মুড নেই / The main Opposition of Bengal

গতকাল সারাদিন ধরে বামেরা মিছিল, জমায়েত করলো প্রধানত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে, কিন্তু দিনের শেষে বুকফাটা আর্তনাদের শব্দ এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন শিবির থেকে।
রাজ্য বিজেপি’র সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দিনের শেষে বললেন,
“এটা বামেদের মিছিল নয়, সিপিআইএম-তৃণমূল মিলে বিরোধী শক্তি হিসেবে এ রাজ্যে বামেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতেই ‘সিপিমূল’-এর মিছিল ছিল।’’
আহা, বলো কি নন্দলাল!
ইনি হলেন সেই সুকান্ত মজুমদার, যিনি মাথায় পুলিশের হেলমেট পরে নবান্ন অভিযান করতে এসেছিলেন। যতদূর জানি, এই ধরনের হেলমেট বাজারে সাধারণত কিনতে পাওয়া যায় না। কিন্তু কেউ এই প্রশ্ন তোলেননি, সুকান্ত মজুমদার এই হেলমেট কি করে পেলেন? কেন পেলেন? কে দিলেন? উনি কি আগাম বুঝতে পেরেছিলেন মাথা ফাটতে পারে? আর কর্মীদের? তাদের মাথার কি কোনও দামই নেই? কি জানি!

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা অবশ্য ঐ একই সময় চা-জল-শীতল পানীয় সহযোগে লালবাজারে বসে ফেসবুক লাইভ করছিলেন। অবশ্য পুলিশের গাড়িতে চেপে লালবাজারে যাওয়ার আগে, তাঁর সেই কাতর আর্তি, “আমাকে গ্রেপ্তার করুন” এবং শেষমেশ নিজে নিজেই হেঁটে গিয়ে পুলিশের গাড়িতে চেপে বসা, নেট নাগরিকদের যথেষ্ট বিনোদনের উপাদান দিয়ে ফেলেছে।

আর আরেক নেতা যিনি একসময় নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণের নামে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ‘শরীরচচ্চা’ ও ‘চা-চচ্চা’ করে ফুটেজ খেতেন, তিনি অবশ্য ততক্ষণে জলকামান- টিয়ারগ্যাস-পুলিশের লাঠির সামনে মিনিট পনেরো জুঝেই রণে ভঙ্গ দিয়ে মিছিল গুটিয়ে নিয়েছেন। বলে দিয়েছেন ‘নবান্ন অভিযান’ শেষ।

আর দুর্ভাগ্যবশতঃ এঁরাই হলেন এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের প্রতিনিধি ও পরিচিত মুখ।
এমনকি এই নবান্ন অভিযানের ঠিক পরের দিন, বিজেপির দাবি মত, বিজেপির নবান্ন অভিযান নিয়ে বিধানসভায় মুলতুবি প্রস্তাব আনা হয়। জনৈক বিজেপি বিধায়ক বিধানসভা কক্ষে মুলতুবি প্রস্তাব পাঠও করেন। কিন্তু তারপর তারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সভাপক্ষে কোন আলোচনা না করে ওয়াকআউট করেন। অথচ বিতর্কে অংশ নিয়ে তাঁরা শাসক দলকে একাধিক দুর্নীতি মামলায় চেপে ধরতে পারত। এমনকি পুলিশের লাঠিচার্জ আক্রমণ নিয়ে নিন্দা প্রস্তাবও আনতে পারত। কিন্তু না। তাঁরা তা করেননি, কারণ তাঁদের নাকি সেদিন আর মুড ছিল না। হ্যাঁ, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করায় জনৈক বিজেপি বিধায়ক এই উত্তরই দিয়েছেন! মানে যা দাঁড়ালো তা হল বঙ্গ বিজেপি অনেকটা মুডের ওপর চলে! পরে অবশ্য আরেকটু খোঁজ খবর করতে জানা গেল, সেদিন সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজেপির ৭৭ জন বিধায়কদের মধ্যে মাত্র ১৭ জন। বাকিরা কেউ মুলতুবি প্রস্তাবের সময় উপস্থিত ছিলেন না। কারণ আগেরদিন নবান্ন অভিযানের নামে টানা ফুটেজ খেয়ে সবাই কম-বেশি ক্লান্ত! তাই বেশিরভাগই আর বিধানসভায় আসেননি।
এমন একদল অপদার্থ জনপ্রতিনিধি-নেতাদের নিয়ে যে বিরোধীদল তৈরি তাদের দিয়ে কি আর রাস্তায় বা বিধানসভায় স্বৈরাচারী শাসকের মোকাবিলা করা সম্ভব! স্পষ্ট উত্তর না। শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক দুর্নীতি, পাচার মামলা, মুখ্যমন্ত্রীর সভা থেকে বেসরকারি এবং ভুয়ো নিয়োগপত্র প্রদান, স্বাস্থ্য দুর্নীতি, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষক আত্মহত্যা (যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ), একশ দিনের কাজ, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে সুবিধা প্রদানের ব্যর্থতা, ডিএ দাবি ইত্যাদি জ্বলন্ত ইস্যুগুলো নিয়ে শেষ কবে বিধানসভায় আলোচনা হয়েছে তা বিগত একবছরে বিধানসভার কার্যবিবরণীতে খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে বেড়াবার মত খুঁজতে হবে। সেভাবে দেখলে বাম-কংগ্রেস শূন্য বিধানসভা পেয়েও তাঁর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে বঙ্গ বিজেপি এখনও পর্যন্ত পুরোদস্তুর ব্যর্থ। এদিকে নিন্দুকেরা সেই সুযোগে বলছেন এসবই নাকি সেটিং কেস বা ছদ্ম-বিরোধিতার ফল! যেখানে বিরোধী দলনেতা বর্তমান শাসকদলের প্রাক্তন মন্ত্রী, যেখানে বিরোধী দলের রাজ্য সভাপতি, শাসক দলের শিক্ষক সংগঠনের প্রাক্তন নেতা, সেখানে এমনটা হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক!

অথচ রাজনীতি বলে কথা, বাগাড়ম্বর তো কম হলে চলে না! মিডিয়ার সামনে কিছু ফাঁকা আওয়াজ, কুৎসিত ভঙ্গি এবং চটকদারি কথা বলে নিজেদেরকে পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় বাঁচিয়ে রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই আড্ডাবাজরাই ভোটার। এঁরাই হাওয়া তোলেন। কাজেই মুখ্যমন্ত্রী থেকে অন্যান্য মন্ত্রী, এমনকি বিরোধী দলনেতা সকলেই একে অপরকে কুৎসিত নোংরা আক্রমণে বিদ্ধ করছেন। রাজ্যের নানান সামাজিক ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গায় চলছে চরম ব্যক্তি রাজনীতি। শুনছি, এসব করলে নাকি টিআরপি বাড়ে, তাই সংবাদমাধ্যমও এইসবেই মজে।
তবে এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষ, মানে ঐ আড্ডাবাজের দল, তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক কিছুই উপলব্ধি করছেন। তাদের মুখ খুলছে। সরকার আর প্রধান বিরোধী দল, তারা কি আদৌ সুস্থ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজের পক্ষে, এই প্রশ্নও উঠে গেছে। আর তাই “খেলা হবে” স্লোগান’টার কাটতি বাজারে এখন পড়তির দিকে, আর তেমন মানুষ আগের মতন খাচ্ছে না।
খেলা হয় মাঠে ময়দানে বিনোদনের উদ্দেশ্যে। সেখানে যেমন বাঁশি বাজিয়ে খেলা শুরু হয়, ঠিক সেভাবেই লম্বা বাঁশি বাজিয়ে খেলা শেষ হয়। আর তারপর? খেলোয়াড়রা যায় ড্রেসিংরুমে, আর মানুষ যায় নিজের নিজের গন্তব্যে, নিজের বাড়িতে।

বাংলার মানুষও এখন খেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক চাইছেন! চাইছেন বাড়ি ফিরতে। কারণ খেলা শেষ না হলেও অন্তিম ফলাফলটা তাঁরা অনেকেই আন্দাজ করতে পারছেন। ‘খেলা হবে’র ডঙ্কা যতই বাজুক, তাদের কপালে যে শেষ পর্যন্ত লবডঙ্কাই জুটবে সেটা তাঁরা বুঝে গেছেন। তাই তাঁদের আর ড্রেসিংরুমে উঁকি মেরে বিজেপি-তৃণমূল কুশীলবদের দেখবার “মুড নেই”।
ধন্যবাদান্তে,
অঞ্জন মুখোপাধ্যায়
Comments are closed.