জবাব চাই / Miss CM, Do you want to answer?

“আমি অন্যায় করে থাকলে আমার গালে একটা চড় মারুন। কিছু মনে করব না। কথায় কথায় লোকের চাকরি খাবেন না। চাকরি গেলে খাবে কি?”

না। বক্তার নাম লেখবার মত ধৃষ্টতা ‘রাইজ অফ ভয়েসেস’ দেখাবে না। কারণ সারা বাংলা জেনে গেছে এতক্ষণে।

তবুও নেহাতই ‘রেকর্ড’ রাখতে হবে বলে লেখা- বক্তব্যটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

শাসকদলের মুখপাত্ররা এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ এই উক্তিটির মধ্যে মানবিক মমতাকে খুঁজে পাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার কায়দা করে বিরোধীতার মোড়কে হলেও মানবিকতার ভাবনাটা ভাসিয়ে দিচ্ছেন! সন্ধ্যেবেলা প্রাইম টাইম টক-শো’তে সেই মতো জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ‘মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে কোথাও কি সামান্য হলেও মানবিকতার ছোঁয়া নেই, নাকি পুরোটাই সরকারের দুর্নীতি আড়াল করবার রাজনৈতিক প্রচেষ্টা?’অথবা প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘যারা আদালতের নির্দেশে চাকরি হারাচ্ছেন তাদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী যতটা মানবিক, যে ন্যায্য অথচ বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা বছরের পর বছর শহরের ফুটপাথে বসে চাকরির দাবীতে ধর্না দিচ্ছেন, তাদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী কি ততটা মানবিক নন?’

মানে সোজাকথা হলো আপনার জ্ঞানে বা অজ্ঞানে ‘মানবিক’ শব্দবন্ধটা রয়েই যাচ্ছে!

কিন্তু আমরা ‘রাইজ অফ ভয়েসেস’ এপ্রসঙ্গে যা বলবো সেটা আসলে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীরই কিছু ‘সু’পরামর্শ! ঘুষ দিয়ে পাওয়া চাকরি হারিয়ে একদম ভেঙ্গে পড়বেন না। বরং ‘কোন কাজই ছোট নয়’ ভেবে পাড়ার মোড়ে চপ-ঝালমুড়ি-ঘুগনির দোকান দিন। আজকাল এসবেও প্রচুর ইনকাম! এই রোজগার দিয়ে দোতলা-তিনতলা বাড়ি বানানো যায়। তাছাড়া কাশফুল থেকে বালিশ তৈরী বা কচুপাতা থেকে ব্যাগ ঠোংগা তৈরী করেও আজকাল ভালো ইনকাম হচ্ছে। খাওয়া-পড়ার অভাব হবে না। কিন্তু না, এমনটা মুখ্যমন্ত্রী বললেন না। কেন বললেন না ? উনি কি ভুলে গেলেন বাংলার বেকার ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে নিজের আওড়ানো আপ্তবাক্যগুলো? এটাই আমাদের তরফে ওনাকে প্রথম প্রশ্ন। জবাব চাই।

আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘চাকরি খাবেন না’ শব্দবন্ধটি নিয়ে। শিক্ষাক্ষেত্রে স্কুলগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে যে পাহাড়-প্রমান দুর্নীতি সামনে এসেছে তা এসেছে সুদীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, কোন স্বতঃপ্রণোদিত সরকারী তদন্তের কারণে নয়। আর সেই আইনি লড়াইতে প্রথম থেকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখা গিয়েছে বামমনস্ক আইনজীবীদের যাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মহাশয়। তাই মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই এই ‘সিপিএমের বিকাশবাবু’র বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। আর সেইসঙ্গে শাসকদলের মুখপাত্রদের আরেকজন টার্গেট হলেন বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি যাঁর এজলাশে এই সংক্রান্ত মামলাটি চলছে। গতকাল তাই মুখ্যমন্ত্রী উপরের উক্তিটি করেছেন বেছে বেছে আলিপুর কোর্টে ঋষি অরবিন্দের ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আবক্ষ মুর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে। ভাবখানা এমন যেন ঐ ‘সিপিএমের বিকাশবাবু’ আর কয়েকজন মাননীয় বিচারপতি মিলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু যুবক-যুবতীর চাকরি খাচ্ছেন। এখানে ‘খাচ্ছেন’ শব্দটিতে আমাদের তীব্র আপত্তি রইলো। কারণ যা হচ্ছে তা মূলতঃ বিচারালয়ের নজরদারিতে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে। খোদ রাজ্য সরকারের শিক্ষাদপ্তরের অধীনস্থ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সংশ্লিষ্ট পর্ষদগুলি রীতিমত বিজ্ঞপ্তি জারি করে নিয়োগ দুর্নীতির কথা মেনে নিয়ে বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর সহ ভুয়ো চাকরিপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করছে এবং সেই তালিক অনুসারেই অবৈধভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। কাজেই এখানে ‘চাকরি খাওয়া’র প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে? রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের মুখে এমন ‘লুজ-টক’ কি আদৌ মানানসই? জবাব চাই।

আমাদের তৃতীয় প্রশ্ন, এই ‘মানবিক’ শব্দবন্ধটিকেই। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই দাবী করে আসছেন, ৩৪ বছরের সিপিআই(এম) আমলে সরকারী নিয়োগে বহু স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু তিনি নাকি ‘মানবিক’ তাই সেই সমস্ত সিপিআই(এম) আমলে নিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। মানে উনি ঘুরিয়ে ‘সিপিএমের বিকাশবাবু’দের বার্তা দিচ্ছেন যে আমি আপনাদের সময় অবৈধভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘মানবিকতা’র কারণে চাকরি না খেয়ে ছেড়ে দিয়েছি, প্রতিদানে আপনারাও তৃণমূল সরকারের আমলে যারা অবৈধভাবে চাকরি পেয়েছে তাদেরকে ‘মানবিকতার দোহাই’ দিয়ে ছেড়ে দিন, তাদের তো ঘর সংসার বউ-বাচ্চা আছে! আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস, আমাদের কোন ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই! আমরা কে সিপিআই(এম), কে তৃণমূল চিনি না। চিনতে চাইও না। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যদি বাম আমলে অবৈধভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ তথ্য ও প্রমাণসহ তালিকা থাকে, তবে তাদেরকে চিহ্নিত করে অবিলম্বে বরখাস্ত করুন। অথবা তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তদন্ত করিয়ে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিন। কিন্তু চুরি-দুর্নীতির ‘পলিটিক্যাল লিনিয়েজ’ বরদাস্ত করব না। সরকারী নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গতকালকের বক্তব্যে আদৌ ওনার মানবিকতা নয়, বরং দুর্নীতিসুলভ মানসিকতাই প্রকট হচ্ছে। তাই আমাদের তৃতীয় প্রশ্ন ২০১১ সালের সেই ‘সততার প্রতীক’ ‘প্রশাসক’ মমতা কি আজ দুর্নীতির পাকেচক্রে অস্তমিত?

চতুর্থ প্রশ্ন, গতকাল মুখ্যমন্ত্রী ‘মানবিকতা’র বার্তাটিকে ছড়িয়ে দিতে আদালতের নির্দেশে চাকরি হারানো ব্যক্তিদের মধ্যে জলপাইগুড়িতে ঘটে যাওয়া দুটি আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ঘটনা দুটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার জন্য কি উনি ‘আদালত আর সিপিআই(এম)এর বিকাশবাবু’কে ঘুরিয়ে দায়ী করবার চেষ্টা করলেন! তাহলে আমাদের প্রশ্ন, আপনার সরকার ও দলের নেতা-মন্ত্রীরা যদি ঘুষের বিনিময়ে সরকারী চাকরি বিক্রির বাজার খুলে না বসতেন, তাহলে এই দুজন হয়তো অবৈধ উপায়ে চাকরি যোগাড় করতে পারতেন না, আর পাঁচজন কর্মহীন যুবক-যুবতীর মতই জীবন-জীবিকার লড়াই চালিয়ে যেতেন! কাজেই এভাবে কি আদৌ নিজেদের দায় অন্যের ঘাড়ে ফেলে দিয়ে পালানো যায়? আর তাছাড়া চাকরি চুরি যাওয়ার কারণে যেসমস্ত যোগ্য অথচ বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা বছরের পর রাস্তায় বসে চাকরির দাবীতে ধর্না দিচ্ছে তাদের মধ্যেও কিন্তু চাকরি না পাওয়ার হতাশা ও মানসিক চাপের কারণে মোটামুটি ৮টি আত্মহত্যা এবং একটি গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন না এই ঘটনাগুলোর কথা? এমনকি যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের কয়েকজন অর্থাভাবের জন্য অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা-মা’র ঠিকমত চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারেননি, হারিয়েছেন বাবা-মা’কে। এনাদের জন্য সরকারী তরফে দেখানো ন্যুনতম ‘মানবিকতা’র নজির কই? বরং ধর্না তুলতে রাতবিরেতে জুটেছে পুলিশের লাঠি! কেন? জবাব চাই।

আর সবশেষে, শিক্ষাব্যবস্থা হলো জাতির মেরুদণ্ড। সেখানে দেশ তথা জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি হয়। ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া হাজার হাজার অযোগ্য লোক স্কুলে স্কুলে শিক্ষকতা চালিয়ে গেলে আর যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা রাস্তায় বসে চাকরির দাবিতে ধর্না দিলে আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে কি শিখবে, সেদিকে কি আদৌ মুখ্যমন্ত্রীর খেয়াল আছে? উনি কি চান জাতির মেরুদন্ডটা ভেঙ্গে যাক? তা নাহলে ‘চাকরি খাবেন না’ বলে মানবিকতার দোহাই দিয়ে তিনি কাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা পদে বহাল রাখবার জন্য সওয়াল করলেন? আর তাই উনি চাকরি খাওয়ার বিপক্ষে নাকি ঘুষ খাওয়ার পক্ষে আলাদা করা যাচ্ছে না।

বিশ্বাস করুন আমরা কেউ চড় মারতে চাইছি না, আমরা শুধু জবাবগুলো চাইছি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস