সেটিং – সত্যি না মিথ্যা? / Bijemool Theory! Right Or Wrong?

মিডিয়াতে আজ হঠাৎই কয়েকটি চ্যানেল প্রশ্ন তুলেছে, বাম-কংগ্রেসের সেটিং তত্ত্বের বা বিজেমূল তত্ত্বের কোন গ্রহণযোগ্যতা আর রইল কি? যেখানে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় হাজতে গেলেন, তারপরে মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী তিন-তিনবার দিল্লিতে সাক্ষাত করার পরেও গ্রেফতার হলেন বীরভূমের অনুব্রত। ঠিক এই জায়গা থেকেই এই প্রশ্ন তুলেছে কয়েকটি সংবাদসংস্থা। খুবই ভ্যালিড প্রশ্ন, তাই আমরা রাইস অফ ভয়েসেসও ভাবতে বসলাম, সেটিং কি সত্যিই আছে, নাকি পুরোটাই গিমিক অথবা ঐতিহাসিক ভূল? সেই নিয়ে খোড়াখুড়ি করতেই উঠে এলো কয়েকটা প্রশ্ন, যার উত্তর আমরা উদ্ধার করতে পারিনি।

১) ২১শে জুলাইয়ের আগে, আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে তল্লাশির প্রাক্কালে কয়লা কাণ্ডের প্রাথমিক চার্জশিট থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বাদ পড়াটা কি কাকতালীয়? ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মাননীয়ার “সিবিআই/ইডি ধরতে এলে ভয় পাবেন না তো” বলাটাও কি কাকতালীয়? পার্থ চট্টোপাধ্যায় “ষড়যন্ত্র” বলে কাদের ইঙ্গিত করেছেন? কুনাল ঘোষ আর ধর্মেন্দ্র প্রধানের হটাৎ দেখা হয়ে যাওয়া, কাকতালীয়? উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূলের অনুপস্থিতিও কি কাকতালীয়? এই নিয়ে সম্পূর্ন প্রতিবেদন পড়ে নিতে পারেন, রাইজ অফ ভয়েসেসের “আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে” প্রতিবেদনে।

২) সারদা কাণ্ডের কি হল? আজ পর্যন্ত এথিক্স কমিটির একটাও বৈঠক হয়নি কেন? সেই কাণ্ডে অভিযুক্তদের কেউ আজ শাসক দলের মুখপাত্র, কেউ বিধায়ক, কেউ আবার সাংসদ। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও, মাঝে মাঝে জেল থেকে সুদীপ্ত সেন নালিশ করে দু-চারটে চিঠি লেখেন, বা বিবৃতি দেন। কিন্তু শাস্তি হল কই? প্রতারিতরা টাকা ফেরৎ পেলো কই?

৩) আইপিএস রাজীব কুমারকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে এলে মুখ্যমন্ত্রী ৭০ ঘন্টা ধর্না দিতে পারেন, কিন্তু মন্ত্রী পার্থ বা জেলা সভাধিপতির গ্রেফতারীতে কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে ফেলেন কেনো?

৪) বর্তমানে তৃণমূলের সাধারণ নেতারা (যারা প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাধারণত মিটিংয়ের সুযোগ পান না) বারে বারে শুভেন্দু অধিকারীর দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো অভিযোগ আনেন না কেন? নন্দীগ্রামের লোডশেডিং করে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগের মামলার অগ্রগতি কোথায়? কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতা সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে তিনদিনে চারটি এফআইআর হতে পারলে, শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?

৫) মুকুল রায়, বিশ্বজিৎ দাস, শিশির অধিকারী, সৌমেন্দু অধিকারী বর্তমানে কোন দলে আছেন? দল বিরোধী কার্যকলাপের জন্যে লোকসভা বা বিধানসভার কোনো স্পিকারই পদক্ষেপ নিচ্ছেন না কেন?

৬) কাগজে কলমে বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসকে কেন তৃণমূলের সাংগঠনিক জেলা সভাপতি করা হয়েছে? এছাড়াও বিজেপি’র টিকিটে জিতে দলবদল করেছেন, মুকুল রায়, তন্ময় ঘোষ, সৌমেন রায় এবং কৃষ্ণ কল্যাণী। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সবার ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র স্পিকারকে চিঠি দিয়েই ক্ষান্ত হলেন কেন?

৭) তৃণমূল সমর্থকের হাতে মার খেয়ে কচুবনে পড়ে যাওয়া নেতা অথবা সারদা কাণ্ডে রাজ্য পুলিশের হাতে নিগৃহীত এবং দলনেত্রীকে অতীতে কুকথা বলা নেতা কিভাবে দলের মুখপাত্র হয়ে যান?

৮) বাবুল বা জিতেন, কিভাবে দুটো ফুলেই টুক করে ফিট করে যান? শয়ে শয়ে নেতা-কর্মীরা এত সচ্ছভাবে শিবির বদল করেন, আবার তারপর নির্বিঘ্নে ফিরে চলে আসেন কোন জাদুতে?

৯) মুখে বিরোধী ঐক্যের কথা বলে, তৃণমূল কেন দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ভিন রাজ্যের ঘর থেকে নেতা ভাঙ্গিয়ে নিজের দলে আনেন?

১০) ইলেক্টোরাল বন্ডের সবথেকে বেশি বিক্রি কলকাতার স্টেট ব্যাংকের শাখার থেকে হয়েছিল কেন?

১১) হাজারো অভিযোগ থাকা সত্বেও শুভেন্দু অধিকারী বা বিশ্বজিৎ কুণ্ডুর বিরুদ্ধে সিআইডি এবং সিবিআই দুজনেই চুপ কেন? মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে বলেছিলেন অধিকারী পরিবার নন্দীগ্রামে মাওবাদী ঢুকিয়েছিল পুলিশের পোশাকে, তার কোন তদন্ত সিআইডি রুজু করলো না কেন?

১২) সম্প্রতি হলদিয়ার বিজেপি বিধায়িকা তাপসী মণ্ডল, বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে বলে বসেন, ‘‘মোদী-দিদির মধ্যে সেটিং হলেই বা তাতে অসুবিধে কোথায়!’’ সূত্রের খবর, শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত হননি উনি৷ তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে, ‘‘দলটার যা অবস্থা, তাতে মোদী-দিদির সেটিং হলে এরাজ্যে ভালই হবে বিজেপির! কারণ, এভাবে সংগঠনকে ঘুরে দাঁড়ানো খুবই চাপের বিষয়৷’’ এত কিছু বলার পরেও বিজেপি ও তৃণমূলের তাবড় তাবড় নেতারা একটিও শব্দ খরচ করলেন না কেন? এরপরে সাংবাদিকদের সামনে রাজ্য বিজেপি’র চিফ হুইপ মনোজ টিগ্গা, “এটা তাপসীর ব্যক্তিগত মতামত” বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কেন?

১৩) নারদ কেলেঙ্কারির কি হল? এর আগে কুনাল, মদন, সুদীপ জেল খেটে এলেও তাদের শাস্তি হয়নি কেন? পার্থ, অনুব্রতর ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?

১৪) গরু পাচার কাণ্ডে অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হলেও, এই তদন্তে বগটুই কান্ড থেকে পুরোনো কেসগুলো যুক্ত করা হবে কি? এখনো অবধি যা জানা যাচ্ছে, অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে এখনো দুর্নীতি দমন আইনের ৭, ১০, ১১, ১২ ধারায় এফআইআর রুজু হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় দন্ডবিধির ১২০(বি) ধারায় এফআইআর রুজু হয়েছে। তাই আজ যারা আনন্দিত হয়ে, বা বেশি উত্তেজিত হয়ে গুড় বাতাসা বিলি করেছিলেন, তারা ভেবে দেখুন, ইনি বেরিয়ে এসে পুরনো ফর্মে ফিরে গেলে চাপ সামলাতে পারবেন তো? স্বাধীনতার মত, ভয় পাওয়াটাও এই দেশে অলিখিত জন্মগত অধিকার।

১৫) রাতারাতি গ্রামে গ্রামে “বাংলা সড়ক যোজনা”র নাম পাল্টে এক্কেবারে নীরবে “প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা” হয়ে গেল কি করে?

এসবের উত্তর এখনো অধরা, তাই সেটিং এখন ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে বা পৌঁছায়নি, সেটা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত কঠিন। ঘটনাপ্রবাহ দেখে যা মনে হচ্ছে, তাতে সাধারণ ভাবে দুটো তত্ত্ব উঠে আসছে। প্রথম তত্ত্ব গোটা তৃণমূল দলটাই এখন পুরোপুরিভাবে বিজেপি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রীপে চলে এসেছে, বিশেষ করে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা-নেত্রীরা। তাই আমাদের মনে হয়েছে যেভাবে খেলানো হচ্ছে, সেভাবেই খেলা হচ্ছে। দ্বিতীয় তত্ত্ব অনেকটা এমন যে, তৃণমূল মোটেই গ্রিপে চলে যায়নি, তবে গ্রিপ করার একটা আদ্যপান্ত চেষ্টা চলছে। এই মুহুর্তে বঙ্গ বিজেপি’র যা অবস্থা, তাতে দেখা যাচ্ছে সামনের পঞ্চায়েত ও লোকসভায় তৃনমুলের সদয়তা না পেলে সংগঠনহীন, নেতৃত্বহীন বিজেপি কিছুই আর করতে পারবে না। আগেরবার তৃণমূলদের ধোলাই দেয়ার লোভে যারা চোখ কান বুজে বিজেপি কে ভোট দিয়েছিল, তারা এক্সট্রিম ভোলাটাইল, জাস্ট সরে নিজের নিজের শিবিরে ঢুকবে। আর এই ক্যালকুলেশন বিজেপির আছে বলেই গুটি গুটি বোড়ে খেয়ে এগোচ্ছে, রানী কম্প্রোমাইজ করুক এটাই চায় তারা। তাহলে রানী কম্প্রোমাইজ করবে কি? সেই উত্তর একমাত্র সময় দিতে পারবে।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস