অনুপ্রাণিত বাদশা / Tuhina Case
হাওড়ার আমতা কলকাতার যতটা কাছে বর্ধমান ততটা নয়।
স্বভাবতই কলকাতা কেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম ও সংবাদ পরিবেশন ব্যবস্থায় আমতার আনিস হত্যাকান্ড নিয়ে যতটা হইচই হওয়ার কথা, বর্ধমানের বাবুরবাগ এলাকায় “গলায় দড়ি” দিয়ে ঝুলে পড়া তুহিনা খাতুনকে নিয়ে ততটা হইচই হবে না এটা জানাই ছিল।
তারওপর আবার প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে অলিখিত নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে যে “পজিটিভ” বা ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনায় জোর দিতে হবে। স্বভাবতই বেশিরভাগ মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম গুলিতেই “গলায় দড়ি”র খবর ইতিবাচকতার ফিল্টারে বাদ চলে গেছে। হাতেগোনা দু-তিনটে খবরের কাগজ একদিন মাত্র ভেতরের পাতার নীচের দিকে ছোট করে ঘটনাটির উল্লেখ করে দায় সেরেছেন। সঙ্গে নিরামিষ হেডিং এবং আলোচনা যা দেখলে ও পড়লে মনে হবে শাসকের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর পড়ছেন। ফলে বেশীরভাগ পাঠকের মনে আদৌ দাগ কাটবে না। মানে সাপও মরলো অথচ লাঠিও ভাঙলো না।
কিন্তু রাইস অফ ভয়েসেস হল একটা সামান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। আমরা সেই সমস্ত খবর আপনাদের সামনে নিয়ে আসি যেগুলি মুলস্রোতের সংবাদমাধ্যম গুলি যতটা গুরুত্বদিয়ে আপনাদের সামনে তুলে ধরা উচিৎ ছিল বিভিন্ন রকম “দায়বদ্ধতা” র কারণে, ইচ্ছে থাকলেও তা করে উঠতে পারে না। আর তাই বাংলার খুঁটিনাটিতে এবারের কিস্তিতে ‘গলায় দড়ি’ দিয়ে ঝুলে পড়া তুহিনা খাতুনের গপ্পো।
তুহিনা খাতুনের বাড়ি বর্ধমান শহরের বাবুরবাগ এলাকায়। এটি বর্ধমান পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। বাবা জুনাই শেখ এলাকার সক্রিয় তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী। আর এই ওয়ার্ডেরই গত পাঁচ-সাত বছরের পুরানো কাউন্সিলর হলেন তৃণমূল কংগ্রেসের শেখ বসিরুদ্দিন, ওরফে বাদশা।
এই বাদশার যতটা না রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা “এলাকার ত্রাস” হিসেবে পরিচিতি তার থেকে ঢের বেশি! তার বিরুদ্ধে তোলাবাজি, কাটমানি, গুন্ডামি, পথেঘাটে এলাকার মেয়ে-মহিলাদের উত্যক্ত করা ইত্যাদি একগুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। আর এমনই একজনকে সদ্য অনুষ্ঠিত পুরসভা নির্বাচনে ফের একবার তৃণমুল কংগ্রেস মনোনয়ন দেওয়ায় জুনাই শেখদের মত স্থানীয় কিছু তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
আর তারপর থেকেই জুনাই শেখ ও তার পরিবার বাদশার টার্গেট হয়ে যায়। আর জুনাই শেখের ঘরে তিন-তিনটে মেয়ে থাকায় স্বভাবতই বাদশা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কুদৃষ্টি গিয়ে পড়ে তিনবোনের দিকে। শুরু হয়ে যায় তিনজনকে ধর্ষন করে খুন করে দেওয়ার বা রাস্তায় জনসমক্ষে নগ্ন করে ফেলে পেটানোর হুমকি। এমনকি ভোটের আগে জুনাই শেখের বাড়ির দেওয়ালে তার তিন মেয়েকে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার অশ্লীল ছবিও এঁকে দিয়ে যায় বাদশার দলবল। তা নিয়ে থানা-পুলিশও হয়েছিল। স্থানীয় থানার আইসি বাদশার দলবলকে নিদান দেন দেওয়ালে আঁকা ছবিটা মুছে দিতে হবে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। এযেন পুলিশি মধ্যস্থ্যতায় সালিশি সভা বা ক্যাঙ্গারু কোর্ট! এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় শাসক আশ্রিত কোন দুষ্কৃতীকে শায়েস্তা করবার মত ঘাড়ে মাথা রাজ্যের উর্দিধারী পুলিশ বাহিনীর কারোর নেই। যদিও পুলিশের নির্দেশ আদৌ মানেনি “বাদশা” বাহিনী। বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় এলাকা জুড়ে। পাশাপাশি চলতে থাকে বাদশার সমর্থনে পুরভোটের প্রচার।
আর এলাকাজুড়ে এদের দাপাদাপিতে শাসকদলের কর্মীরই তিন মেয়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসন বা দলকে সেভাবে পাশে না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে পরিবারের প্রত্যেকে। এদিকে ভোটের দিন আর পাঁচটা পুরসভার মত বর্ধমান পুরসভাতেও সার্বিক ভোট লুঠের মাধ্যমে শেখ বসিরুদ্দিনদের জয় কার্যত নিশ্চিত হয়ে যায়। আর গত ২রা মার্চ ফলপ্রকাশ হতেই বাদশা বনে যায় ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বেতাজ বাদশা মানে নির্বাচিত কাউন্সিলর। সদলবলে এসে হাজির হয় জুনাই শেখের বাড়িতে। স্থানীয়দের দাবি তিন বোনকে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়। আর এই অপমান অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই ছোট বোন তুহিনা খাতুন নিগৃহীত হওয়ার পরপরই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গলায় দড়ি দেয়।
পুলিশ আসে। কয়েকদিন তদন্তের নামে ঘুরঘুর করে শেষ পর্যন্ত যথারীতি মূল অভিযুক্ত তৃণমূলের টিকিটে সদ্যনির্বাচিত কাউন্সিলর শেখ বসিরুদ্দিন ওরফে বাদশাকে ছেড়ে রেখে তার কয়েকজন মামুলি স্যাঙ্গাৎকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের তরফে এই মুহুর্তে কেস ধামা চাপা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চলছে। কারণ বসিরুদ্দিন স্থানীয় তৃণমূল এমএলএ খোকন দাসের ঘনিষ্ঠ।
আপাতত সামনে কোন ভোট নেই। তার ওপর বর্ধমান কলকাতা থেকে বহুদূর। আর তাই আলিমুদ্দিন স্ট্রীট বা মুরলীধর সেন লেন অথবা নবান্নর কোন দূত এখনও পৌঁছে উঠতে পারেননি তুহিনা খাতুনের বাড়ি। যায়নি ভবানীভবন থেকে কেউ। রাজভবনের ট্যুইটার স্যাভিকেও আনিস হত্যাকান্ডের মতই এক্ষেত্রেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। “নিরপেক্ষ” সুশীল বুদ্ধিজীবীদের এই ইস্যুতে কোন ট্যুইট বা বাইট এখনও চোখে পড়েনি আমাদের। মানে মুখ্যমন্ত্রীর ওপর ভরসা রেখে দোষীদের শাস্তির দাবি জানানো টাইপের নখ-দন্তহীন মন্তব্যও সামনে আসেনি তেনাদের থেকে। শেষোক্ত বক্তব্যটি পড়ে জনৈক পরিচিত জানালেন বাঘই যদি না বেরোয় “ফেউ” খামোখা ডাকতে যাবে কেন?
যদিও আমরা জানতে পেরেছি, এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই’এর বামছাত্র যুবরা তুহিনা খাতুনের খুনিদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে বর্ধমান থানা ঘেরাও ও বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করেন। ভাঙ্গরের বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকীও দেখা করেন মৃতার পরিবারের সাথে। এছাড়া কনীনিকা ঘোষ বোসের নেতৃত্বে বামপন্থী মহিলা সমিতি এআইডিডব্লুএ’র তরফেও মিছিল করা হয়। কংগ্রেসের তরফে বিশিষ্ট নেতা নেপাল মাহাতো গিয়েছিলেন তুহিনাদের বাড়ি! কিন্তু সিদ্দিকী / ঘোষ বোস /মাহাতোদের জনমানস থেকে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম বা রাজনৈতিক দলগুলি আদৌ বড় নেতা ভাবেন কি না জানা নেই। তাই নৌশাদ সিদ্দিকী / নেপাল মাহাতোরা আক্রান্তদের বাড়িতে গেলে তার ছবি-ছাবা খুব একটা পাওয়া যায় না। তারজন্য আমরা ঠিক কতটা দায়ী সে ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করা হবে অন্য আরেকদিন!
আজ আমরা ফোকাস থাকতে চাই তুহিনা খাতুনের মর্মান্তিক পরিণতির খবরটিতে! কারণ আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস। ভোটলড়া দ্বিপদী নই। আমাদের কোন বিজ্ঞাপনের সাপোর্ট লাগে না। শাসক-প্রশাসন যৌথ আক্রমণে এমন মর্মান্তিক ঘটনা কলকাতার নাকে ডগায় না ঘটলেও আমরা স্বৈরতান্ত্রিক পদধ্বনি শুনতে পাই। আমাদের পজিটিভিতে ডুবে থাকবার কোন দায় থাকে না। আর তাই আমরা জানতে চাইঃ
- যেখানে শাসকদলের সক্রিয়কর্মীর পরিবারের লোকজনদেরই তোলাবাজি গুন্ডামির প্রতিবাদ করে সামাজিক হেনস্থার শিকার হয়ে গলায় দড়ি দিতে হচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করবে কোন সাহসে?
- যেখানে পুলিশ ‘পুলিশের উর্দিপরা’ আনিস খানের আসল হত্যাকারীদের জেলে না ঢুকিয়ে হত্যার প্রতিবাদে থানা ঘেরাওকারীদের ‘পুলিশকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে’ এই অপরাধে জেলে ঢুকিয়ে দেয়, সেখানে তুহিনা খাতুনের আত্মহত্যার জন্য দায়ী মূল অভিযুক্ত কি আদৌ গ্রেপ্তার হবে? আর প্রতিবাদটাই বা করবে কে?
আর এর পাশাপাশি আমরা এটাও দেখতে চাই কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তথাকথিত জননেতারা কলকাতা-বর্ধমান দূরত্ব অতিক্রম করতে কতদিন সময় নেন বা আদৌ অতিক্রম করতে পারেন কিনা!
লুঠের ভোট হলেও মাত্র ১২%-১৩% ভোট পেয়ে যারা আমরাই প্রধান বিরোধী বলে চিৎকার করেন তাদের সেই গলার আওয়াজ কি আদৌ বর্ধমান পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতিবাদী মানুষকে ভরসা যোগাতে পারছে! আমরা তেমনটা দেখতে পাচ্ছি না।
আর তাই বাংলার মানুষকে বলবো এমন “অনুপ্রাণিত বাদশারাজ” সারা রাজ্যজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে তৈরি হয়েছে। এদেরকে রুখতে নিজেরাই সংঘবদ্ধ হোন। শাসক বা বিরোধী কোন রাজনৈতিক দলের ভরসায় থাকবেন না।
আপনারা সংঘবদ্ধ হলে এবং লাইন দিয়ে নিজের ভোট নিজে দিলে, ভোটলুঠ আর বাদশাগিরি দুই বন্ধ হবে। নিজের নিজের মেরুদণ্ড হাতড়ে খুঁজে বার করা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কোন রাস্তা নেই।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্র
a) https://www.anandabazar.com/west-bengal/bardhaman/tensions-erupted-in-the-burdwan-municipality-over-the-rescue-of-a-young-womans-body-dgtld/cid/1331738
b) https://www.anandabazar.com/west-bengal/bardhaman/sfi-organised-protest-in-bardhaman-for-tuhina-khatuns-unnatural-death/cid/1332103
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-03/202203022324381.jpg&category=0&date=2022-03-03&button=
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-03/202203022336097.png&category=0&date=2022-03-03&button=
e) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-04/202203032329271.jpg&category=0&date=2022-03-04&button=
f) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-04/202203032332163.jpg&category=0&date=2022-03-04&button=
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-06/202203052327228.jpg&category=0&date=2022-03-06&button=
Comments are closed.