধুমার নবান্ন অভিযান করেও বিজেপি নেতারা কয়েকঘন্টার মধ্যে জামিন পেলেন কি করে! তবে কি বিজেমূল সেটিং!
নাকি ৩০ জন পুলিশ কর্মীকে আহত করা আর পুলিশের জিপ পুড়িয়ে দেওয়ার থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর সাধের “ব” ভেঙ্গে ফেলা অনেক বেশি গর্হিত কাজ!
জানতে চাই আমরা!
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.