গরুটা গাছ থেকে নামছে / The Sliding Cow

একটা গরু গল্পের মই তে চড়ে গাছে উঠে পড়েছিল। সে এমনই রোমহর্ষক গপ্পো যেখানে “আর নয় অন্যায়” চিৎকারের মাঝে বিপক্ষ দলের বাঘা বাঘা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতারাও তোয়ালে মুড়ে খামে ভরে ঘুষ (থুড়ি অনুদান!) আদানপ্রদান করেও দিব্যি “সুনার বাংলা” গড়তে নেমে পড়েছিলেন, অথচ আমরা অনেকে টেরও পাই নি। সেই কর্মসুচী রুপায়ণে চৌকিদার এলেন। এলেন তাঁর গুজরাটি ও হিন্দি বলয়ের অভিজ্ঞ সাঙ্গপাঙ্গরা। সঙ্গে ছিলেন দু-দুজন চাণক্য । একজন দেশের। একজন বাংলার। ডবল ইঞ্জিনে চেপে আচ্ছে দিন আসবে এমনই স্বপ্ন বাংলা জুড়ে বোনা হল।

হুঙ্কার কানে এল “আব কি বার ২০০ পার।”

কিন্তু বাংলার মানুষ কু-ঝিক-ঝিক ডবল ইঞ্জিনের কুনাট্য হজম করতে পারল না।

তাই ১০০-ও পার হল না। পেলেন সাকুল্যে ৭৭ টা সিট। আর এখন নিজের দলের লোকেরাই হলপ করে বলতে পারবেন না, ঠিক ক’জন বিধায়ক এই মুহুর্তে দলে আছে। সংখ্যাটা এই মুহুর্তে সাত থেকে ছয়ের ঘরে নেমে এসেছে। এর মধ্যে এমন বিধায়কও আছেন যারা বিধানসভার মধ্যে বিজেপি অথচ বাইরে তৃণমূল।

তবুও এঁরা কলার তুলে বলে বেড়াতেন, আমরাই হলাম গিয়ে এখন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। ৩৮% ভোট পেয়েছি। ঠিকই কথা। কোন ভুল নেই। গত বিধানসভা ভোটের ফলাফল তাই বলছে। কিন্তু তারপর থেকে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে প্রাপ্তভোটের হার ক্রমশ নিম্নগামী! মানে যেমন তরতরিয়ে গরু মই বেয়ে গাছে উঠেছিল তেমনি গড়গড়িয়ে নামছে!

বিগত বিধানসভা উপনির্বাচন গুলিতে সেই প্রাপ্ত ভোটের হার নেমে এসেছিল ২০% এর নীচে। তখন বলা হল শাসক সৃষ্ট সন্ত্রাসের আবহে ভোট হয়েছে। তাই এই ফলাফল। হয়ত এতে সারবত্তাও ছিল। কারণ আমাদের শাসককে আমরা সবাই ভালো করেই চিনি! জানি তারা কি করতে পারে আর কি করতে পারে না। তাই ভাবলাম আর একটু দেখি। ধৈর্য ধরি। “সুনার বাংলা” বলে কথা! কাজেই “হ্যাভ পেসেন্স।”

এরপর এল কলকাতা পৌরসভার নির্বাচন। সেখানে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাটা বহুদিন পর প্রথম নেমে এল ১০% এর নীচে। যদিও এটাও সত্যি যে সেই ভোটেও শাসকদল বেহায়ার মত দেদার ভোট লুঠপাট চালিয়েছিল কিন্তু রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের ১০% এর নীচে নেমে যাওয়াটা চোখে লেগেছিল। কারণ বিগত বিধানসভা ভোটে ৭% ভোট পাওয়া “শূন্য বাম” কলকাতা পুরভোটে নিজেদের ভোট বাড়িয়ে ১২%-১৩% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল। তবু তখনও আমাদের অনেকেই নিজেদেরকে শান্তনা দিলাম এই বলে যে, শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীদের ছাপ্পার দাপটে এবং প্রশাসনের নির্লজ্জ দল-দাসত্বে পাকেচক্রে এমন ফলাফল হয়ে গেছে। এবার গরু হাম্বা ডাক দিল বলে! দুধে সোনা না মিললেও সোনার বাংলা মিলবেই!

কিন্তু না! আপাতত সেরকম আশা আর দেখা যাচ্ছে না।

সৌজন্যে গত ১২ ই ফ্রেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত চারটি বড় পৌরনিগমের নির্বাচন। শিলিগুড়ি, আসানসোল, চন্দননগর এবং বিধাননগর। এই ভোটেও চলল দেদার লুঠপাট! এমনকি মৃত ভোটাররাও বুথে এসে ইভিএম টিপলেন। সেকথা আমরা বা প্রশাসন জানতে পারলাম ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পর। এ বিষয়ে আলোচনা করবো অন্য লেখায়। আপাতত গরুর গপ্পে ফিরি। তা এবারও দেখা গেল গরু গাছ থেকে নেমে আসছে! ওপরে আর থাকতে পারছে না।

বিধাননগর এবং চন্দননগরে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট কলকাতার পর ফের একবার ১০% এর নীচে নেমে এসেছে। বামেরা আবার দ্বিতীয় স্থানে উন্নিত। আর চন্দননগরে তো ৩০% এর কাছাকাছি ভোট পেয়েছে বামেরা । বিধাননগরে অবশ্য তাদের ভাঁড়ারে মাত্র ১১% ভোট । তবে দুক্ষেত্রেই বিগত বিধানসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় বামেদের ভোট যে বেড়েছে এটা খালি চোখেও দেখা যাচ্ছে। আর বিজেপির গপ্পের গরু পা-পিছলে মগ ডাল থেকে এক্কেবারে সপাটে মুখ থুবড়ে নীচে।

এদিকে আসানসোল ও শিলিগুড়িতে দ্বিতীয় স্থান বজায় থাকলেও বাম শক্তি ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। বিজেপি শিলিগুড়িতে পেয়েছে ২৩% আর আসানসোলে পেয়েছে ১৭% ভোট। সেখানে বামেরা পেয়েছে যথাক্রমে ১৮% এবং ১২%।

আর যদি বাম-কংগ্রেস ভোট যোগ করা হয় বিধানসভা ভোটের মত তাহলে এ দুটোতেও প্রধান বিরোধীর তকমা প্রায় হাতছাড়া! দুক্ষেত্রেই বিগত বিধানসভা ভোটের নিরিখে বিজেপির ভোট কমেছে যথাক্রমে ২৫ হাজার এবং ৭০ হাজার আর বামেদের ভোট বেড়েছে যথাক্রমে ২৭ হাজার এবং ৪০ হাজার।

মানে লুঠ-ছাপ্পা ভোটের মধ্যেও যে বার্তাটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে সেটা হল এইভাবে রাজ্যজুড়ে ঘুরে ঘুরে মর্নিং ওয়াক করে চা-বিক্কু চিবিয়ে আর তারসাথে মাঝেমধ্যে হিন্দু-মুসলিম করে তেমন কিছু হবে না। আর এদের অপদার্থতার জন্যেই বিধানসভার মধ্যে বাংলা এক “বিরোধীশূন্য” গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে যা একান্তই কাম্য নয়।

এদিকে প্রধান বিরোধী দলের এমন ভরাডুবির ফলে আরও বেশ কিছু গরু যে বেড়া টপকাবে, পুরনো গোয়াল ফেলে নতুন গোয়ালে ঢুকবে তাও এক প্রকার নিশ্চিত। ইতিপূর্বে পৌরনিগম ভোটের আগেই একদল নেতা-বিধায়ক হোয়াটসয়্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করে সে বার্তা দিয়েই রেখেছেন। দল পরিবর্তনের ঢল নামলো বলে!

এখন এতটা পড়ে যদি ভাবেন আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস বাংলায় বিজেপির এপিটাফ লিখছি তাহলে ভুল ভাবছেন। আসলে যেটা বোঝাতে চাইছি সেটা হল গরুটা যে গতিতে গাছ থেকে নেমে আসছে তাতে লালমোহন গাঙ্গুলির ভাষায় “পপাত চ ও মমার চ” হওয়া ছাড়া অন্যকিছু হওয়া “টাফ”।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস