সংরক্ষণ বা কোটার রাজনীতি / Economically Weaker Section

চারিদিকে আবার সেই মাস্টারস্ট্রোকের হইচই! এবার নাকি সংরক্ষণ পাবেন দরিদ্র উচ্চবর্ণের মানুষও।

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী সরকার উচ্চবর্ণের মধ্যে আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ১০% আসন সংরক্ষণ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই উপলক্ষে সংসদে ১০৩ তম সংবিধান সংশোধনী বিল সর্বসম্মতিক্রমে পাশও হয়েছিল।

ইতিমধ্যেই তফসিলি জাতি (১৫%), তফসিলি উপজাতি (৭.৫%) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেনী বা ওবিসিদের (২৭%) জন্য মোট ৪৯.৫% আসন সংরক্ষিত ছিল। মোদী সরকার তাই এদেরকে বাইরে রেখে শুধুমাত্র উচ্চবর্গের সাধারণদের মধ্যে যারা আর্থিক ভাবে দুর্বল তাদের জন্য আরও ১০% আসন সংরক্ষন করতে বলেছিল। ফলে এর বিরুদ্ধে ৪০টার ওপর মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বিচারপতি বেঞ্চ গতকাল নরেন্দ্র মোদী সরকারের সেই সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিল। যদিও পাঁচ সদস্যের মধ্যে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি এবং মাননীয় বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট এই সংরক্ষণের বিরোধিতা করেন। কিন্তু বাকি তিন সদস্য এই সংরক্ষণের স্বপক্ষে থাকায় বিচারপতি বেঞ্চে ৩-২ ফলাফলে প্রস্তাবিত উচ্চবর্গের জন্য ১০% সংরক্ষণে আইনি সিলমোহর পড়ে যায়।

প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের তরফেই এই রায়কে স্বাগত জানানো হয়েছে। বিপক্ষে জোড় গলায় কোন প্রতিবাদ করা হয়নি। কারণ ভোটব্যাঙ্ক। আর আগেই বলেছি এই সংক্রান্ত বিলটি লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়েছিল।

প্রতিবেদন পড়ার আগে নিচের বোতামে ক্লিক করে জেনে নিন, আপনি EWS-এর সুবিধা পেতে পারেন কিনা।

এবারে রাইজ অফ ভয়েসেস কয়েকটি তথ্যের কথা এখানে উল্লেখ করতে চায়।

২০১০ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেশে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের জনসংখ্যা ৩১.৭ কোটি। এরমধ্যে তফসিলি জাতির ৭.৭ কোটি মানুষ রয়েছেন যা তাদের মোট জনসংখ্যার ৩৮% । আছেন তফসিলি আদিবাসীদের ৪.৩ কোটি মানুষ যা দেশের মোট তফসিলি আদিবাসী জনসংখ্যার (৪৮%)। এছাড়া আছেন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেনীর বা ওবিসি ক্যাটিগরির ১৩.৯ কোটি মানুষ যা তাদের মোট জনসংখ্যার ৩৩%। আর রয়েছেন ৫.৮ কোটি সাধারণ উচ্চবর্গের মানুষ যা তাদের জনসংখ্যার ১৮%। হিসেব কষলে দেখা যাবে এই সংরক্ষণের যদিও উদ্দেশ্য হল আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণীকে সামনের সারিতে তুলে আনা, তা সত্বেও আদতে তফসিলি জাতি/উপজাতি এবং ওবিসিদের এই সংরক্ষণের বাইরে রেখে কার্যত ভারতে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী ২৫.৯ কোটি বা প্রায় ৮২% মানুষকে এই সংরক্ষণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হল এই যুক্তিতে, যে তারা ইতিমধ্যেই তফসিলি জাতি/উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণী সংরক্ষণের আওতায় সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকায় এই ২৫.৯ কোটি তফসিলি জাতি/উপজাতি বা ওবিসি মানুষ নিজ নিজবর্গের মধ্যেও সেভাবে শিক্ষা ও চাকরি প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারে না। কাজেই ইকনমিক উইকার সেকশন (EWS) নাম দিয়েও দেশের বৃহত্তম আর্থিকভাবে দুর্বল অংশকে ছেঁটে ফেলা হলো কোন স্বার্থে, সে প্রশ্ন উঠবেই!

এবার আসা যাক পরবর্তী অংশে! ৫.৫ কোটি উচ্চবর্গের দরিদ্রতম অংশ কি আদৌ লাভবান হবে এই ১০% EWS কোটাতে!

তাহলে আগে জানতে হবে EWS কাদেরকে বলে!

  • EWS হলো যার পারিবারিক বার্ষিক আয় আট লক্ষ টাকার কম।
  • যদি পরিবারের হাতে কৃষিজমি থাকে তবে তা হতে হবে ৫ একরের (৩০২ কাঠা) কম।
  • বাড়ির আয়তন হতে হবে ১০০০ বর্গফুটের কম।
  • পরিবারের হাতে বসতজমি থাকলে যদি পুর এলাকায় হয় তা ১০০ বর্গগজের কম (৯০০ বর্গফুট) হতে হবে এবং পুর এলাকার বাইরে হলে তার আয়তন ২০০ বর্গগজের (১৮০০ বর্গফুট) কম হতে হবে।

মানে যে পরিবারের মাসিক আয় ৬৬,০০০ টাকা এবং শহরে ৯০০ স্কোয়ার ফুটের দু-কামরার ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে থাকেন তিনিও এই সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন। ফলে আদৌ সমাজের উচ্চবর্গের প্রান্তিক বা নিম্নবিত্তরা এই সংরক্ষণের সুবিধা নিতে পারবেন কি না, প্রশ্নটা উঠবেই। পারবেন কি তারা আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সাথে চাকরির প্রতিযোগিতায় নেমে জিততে, তাতেও থাকবে সন্দেহ।

নাকি এই সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে ইকনমিক উইকার সেকশনের কথা বলা হলেও ব-কলমে উচ্চবর্গের মধ্যবিত্তদের তুষ্টিকরণ করা হলো, ভোটবাক্সের নিরিখে যার সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। মনে রাখবেন আমাদের দেশে যতজন আয়কর রিটার্ন জমা দেন তার ৯০% র বেশি মানুষ কিন্তু EWS-র আওতাভুক্ত!
যাঁরা কথায় কথায় আমরা তুষ্টিকরণের রাজনীতি করি না বলে হুঙ্কার ছাড়েন তারা কি শেষমেশ তুষ্টিকরণের তাস খেলে দিলেন! আর বাম-ডান সব বিরোধীদল চুপ কারণ শহর ও শহরতলীর মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্ক বড্ড বেশি বেয়ারা! যখন তখন রূপ বদলে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার হাওয়া তুলে সরকার বদলে মুখ্য ভূমিকা নেয়। তাই এদেরকে চটাতে কেউই চায় না!

কিন্তু আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নয়! তাই প্রশ্নগুলো রাখলাম জন পরিসরে আলোচনার জন্য।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস