সিলে-বাঁশ / The Syllabus Saga

গল্পের গরুটা যে গাছ থেকে নেমে পড়েছে এবং ঘাসের মাঠে পা বাড়িয়েছে সেদিকে রাজ্যের বিগত পুরনির্বাচন এবং বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফলগুলি স্পষ্ট অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। এমনকি ‘জঙ্গি’ নবান্ন অভিযানে সে গরু নিজে থেকেই গোয়ালে ঢুকে চা-কোল্ডড্রিঙ্কস পর্যন্ত খেয়েছে। দলের মধ্যে বর্তমানে উপেক্ষিত একদা প্রথমসারির নেতারা পর্যন্ত প্রকাশ্যে মেনেও নিচ্ছেন যে ঝিমোতে ঝিমোতে সমাজমাধ্যমে জাবর কাটা ছাড়া এই মুহুর্তে গরুটার আর কোন কাজেই মন নেই। লাঙ্গল কাঁধে রাজনৈতিক জমি চাষ তো অনেকদূর, ল্যাজ নেড়ে কান ঝাপটে মাছি তাড়াতেও প্রবল অনীহা। আসলে ‘মুড’টাই নেই

কিন্তু বাংলার একশ্রেণীর সংবাদমাধ্যম এই সহজ সরল বাস্তবটা মানতে নারাজ! সমাজমাধ্যমের রমরমার মধ্যেও তারা এখনও ভাবছে তারাই ‘রাজা’, খবর এখনও তারাই তৈরি করে। সন্ধ্যেবেলার “প্রাইম টাইম”-এ তারা যা নিয়ে কলতলার ঝগড়া করবে সেটাই খবর! ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে! পাবলিকের দেদার গালি-গালাজ খাচ্ছে! যেমন ধরুন এই মুহুর্তে আমাদের মনে হচ্ছে, রাজ্যের সমস্যার কথা তুলে ধরবার জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রধান সোর্স হল বিরোধী দলনেতার ট্যুইটার হ্যান্ডেল। একাজে পরিশ্রম কম বলেই এমন পন্থা অবলম্বন কি না আমরা জানি না, কিন্তু মাঝখান থেকে এই মুহুর্তে যে জেলায় জেলায় কৃষক আত্মহত্যার মিছিল চলছে সে খবরটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। বর্ধমানের তুহিনা খাতুন আত্মহত্যা কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত এবং পুলিশের খাতায় ফেরার শাসকদলের ‘বিধায়ক ঘনিষ্ঠ’ পুরপিতা যে পুলিশের ঘেরাটোপে বসেই জেলার কার্নিভাল দেখে ফেললো এমন খবরটাও আমাদের অজানা থেকে যাচ্ছে। কারণ এ সমস্ত খবর জোগাড় করতে যেভাবে মাঠেঘাটে ঘুরতে হবে, যে পরিমাণ রাজনৈতিক জমি চাষ করতে হবে তার দম “আমাকে গ্রেপ্তার করুন” আবদার করতে করতে নিজে নিজেই পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়া বিরোধী দলনেতার নেই। ফেসবুক লাইভে উনি যতটা পটু, মাঠঘাট বা রাস্তার লাইফে ততটা নন। ফলে তার তরফে এসব খবরের ট্যুইট বা পোস্ট আসছে না আর তাই সংবাদমাধ্যমে সেভাবে খবরও হচ্ছে না।

এতো গেল যা যা খবর হচ্ছে না তার গপ্পো! কিন্তু যা যা খবর হচ্ছে তাও কি যথাযথ ভাবে হচ্ছে। যেমন ধরুন, গতকাল সন্ধ্যেবেলা বহুদিন পর আমাদের সংবাদমাধ্যম জানালো যে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা ছুঁয়েছে! সৌজন্যে বিরোধী দলনেতার ট্যুইটার হ্যান্ডেল! স্বভাবতই তাঁকে ফাটাফাটি ফুটেজ খাওয়ানো হল! ভাবখানা এমন, কেমন জাঁদরেল বিরোধী দলনেতা পেয়েছে বঙ্গবাসী দেখুক একবার! একদম শাসকের চোখে চোখ রেখে সীমানা পার করে দেওয়া ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি!

কিন্তু সত্যি কি তাই! ২০১১ সালে বাম আমলের শেষে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠার সময় রাজ্যের স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৬৪ বছরের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ছিল কম বেশি ১.৯ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু বিগত ১১ বছরে পরিবর্তনের জমানায় সেই ঋণের পরিমাণই এসে ঠেকেছে ৬ লক্ষ কোটি টাকায়। আর সেই ১১ বছরের মধ্যে একটা বড় সময় (সাড়ে ৯ বছরের মত) আমাদের বিরোধী দলনেতা ছিলেন তৃণমূল সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য! কাজেই যে প্রশ্নটা অবধারিত ছিল সেটা হল সেই সময় আমাদের তেজি পরাক্রমশালী নেতা রাজ্য সরকারের এই বিপুল ঋণ নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেননি কেন!

কিন্তু না! এ প্রশ্নটা বাংলার সংবাদমাধ্যম এখনও অবধি করে উঠতে পারেনি। কারণ এঁরা ‘কপি-পেস্ট’ খবর করেন! নিজের জন্য এমন অস্বস্তিকর প্রশ্ন তো বিরোধীনেতা নিজের ট্যুইটে লিখবেন না! কাজেই এটা বাংলার সংবাদমাধ্যমের আউট অফ সিলেবাস!

কিন্তু ইদানীং বাংলার মানুষ বোঝাতে শুরু করেছে, তারা আর সংবাদমাধ্যমের তৈরি সিলেবাস পড়তে রাজি নয়। নিজেদের সিলেবাস তারা নিজেরাই ঠিক করতে শুরু করছে। সেই চিরাচরিত কায়দায় ফুটেজ খাইয়ে মগডালে পাঠানো গরুর রচনা সে সিলেবাসে নেই। তারা ফুটেজখোর নয়, ফুটসোলজার বিরোধী চায়। আর তাই সত্যি সত্যি গাঁ-গঞ্জে ফের আবার ইতি উতি লাল পতাকার সারি নজরে আসছে।

এমনকি বামেদের আগামী গোটা নভেম্বর মাস জুড়ে নভেম্বর বিপ্লবের কথা মাথায় রেখে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে লাল পতাকা ওড়াবার কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। এই উপলক্ষে তাদের কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন, ছাত্র ও যুব সংগঠন এবং মহিলা সংগঠন গুলো কোমর বেঁধে নামছে। জাঠার মাধ্যমে বাংলার প্রতিটি গ্রামকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে। আর তারই কাউন্টারে রাজ্যের শাসকদল ‘চলো গ্রামে যাই’ কর্মসূচী নিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে।

সে জায়গায় ছন্নছাড়া বঙ্গ বিজেপি সেপ্টেম্বরের সেই নির্ভেজাল হাস্যরস উদ্রেককারী নির্বিষ নবান্ন অভিযানের পর কিছু তথাকথিত পেইড নিউজ এবং পেইড ফুটেজ ছাড়া খবরে নেই। উৎসব পরবর্তী কোন কর্মসূচির কথাও তারা আগাম ঘোষণা করে উঠতে পারেনি। মাঝখানে নভেম্বরে ‘সিঙ্গুর থেকে সিলিকন ভ্যালি’ রিলে মিছিলের কথা হাওয়ায় ভাসানো হয়েছিল। আপাতত তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। এমনকি মাঝখানে, আগামী ডিসেম্বরে রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়ার মত অগণতান্ত্রিক কাজের হুঙ্কার ছেড়ে এখন ঢোঁক গিলতে শুরু করেছে। আর দলের অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দল আর ডামাডোল তো বিজেপির নিত্যসঙ্গী। বরং সরকার বিরোধী আন্দোলনের থেকে নিজেদের মধ্যেকার ঝগড়া-মারামারির জন্য বিজেপি বেশি খবরে থাকে।

ফলে এমন কোন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ ফুটেজখোর বিরোধীদলের গপ্পো সিলেবাসে রেখে বাংলার মানুষ আর বাঁশটা নিতে চাইছে না। বরং তারা তাদের রাজনৈতিক সিলেবাসে কিছু অদল-বদল করে নিচ্ছে। শুধু পাত্থ-কেষ্ট-মানিকদের দেখলে চোর চোর স্লোগান তুলে থেমে যাচ্ছে না, পাশাপাশি বামেদের ডাকা ধর্মতলার ‘ইনসাফ সভা’য় ভিড় জমাচ্ছে। গাঁ-গঞ্জের দিকে বেশ কিছু বামমুখী দল বদলের খবরও সমাজমাধ্যমে ঘুরছে। আসছে কিছু সমবায় সমিতি ও স্কুল পরিচালন সমিতিতে বাম আধিপত্য লাভের খবরও। ফলে বাংলার রাজনৈতিক সিলেবাসে কোথাও যেন গেরুয়া ফিকে হয়ে লাল উত্থান ঘটছে। বাকি টা সময় বলবে।

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস শুধু আপনাদের কে একটা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আঁচ দিলাম।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস