ভুয়ো নিয়োগপত্র / The Utkarsh Bangla Files
এবারে এসএসসি মামলায় সিবিআই গ্রেফতার করল মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময়কে। এটা এখন ব্রেকিং নিউজ, বঙ্গবাসী টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছে আপাতত। কেউ পুলকিত, তো কেউ আতঙ্কিত। কিন্তু এইসবের মাঝেই টুকুস করে চাপা পড়ে গেল, একটা বিগ ব্রেকিং নিউজ।
চাকরি দেওয়ার নাম করে রাজ্য সরকারের ভুয়ো নিয়োগপত্র বিলি, এটা হতে পারতো বিগ ব্রেকিং নিউজ, কিন্তু তা হল না।
উৎকর্ষ বাংলা প্রকল্পের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা বিভাগ থেকে তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলে বেশ কয়েকটি সভা থেকে ঘোষণা করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো গত ১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন জেলা থেকে বাসে করে চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ৷ সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের হাতে অফার লেটার তুলে দেবেন বলে জানানো হয়।
সভামঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী চাকরিপ্রার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “যাদের ইমেলে চাকরির চিঠি চলে গেছে, পেয়েছ তোমরা?” চাকরিপ্রার্থীরা সমবেত কন্ঠে “না” বলতেই দৌড়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আসেন ইন্দ্রনীল সেন। তারপর মুখ্যমন্ত্রী আবার বলেন, “উৎকর্ষ বাংলার লোগো ডিজাইন করা দেখবে একটা চিঠি গেছে। তোমাদের যে চিঠি গেছে, সেটা কোম্পানির নামে গেছে, ডিফারেন্ট কোম্পানির নামে গেছে। কারা চিঠি পেয়েছ এখন পর্যন্ত?” বলতে বলতে উনি এক আধিকারিকের সাথে কথা বলে বলেন, “ও, চিঠিটা আজকে যাবে।”
তারপর মাইকে মৃদু স্বরে ভেসে আসে, “এটা বলবে তো”। দর্শকাশনে ততক্ষণে হৈ হৈ শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে বসা নেতা এবং আধিকারিকদের সঙ্গে স্বল্প আলোচনা সেরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন,”আচ্ছা, কনফিউশন নেই। অনেকে অলরেডি পেয়ে গেছে, তারা জয়েনও করে গেছে, আর যারা এখনো পাননি, তাদের সমস্ত প্লেসমেন্ট লিস্ট আমার হাতে আছে। তারা আজ থেকেই পেতে শুরু করবেন।” মুখ্যমন্ত্রী ১২ই সেপ্টেম্বর ঠিক কি বলেছিলেন, তার ভিডিও দেওয়া হল এখানে।
যা জানা যাচ্ছে, সেদিন চাকরিপ্রার্থীদের বলা হয়, বাসে ফেরার সময় অফার লেটার হাতে দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তাও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এরপর হুগলি জেলার ১০৭ জনকে পরে ফোন করে জানানো হয়, হুগলি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি কলেজ থেকে অফার লেটার সংগ্রহ করতে হবে। প্রত্যেকের মোবাইলে একটি পিডিএফ ফাইল দিয়ে দেওয়া হয় সেইদিন।
তার পরের দিন, অর্থাৎ ১৩ই সেপ্টেম্বর, হুগলি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি কলেজে অফার লেটার নিতে আসেন অনেকেই। চিঠিটি লেখা হয়েছে ফানফার্স্ট গ্লোবাল স্কিলার্স প্রাইভেট লিমিটেডের তরফে। চিঠিতে লেখা হয়েছে এই সানফার্স্ট সংস্থাটি গুজরাতের মারুতি সুজুকি কোম্পানিতে দু বছরের আইটিআই প্রোগ্রামে ভেহিকেল টেকনিসিয়ানের-এর প্রশিক্ষণ দেবে। সেই প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে ১১,০০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচ বহন করবে সুজুকি মোটরস গুজরাট প্রাইভেট লিমিটেড। প্রয়োজনীয় নথি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা পরই প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হবে।
চিঠির নিচে সংস্থার তরফে জনৈক ভেদপ্রকাশ সিং-এর নাম ও ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই নম্বরে ফোন করে চাকরিপ্রার্থীরা জানতে পারেন, এই প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাই ভুয়ো। ভেদপ্রকাশ সিং বলেন,
“দেখুন আমি আপনাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই। যে অফার লেটার বলছেন, সেটা ফেক (ভুয়ো)। আবার বলছি, এটা ফেক। তবে আমি যে ফানফার্স্ট কোম্পানি থেকেই বলছি এটা সত্যি । গুজরাটে সুজুকি কোম্পানির সঙ্গে আমাদের আইটিআই নিয়ে প্রশিক্ষণের কর্মসূচী চলে। এটাও ঠিক । গুজরাটে যারা আসে তাদের কাছে এই অফার লেটারই যায়। আমার নামেই যায়। আমার নাম্বারই দেওয়া। কারণ, আমি এখানকার সেন্টার ম্যানেজার। সবটা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের অফার লেটারকে নিপুণভাবে ‘গলত তারিকা’ সে ব্যবহার করা হয়েছে।”
ফানফার্স্টের পক্ষ থেকে সিদ্ধার্থ কক্কর জানান, গতকাল রাতেই বিষয়টি তাঁরা জানতে পারেন। এই ধরনের কোনও চিঠি তাঁরা দেননি । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকদের মেইল করে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এই সংস্থা জানিয়েছে, তারা বিহার ও উত্তরপ্রদেশের ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কেউ এখনও প্রশিক্ষণ নেয়নি। যেভাবে কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটি ভুয়ো। এই ঘটনার পর, অফার লেটার হাতে পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা মুষড়ে পড়েছেন৷
হুগলির জেলাশাসক পি দীপা বলেন, “কী কারণে এই ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এটা কোনও উৎকর্ষ বাংলার প্রজেক্ট নয়। আইটিআইয়ের কোনও ট্রেনিং হবে। আমরা কারিগরি শিক্ষা দফতরকে বিষয়টি জানিয়েছি৷”
এই ঘটনায় সিপিআইএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমত তোপ দেগেছেন ৷ তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য চালাতে পারছেন না। এভাবে উনি বেকার যুবকদের চাকরি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা না করলেও পারতেন।”
মাসখানেক ধরে যা ঘটনাপ্রবাহ, তাতে এই মুহূর্তে সরকারের ঘোষিত অনেক প্রকল্পই ঠিকঠাক কাজ করছে না। কিন্তু এই নিয়ে কলরব উঠলেই কেউ কেউ বলবেন, বিশেষ নাম্বারে ফোন করুন, সেটা হতে পারে,” দিদিকে বলো” অথবা “এক ডাকে অভিষেক” বা অন্যকিছু।
যেমন এই মুহূর্তে অনেক হাসপাতাল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিচ্ছে না, কিন্তু সরকারকে কিছু বলা যাবে না। মরণাপন্ন রোগী ফেলে মানুষজনকে ফোন দিতে হবে সরকারকে। তাতে অবশ্য সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম।
সরকারি মঞ্চ থেকে নিয়োগপত্র দেওয়া হবে, সেই নিয়োগপত্রে দেওয়া নম্বরে ফোন করে জানবেন নিয়োগপত্র ভুয়ো। কিন্তু ভুয়ো নিয়োগপত্র পেয়ে সরকারকে কিছু বলা যাবে না, সাংবাদিকরাও প্রশ্ন করবেন না। এরপর দেখতে দেখতে এসে যাবে ভোট। আবার “ডাবল ডাবল চাকরির প্রতিশ্রুতি”। তারপর বিপুল জনসমর্থন পেয়ে, আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা করবে, সংবাদমাধ্যম সরকারকে ফুটেজ দেবে, আর অন্যদিকে আপনি কিছুই পাবেন না। কিছু বলতে গেলেই আপনি উন্নয়ন-বিরোধী, সরকারের নামে কুৎসা করছেন, “নেগেটিভ খবর” ছড়াচ্ছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে, বঙ্গে একটা বাক্য প্রচলিত ছিল, “চোপ! সরকার চলছে।” তারপর থেকে অনেকেই চুপ করে গেছেন, কোথাও ভয়ে, কোথাও ভক্তিতে।
সরকারি মঞ্চ থেকে বেসরকারি চাকরির অফার, সেটা মানা গেলেও, সেখানে অফার লেটারের নামে ভুয়ো নিয়োগপত্র প্রদানের মত একটা সিরিয়াস ইস্যু কেবলমাত্র সংবাদমাধ্যমের “পজিটিভ নিউজ” করার তাগিদ এবং চরম উদাসীনতায় আপামর বঙ্গবাসীর কাছে পৌঁছালো না। এটা লজ্জার। কিন্তু যাদের লজ্জা পাওয়ার, তারা কি সেটা পাচ্ছেন?
ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.