তেনারা সব গেলেন কই! / Where they all have gone?

অনুপ্রেরণার ঠেলায় অশরীরীরা দলবেঁধে স্বর্গ থেকে নেমে এসে ভোটের দিন বুথে বুথে লাইন দিয়ে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন।

অথচ একদশক আগেকার সেই পরিবর্তনকামী মর্ত্যবাসী শরীরী আত্মাগুলোর হাতেগোনা দু-চারজন বাদ দিলে আর কারোর তেমন দেখা মিলছে না। এদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য “উইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার / ভোটে জিতে নেতা আমি, মুখ খুলি না আর” হয়ে গেছেন। কিন্তু বাকিরা…

মাঝরাতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে একদল পুলিশ একটা জলজ্যান্ত প্রতিবাদী ছাত্রকে তার বাড়িতে ঢুকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে খুন করে পালাল, আর তারপর প্রায় দশদিন কেটে যাওয়ার পরও পুলিশ এখনও নির্দ্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কারা খুনি! মানে পাতি বাংলায় পুলিশ এখন চোর-ডাকাত-দুষ্কৃতী দূরে থাক, পুলিশকেই খুঁজে পাচ্ছে না অথচ কারো মুখে “রা” নেই। আমরা বলছি না আবার “পরিবর্তন চাই” স্লোগান নিয়ে মাঠে নেমে পড়ুন! কারণ আমরা জানি, মাঠ খালি নেই। সেখানে এখন “খেলা হবে” বা “খেলা হচ্ছে।”

কিন্তু প্রতিবাদে একটা মোমবাতিও না জ্বালিয়ে এমন নির্বিকল্প সমাধিতে বসে পড়া কি আদৌ সমীচীন!

কেউ কেউ অবশ্য মুখ খুলছেন তবে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী এবং তার সিভিক ভলেন্টিয়ার পরিবেষ্টিত পুলিশ-প্রশাসনের ওপর নিরপেক্ষ তদন্তের ভরসা রেখে। অনেকে আবার বলছেন যদি সুবিচার পেতে দেরী হয় তাহলে পথে নামবেন, তবে আপাতত ধীরে চলো বা অন্য কথায় গ্যালারিতে বসে “খেলা দেখো” র নীতি নিয়েছেন।

কারণ আমাদের পচ্চিমবঙ্গে এখনও নাকি আইনের শাসন উঠে গিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম হয়নি! কাজেই চেঁচামেচি করবার সময় আসেনি।

কিন্তু বিগত বিধানসভা নির্বাচনের পর গত আট-ন মাসে যে কটি নির্বাচন বাংলার বুকে সংগঠিত হয়েছে তার প্রতিটিতে শাসকদল যেভাবে সমস্ত পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন মায় বিচারব্যবস্থাকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে ছাপ্পা মেরে মুড়ি-মুড়কির মত ৭০%-৮০% ভোট পেয়েছে তা যে আদতে কোন গণতান্ত্রিক পরিসরেই সম্ভব নয় সেটা যেকোন দুধের শিশু বুঝলেও, এনারা কেন বুঝতে পারছেন না বোধগম্য হচ্ছে না। বোধহয় টিকি অন্য কোথাও বাঁধা আছে! তাই “ইতনা সান্নাটা।”

এমনকি ২০১৮ র পঞ্চায়েত ভোটও একই রকম ভাবে লুঠ হয়েছিল। প্রায় ৩৩% আসনে বিরোধীদের কোন প্রার্থী ছিল না। কারণ মনোয়ন জমা দেওয়ার দিনগুলোতে শাসক মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদল স্থানীয় বিডিও বা জেলাশাসকের অফিস ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যাতে বিরোধীদল গুলির তরফে বেশি কেউ মনোনয়ন জমা দিতে না পারে। তখনও অবশ্য তেনাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

আর এমন নিশ্চুপ বদান্যতায় উৎসাহ পেয়েই বোধহয় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আনিস হত্যাকান্ড নিয়ে কিছু প্রথমসারির সংবাদ মাধ্যমে একটু হইচই হতেই, সংবাদ মাধ্যমের ভুমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রকারান্তে যা বলেছেন তার মানে করলে দাঁড়ায় এই যে সরকারের তরফে সংবাদ মাধ্যমগুলিকে বিজ্ঞাপন বাবদ মোটা টাকা দিয়ে “সাপোর্ট” করা হয়, তার বিনিময়ে সংবাদমাধ্যম গুলিরও রাজ্য এবং বর্তমান সরকারী শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশংসাসূচক বা পজিটিভ নিউজ করা উচিৎ, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা সমস্যা বেশি বেশি করে দেখানো ঠিক নয়। এমনকি বিভিন্ন ব্যবসায়ী বা শিল্পগোষ্ঠীও যেভাবে এই সমস্ত সংবাদমাধ্যম গুলিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে মোটা টাকা খরচা করেন, তার বিনিময়ে তাদের স্বার্থও নাকি সংবাদ মাধ্যমকে দেখতে হবে। এমন কোন “নেগেটিভ” খবর করা যাবে না যাতে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে। মানে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান সরাসরি প্রকাশ্যে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন ঠিক কি ধরণের খবর জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে! স্পষ্ট “quid pro quo.” অথচ এক্ষেত্রেও কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। অবশ্য পরিবর্তনকামী সুশীল বুদ্ধিজীবীদের আদৌ কেউ সংবাদ মাধ্যমে খবরটি পড়েছেন কি না সেটাও আমরা জানি না। কারণ সংবাদ মাধ্যমের তরফেও এমন গুরুত্বপূর্ণ খবরটিকে নিতান্তই অকিঞ্চিতকরভাবে ভেতরের পাতার এককোণে কোনরকমে লিখে দায় সারা হয়েছে। সামনের পাতায় বড় করে লেখবার সাহস জোটাতে পারেন নি, পাছে সরকারী “সাপোর্ট” চলে যায়।

আর এজন্যই আমাদের মতে এখন বাংলায় মূলস্রোতের প্রায় কোন সংবাদ মাধ্যমই আর নিরপেক্ষ নেই। সবাই হয় রাজ্য অথবা কেন্দ্র কোন না কোন শাসকের তৈলমর্দনে ব্যস্ত। এমনকি আনিস হত্যাকান্ডেই এক বেসরকারি বহুলপ্রচারিত টিভি চ্যানেলের মালিককে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি হয়ে আনিসের বাবা সালেম খানের কাছে হাজির হতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তা সত্বেও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর গলায় সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধের এমন স্পষ্টবার্তা শুধু বেনজির নয় বিরলও। আর তার প্রতিবাদে সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীদের মুখ না খোলাটাও যথেষ্ঠ দৃষ্টিকটু। যদিও আজকের বাংলায় এটাই এখন “নিউ নর্ম্যাল।”

আর এরপরেও যারা ভাবছেন রাজ্যে এখনও স্বৈরশাসন অধরা, তাদেরকে বলবো গত রোববার সারা রাজ্য জুড়ে হয়ে যাওয়া ১০৮ টা পৌরনিগমের ভোটে যে পরিমাণ হিংসা ও ভোট লুঠ হয়েছে সেদিকে একটু নজর বোলাতে। মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম গুলিতে কাজ করা প্রায় ডজন খানেক সাংবাদিক সেই ছাপ্পা ভোটের খবর করতে গিয়ে শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। কার্যত এমন কোন পৌরসভা পাবেন না যেখানে ভোট শান্তিতে হয়েছে। এমনকি বহু জায়াগায় শাসকদলের নিজেদের সমর্থকরাও নিজেদের ভোটটা দিতে পারেনি এমন অভিযোগও এসেছে।

আর এরপরও যদি বলেন এমন ভোট লুঠ বাংলার রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়, কাজেই হইচই করবার মত তেমন কিছু হয়নি, বাম আমলেও হত বা বিজেপি শাসিত ত্রিপুরাতেও হচ্ছে, তাহলে জানাই বাংলার জনসাধারণ আপনাদের চালচোর-ত্রিপলচোর-কয়লাচোর ইত্যাদি না ভাবলেও “ভাবের ঘরে চুরি করা চোর” ভাবতে দ্বিধা করবে না।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.anandabazar.com/west-bengal/journalists-are-attacked-in-west-bengal-municipal-election-2022-dgtld/cid/1331171
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_61712_4578525_4_71_24-02-2022_3_i_1_sf.html
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-02-24/202202232333214.jpg&category=0&date=2022-02-24&button=