নির্বাচনী বন্ড : কর্পোরেট তোলাবাজি / Corporate Extortion

“দেশের কথা” র প্রথম পর্বে নির্বাচনী ঋণপত্র বা ইলেক্টোরাল বন্ড যে আদতে দেশ ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলির বিভিন্ন কর্পোরেট থেকে টাকা তোলার এবং তার বিনিময়ে প্রশাসনিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার খিড়কি পথটিকে লুকিয়ে ফেলবার নির্ভেজাল ষড়যন্ত্র, তা আগেই আমরা জানিয়েছিলাম। আপনারা ক্রসচেক করবার জন্য আমদের নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।

আর আমরা যে এব্যাপারে সঠিক ছিলাম আরেকবার তার হাতেনাতে প্রমাণ আপনাদের সামনে আনবার চেষ্টা করছি। আবশ্য এমন প্রমাণ আগেও দিয়েছি। আগামী দিনেও আপনাদের সামনে আনব। আর আপনারাও সময় করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। কারণ এসব খবর নিয়ে মুলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে আপনি কোন টক শো বা ডিবেট প্রাইম টাইমে পাবেন না। পাবেন না কোন ব্রেকিং নিউজ বা হেডলাইন। কারণ এরা সবাই কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলগুলোর থেকে “সাপোর্ট” নেয় এবং তাই তাদের সম্পর্কে কোন নেগেটিভ খবর সামনে আনে না।

আপনাদেরকে আমরা জানিয়েছিলাম ২০১৯ সাল নাগাদ এই ইলেক্টোরাল বন্ডের বিরুদ্ধে দেশের দুটি এনজিও এবং একটি রাজনৈতিক দল সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। এনজিও দুটি হল Association of Democratic Reforms (ADR) এবং Common Cause। আর রাজনৈতিক দলটির নাম সিপিআই(এম)। তারা দাবি জানায় ইলেক্টোরাল বন্ডের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার। কিন্তু তিনজন জজ সাহেবের বেঞ্চ – ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগোই, বিচারক দীপক গুপ্তা এবং বিচারক সঞ্জীব খান্না মামলাটি প্রাথমিকভাবে শুনলেও কোন স্থগিতাদেশ দেননি। শুধু বিশদে শুনবেন বলে পরবর্তী শুনানির অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু তারপর থেকে এই মামলা কোন “অজ্ঞাত” কারণে আর তেমন এগোয়নি। কারণ দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের শোনবার সময় হয়নি। কিন্তু তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। আগেকার প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগোই অবসর নিয়েছেন এবং বিজেপির সমর্থনে রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হয়েছেন। দেশের নতুন প্রধান বিচারপতি হয়েছেন এন ভি রামানা। আর মূলতঃ এনার পৌরহিত্যেই তিন বিচারকের ডিভিশন বেঞ্চ, যার অপর দুজন সদস্য হলেন বিচারপতি কৃষ্ণ মুরারি এবং বিচারপতি হিমা কোহলী, গতকাল জানিয়েছেন যে, শীঘ্রই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে এই দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলার শুনানি হবে।

আর ঠিক সেই সময় আমরা আবারও জানতে পারছি, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা তোলায় সবথেকে বেশি লাভবান হয়েছে কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি। এবারের সূত্র স্বয়ং নির্বাচন কমিশন এবং অ্যাসোসিয়েশান ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস। দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মোট জমা পরা আর্থিক অনুদানের ৭৫% ভাগ বা তার বেশি পরিমাণ টাকা লাগাতার ভাবে বিজেপির কোষাগারে ঢুকেছে। সেখানে দ্বিতীয় কংগ্রেসের কপালে জুটেছে মাত্র ৯%।

কিন্তু এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা নামটি খুবই চমকপ্রদ। আমাদের রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ পশ্চিমবঙ্গের মত দেশের তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল রাজ্যের শাসকদল বলে কথা! তাকে তুষ্ট না করলে চলে! আর কি রকম তুষ্টিকরণ তার হাতেনাতে প্রমাণটাও গতকালই সামনে চলে এসেছে।

সংস্থার নাম আইএফবি অ্যাগ্রো ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেড। শেয়ার মার্কেটে লিস্টেড জনপ্রিয় মদ প্রস্তুতকারক সংস্থা। এঁদের ফ্যাক্টরি রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগণার নুরপুরে। এলাকাটি মুখ্যমন্ত্রীর “ভাইপো” সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ডহারবারের অন্তর্ভুক্ত। তা সেই সংস্থা এক্সচেঞ্জের বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী স্বীকারোক্তি বা ডিকলারেশনে জানিয়েছে, ২০২০ সালে ২৬ শে জুন এবং ২২ শে ডিসেম্বর দুদফায় দেশজোড়া মহামারী ও লকডাউনের মাঝেই শ’দেড়েক সশস্ত্র দুষ্কৃতী তোলা চেয়ে হামলা চালায় তাদের নুরপুর ফ্যাক্টরিতে। যেহেতু বছরে প্রায় ২৫ কোটি বোতল মদ প্রস্তুত করে সংস্থাটি, তাই বোতল প্রতি ২ টাকা দরে ৫০ কোটি টাকা দাবী করা হয়। হামলার কথা লোকাল পুলিশকে জানানো হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ হামলাকারীদের নেতা মেহবুব গায়েন শাসক ঘনিষ্ঠ এবং “ভাইপো” শিবিরের লোক বলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে দাবী করা হয়েছে। এমনকি রাজ্য সরকারের অধীনস্থ আবগারী সংস্থার কর্মীদের দিয়ে রাজ্যজুড়ে সংস্থাটির মদ বিপণনে নানারকম বাধার সৃষ্টি করা হয়। হেনস্থা করা হয় সংস্থার কর্মরত প্রতিনিধিদের। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং শিল্পমন্ত্রীদের বিষয়টির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষনও করা হয়েছিল বলে জানায় সংস্থাটি তার ডিক্লারেশনে। কিন্তু তেমন কোন সুরাহা হয়নি।

ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই অক্টোবর ৭, ২০২১ সালের বোর্ড মিটিং-এ সংস্থাটি ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জন্য ২৫ কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে সম্মত হয়। আর ফের একবার ৩১ শে মার্চ ২০২২ সালের বোর্ড মিটিংএ সংস্থার তরফে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জন্য ৪০ কোটি টাকা নির্বাচনী বণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক অনুদান দেওয়ার ব্যাপারে মঞ্জুরি দেওয়া হয়েছে। আর এরফলে শিল্পক্ষেত্রে শাসকের “তোলাবাজি” রাজ্যের ভবিষ্যৎ শিল্প সম্ভাবনার পথে যে প্রধান অন্তরায়, তা ফের একবার সামনে চলে এল বলে মনে করছে রাজ্যের শিল্পমহলের একটা বড় অংশ।
কাজেই এভাবে দিনের পর দিন “এভিল” কে লেসার বানিয়ে মহিমান্বিত করে “দুয়ারে ডেভিল” প্রকল্পের ফিতে কেটে লাভ নেই। আর চোখে নির্বাচনী বন্ডের “ব্যান্ডেজ” বেঁধে কালাধন নিধনের স্বপ্ন দেখেও লাভ নেই।

আমাদের বুঝতে হবে সত্যের প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সবার আগে সত্যকে স্বীকার করবার প্র্যাকটিস থাকা প্রয়োজন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.anandabazar.com/india/bjp-received-highest-corporate-donations-adr-dgtl/cid/1337245
b) https://indianexpress.com/article/india/we-will-hear-it-supreme-court-on-pending-pleas-challenging-electoral-bond-scheme-7853963/
c) https://www.business-standard.com/article/companies/ifb-agro-board-approves-contributions-up-to-rs-40-cr-to-political-parties-122040101406_1.html
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-04-06/202204052332571.jpg&category=0&date=2022-04-06&button=
e) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-04-06/202204052332572.jpg&category=0&date=2022-04-06&button=