ইলেক্টোরাল বন্ড : গৌরী সেন কারা? / Electoral Bonds

২৬ শে জানুয়ারি । প্রজাতন্ত্র দিবস ।

এই দিনটা হল আমাদের পড়ায় পাড়ায় সক্কাল সক্কাল পতাকা তোলবার দিন! আবেগঘন কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার দিন। সঙ্গে বন্দেমাতরম এবং সারে যাঁহাসে আচ্ছা। এখন মহামারী তাই এবার প্রভাতফেরী বা সেরকম কিছু হয়নি। ফলে এরপর বাড়ি ফিরে বেলা পর্যন্ত টিভিতে বসে লালকেল্লা থেকে সম্প্রচারিত সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখা হল। ট্যাবলো দেখে ঘরে বসেই হাততালি দেওয়া হল! সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক-ফাইটার প্লেন–ক্ষেপনাস্ত্র ইত্যাদি প্রদর্শনের সময় পাকিস্তান আর চীন কে মনে মনে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া হল! আর তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যে নামতেই নিখাদ একটা ছুটির দিন কাটিয়ে আবার নিজের নিজের আত্মকেন্দ্রিক খুপরিতে ফিরেও আসা হল।

কিন্তু সেই ফিরে আসবার আগে আগে সান্ধ্য সন্ধিক্ষণে “রাইজ অফ ভয়েসেস”-এর মনে হল আজ থেকে ৭২ বছর আগে আজকের দিনে ভারতীয় সংবিধানকে কার্যকরী করার মধ্যে দিয়ে যে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ নেওয়া হয়েছিল তা আজ কিভাবে খিড়কির দরজা দিয়ে আইনের ফাঁক ফোকর গলে লুঠ হচ্ছে সেটা একটু আপনাদেরকে জানানো জরুরি। কিভাবে আমাদেরকে নিতান্তই প্রজা বানিয়ে রাজনৈতিক নেতারা রাজা-উজির মারবার পাকা বন্দোব্যস্ত করেছেন বা করছেন সেটা নিয়ে দু-চার কথা লিখতে ইচ্ছে হল আমাদের!আর এভাবেই শুরু হল লেখাটা। যদিও তখনই জানতাম পুরো প্রতিবেদনটা লিখতে কয়েকদিন সময় লাগবে। ফলে আপনারা হয়ত লেখাটা পড়বেন প্রজাতন্ত্র দিবসের এক সপ্তাহ-দশদিন পর। তাই নিজেদের পেশাদারী কর্ম ব্যস্ততার কারণে সময়মত প্রতিবেদনটি আপনাদের সামনে না আনতে পারবার জন্য তাই আমরা নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী।

যাইহোক এবার ফেরা যাক মূল বিষয়ে। ভারী ভারী আইনি কথা বাদ দিলে গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের আসল কথাই হল জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশ চালাবে। আর তাই সবার অলক্ষে এখানেই গ্যাঁড়াকলটা করা হচ্ছে! মানে যাকে বলে ক্রোনোলজি মেনে একদম শুরুতেই! ভোট তো আর মাঙ্গনায় হয় না! দেশের সব স্বীকৃত রাজনৈতিক দলেরই সেসব আয়োজন করতে নিজের নিজের প্রার্থীদের হয়ে প্রচার করতে “নোট” মানে টাকা লাগে! এখন আগে সেই টাকা আসত মূলতঃ সাধারণ মানুষদের থেকে চাঁদা তুলে বা অনুদান নিয়ে। আর সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকেই বছরের শেষে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসেব জমা দিতে হত নির্বাচন কমিশনের কাছে। এমন কি কোন ব্যক্তি বা সংস্থার থেকে ২০,০০০ টাকার বেশি অনুদান নিলে তা সেই হিসেবের সাথে প্রকাশ করতে হত।

এখন এই চাঁদা তোলা বা অনুদান নেওয়ার পুরো ব্যাপারটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হত কাঁচা টাকায়। ফলে অসাধু ধনী ব্যবসায়ীদের একাংশ তাদের কালো টাকা রাজনৈতিক অনুদান দিয়ে সাদা করে ফেলতেন এবং বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলির থেকে মূলতঃ কেন্দ্র বা রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসক দলগুলির থেকে নানাবিধ ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধা আদায় করতেন বলে অভিযোগ ছিল বহুদিনের। এছাড়াও বলা হত যারা শাসক বিরোধী শক্তিকে বড় অঙ্কের অনুদান বা চাঁদা দিয়ে সাহায্য করতেন যেহেতু তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করতে হত রাজনৈতিক দল গুলিকে তাই তাদেরকে নিবার্চন পরবর্তী সময় বিজয়ী শাসকদলের অঙ্গুলি হেলনে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নানাভাবে হেনস্থা করা হত।

তাছাড়াও আরও একটি অসৎ উপায় অবলম্বন করতো রাজনৈতিক দলগুলি। তারা বড় অঙ্কের টাকা নগদে চাঁদা বা অনুদান হিসেবে নিয়ে সেটিকে ১৯,৯৯৯ টাকার ছোট ছোট রসিদে ভাগ করে দিতেন। এরফলে অবশ্য যিনি বা যাঁরা চাঁদা দিচ্ছেন তাদের নাম-ধাম আর আলাদা করে প্রকাশ করতে হত না। ফলে একটু ঘুরিয়ে কালো টাকা সাদা হতেই থাকলো।

আর সেটা বন্ধ করতেই ২০১৭ সালের বাজেটে এল সেই অভাবনীয় মাস্টারস্ট্রোক যার নাম ইলেক্টোরাল বন্ড বা নির্বাচনী ঋণপত্র! অন্তত তেমনটাই দাবি করা হয়েছিল । কিন্তু সত্যি কি তাই!

সেটাই জানবার চেষ্টা করব এই লেখাতে।

ইলেক্টোরাল বন্ড বা নির্বাচনী ঋণপত্র জিনিষটা ঠিক কি!

  • এটা হল একটা ঋণপত্র যা শুধুমাত্র স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সারাদেশের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি অনুমোদিত শাখা থেকে বিক্রি করা হবে। এর জন্য সরকারের তরফ থেকে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে কমিশন দেওয়া হবে।
  • বছরে চারবার জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই এবং অক্টোবর মাসে প্রতিবার ১০ দিনের জন্য এই ঋণপত্র বিক্রি করা হবে। তবে দেশের সাধারণ নির্বাচন মানে লোকসভা নির্বাচনের সময় এই সময়সীমা বাড়িয়ে ৩০ দিন পর্যন্ত করা যাবে।
  • ঋণপত্রগুলি এক হাজার টাকা, দশ হাজার টাকা, এক লক্ষ টাকা, দশ লক্ষ টাকা অথবা এক কোটি টাকার এককে বা ডিনমিনেশানে বিক্রি হবে।
  • যে কোন ভারতবর্ষের নাগরিক মানে ব্যক্তি, সংস্থা, ট্রাস্ট, পার্টনারশিপ ফার্ম এনজিও ইত্যাদি প্রায় সবাই যাদের নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র /প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক নথিপত্র আছে তার প্রয়োজনীয় প্রতিলিপি বা কপি ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে তারা এই ঋণপত্র কিনতে পারবে। শুধু তাই নয় যত ইচ্ছে কিনতে পারবে।
  • এই ঋণপত্র মুলতঃ কেনা যাবে চেক বা ডিম্যান্ড ড্রাফট বা অনলাইন ব্যাঙ্কিং পদ্ধতিতে। নগদ টাকায় কেনা যাবে না।
  • স্টেট ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট অনুমোদিত শাখা থেকে এই ঋনপত্র বা বন্ডের কপি নিয়ে ক্রয়কারী ব্যক্তি বা সংস্থা তার পছন্দের রাজনৈতিক দলের দপ্তরে সেটি জমা করে দেবেন।
  • রাজনৈতিক দলগুলি সেই ঋণপত্র ইস্যু হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্টেট ব্যাঙ্কের শাখার মাধ্যমে নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঋণপত্রের ডিনমিনেশানের সমপরিমাণ টাকা ট্রান্সফার করিয়ে নিতে পারবেন। মানে এটি অনেকটা বেয়ারার চেকের মত।
  • এই ঋণপত্রের ওপর ক্রয়কারী অথবা বেনিফিসিয়ারি বা উপভোক্তা কারোর কোন নাম লেখা থাকে না। ফলে কে কোন দলকে কত টাকা দিল তা কেউই জানতে পারবে না। এই গোপনীয়তা বজায় থাকায় যে নির্বাচনোত্তর হেনস্থার কথা আমরা বলেছিলাম তা আশাকরা হয়েছিল বন্ধ হয়ে যাবে।
  • ১৫ দিনের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে এই টাকা চলে যাবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে।

এতটা পড়ে যারা ভারত মাতা কি … হাঁক পাড়বেন বলে ঠিক করছেন তাদেরকে জানাই ধীরে বন্ধু! বাকিটা পড়ুন আগে !

আইন তুমি কার! প্রশ্ন গুপী-বাঘার!

আমরা হলাম গিয়ে “ভূতের রাজার বর” পাওয়ার আগে যে আনাড়ি গুপী/বাঘা ছিল তাদের মতই অজ্ঞ আম জনতা!
টিভিতে যা দেখায় খবরের কাগজে যা লেখে সেটাকেই আমরা ধ্রুব সত্য বলে মানি। আর সেই জানাটাই ইভিএম অবধি আমাদের যাওয়াটাকে, বোতাম টেপাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানে এই সংবাদ মাধ্যমই হল আমাদের কাছে ভূতের রাজা! কাজেই এরা যখন মাস্টারস্ট্রোক বলেছে তখন ইলেক্টোরাল বন্ড ব্যাপারটা নিশ্চয়ই দারুণ কিছু হবে এমনই একটা ধারণা হয়েছিল আমাদের! আর তাই সেইমত গুপী-বাঘার মত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়িয়েছি সব্বাইকে! বেশ দিব্যি টাইট দেওয়া গেছে বড়লোক গুলোকে! পলিটিকাল পার্টি গুলোকে!

এদিকে এই বন্ডকে বৈধতা দিতে গিয়ে সরকারের তরফে ২০১৭ সালের বাজেটের মাধ্যমেই যেভাবে পটাপট কিছু গুরত্বপূর্ণ সরকারী আইন কানুন বদলে ফেলা হল তার খোঁজ নিলাম না। কিন্তু এখন যতই সেইসব তথ্য সামনে আসছে তত প্রশ্ন জাগছে মনে! তাই আসুন প্রথমে এই বিভিন্ন বদলে ফেলা আইন গুলো জানি এক এক করে! তাহলেই বোঝা যাবে ঠিক কতটা টাইট দেওয়া গেছে বড়লোক গুলোকে বা পলিটিকাল পার্টিগুলোকে!

Section 13A of Income Tax Act,1961
এখানে বলা হল কোন রাজনৈতিক দল কারোর থেকে ২০০০ টাকার বেশি অনুদান বা চাঁদা নগদে নিতে পারবে না। মানে আপনি আপনার পছন্দের কোন দলকে ২০০০ টাকার বেশি চাঁদা দিতে ইচ্ছে হলে আপনাকে দিতে হবে নির্বাচনী ঋনপত্র বা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে।

এর মানে যা দাঁড়াল তা হল আগে আপনি কোন রাজনৈতিক দলকে ৩০০০ টাকা নগদে চাঁদা দিলে সেটা ঐ নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল আর আপনি ছাড়া আর কেউ জানতে পারত না। আর এতে আপনার আপত্তি থাকবার কথাও নয়।
কিন্তু এখন হয় আপনাকে অন লাইন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ঐ দলের তহবিল অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করতে হবে অথবা ইলেক্টোরাল বন্ড এর মাধ্যমে অনুদান দিতে হবে। অন লাইন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সাথে অনেকেই এখনও সড়গড় নন। এখন তাই আপনি যদি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দেন দেন সেক্ষেত্রে আপনি এবং ঐ রাজনৈতিক দল বাদে জানতে পারবে আরেক জন। তার নাম স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। কারণ সেখানে আপনি আপনার পরিচয়পত্রর মত গুরুত্বপূর্ণ নথি জমা দিয়ে তবেই ঐ বন্ডটি কিনছেন। এখন ব্যাঙ্কের যে নির্দ্দিষ্ট অনুমোদিত ব্রাঞ্চের মাধ্যমে আপনি সেই ঋণপত্র কিনছেন সেখানকার কোন কর্মীর মাধ্যমে সেই তথ্য যে কোন রাজ্যের শাসকদলের হাতে চলে আসতেই পারে। এমনকি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি ব্যাঙ্ক তাই সেই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের কাছেও যাওয়া বিচিত্র নয়। কাজেই যে গোপনীয়তাকে ঢাল করে এই ঋণপত্রের সূচনা তা আদৌ রক্ষিত হচ্ছে না। বরং কেন্দ্র বা রাজ্যে ক্ষমতাসীন শাসকদলের হাতে সেই তথ্য চলে আসা আরও সহজ হবে এবং এতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের পক্ষে নির্ভয়ে বড় অঙ্কের আর্থিক সাহায্য দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।

Section 29C of Representation of Public Act, 1951
এই আইনে বলা ছিল কোন রাজনৈতিক দল একলপ্তে ২০,০০০ টাকার বেশি অনুদান বা চাঁদা কোন ব্যক্তি বা সংস্থার থেকে নিলে ঐ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার নাম-ধাম সহযোগে আলাদা বিবরণ বা রিপোর্ট ইলেকশন কমিশনকে জানাতে হবে।

কিন্তু Section 137 of the Finance Act 2017 এর মাধ্যমে এই আইনে একটি নতুন অংশ সংযুক্ত করে বলা হল যদি কোন টাকা, সে ২০,০০০ টাকার বেশি হলেও যদি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া হয় তাহলে দাতার নাম-ধাম জানাবার দরকার নেই।

মানে সেই একই। বন্ডের দাতাদের গোপনীয়তার বর্ম দিতে গিয়ে কার্যত তাদের পরিচয় শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন শাসকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হল। আর বিরোধীদল গুলির পক্ষে বড় অঙ্কের অনুদান যোগাড় করা কঠিন করে দেওয়া হল। কেউই বিরোধী দল গুলোকে বড় অঙ্কের অনুদান দিতে চট করে রাজী হবে না। কারণ পরবর্তী কালে শাসকদলের তরফে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নানারকম ভাবে তাদের হেনস্থা করা হতে পারে।

Section 236 of the Finance Act 2016 and section 2 (1)(j)(vi) of the Foreign Contribution Regulation Act, 2010
এই আইনে বলা ছিল কোন বিদেশী কোম্পানি আমাদের দেশের কোন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে পারবে না।

কিন্তু Finance Act 2017 এর মাধ্যমে সরকার বিদেশী কোম্পানির সংজ্ঞাটি বদলে ফেললো। নতুন সংজ্ঞায় বলা হল যে কোন দেশীয় কোম্পানি, মানে যারা আমাদের দেশে নথিভুক্ত, সেখানে কোন বিদেশী সংস্থার বৃহৎ বা ৫০% এর বেশি অংশীদারিত্ব থাকলেও তাদের থেকে রাজনৈতিক দলগুলি চাঁদা বা অনুদান নিতে পারবে।

মানে এর মাধ্যমে আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যেমন বিদেশী পুঁজির ছড়ি ঘোড়ানোর বন্দোব্যস্ত হল তেমনই বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের দরজাও হাট করে খোলা হল। শুধু তাই নয় যখন সেই অনুদান ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে আসবে (এবং সেটাই স্বাভাবিক কারণ কোম্পানি গুলো তাদের বড় অঙ্কের অনুদান বন্ডের মাধ্যমেই দিতে চাইবে) তাদের নাম-ধামও জন সাধারণ বা ইলেকশন কমিশনের কাছে গোপন রইল। শুধুমাত্র শাসকদল গুলি জানলো তাদের নাম-ধাম এবং সেই মত তার বিনিময়ে প্রশাসনিক ও সরকারী সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার পথটাও মসৃণ রয়ে গেল।

Section 182 of Section Companies Act 2013
এই আইনে বলা ছিল কোন বেসরকারী সংস্থা যারা অন্তত পক্ষে তিনবছর ধরে ব্যবসা করেছে এবং লাভ করেছে তারা তাদের বিগত ৩ বছরের গড় লাভের সর্বোচ্চ ৭.৫% পরিমাণ অর্থ কোন রাজনৈতিক দলকে অনুদান বা চাঁদা দিতে পারবে এবং তাদের বাৎসরিক লাভ-ক্ষতির প্রতিবেদনে সেই অনুদানের পরিমাণ রাজনৈতিক দলের নাম সহ প্রকাশ করতে হবে।

কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ড ব্যবস্থা নিয়ে আসবার পর এই ৭.৫% এর সর্বোচ্চ সীমা শুধু তুলে দেওয়া হল তাই নয় এও বলা হল বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলির নাম প্রকাশের আর কোন দরকার নেই, মোট রাজনৈতিক অনুদানের পরিমাণ উল্লেখ করলেই চলবে।

মানে যা দাঁড়াল তা হল রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার থেকে আমাদের সাধারণ মানুষের অগোচরে দেদার চাঁদা বা অনুদান তুলবে এবং প্রতিদানে তাদেরকে ভোট পরবর্তী সময় সরকারী সুযোগ সুবিধাও পাইয়ে দেওয়া হবে অথচ আমরা কেউ সে কথা জানতে বা বলতে পারবো না কারণ ইলেক্টোরাল বণ্ডের গোপনীয়তার সূত্র মেনে “quid pro quo” প্রমাণ করবার জন্য যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে থাকবে না।

বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো

কোন ব্যক্তি বা সংস্থা এই ইলেক্টোরাল বন্ড অন্য একটি ব্যক্তি বা সংস্থাকে বিক্রি করায় এখনও পর্যন্ত কোন আইনি বাধা নেই। মানে আমি ১০০০ টাকা বা ১০,০০০ টাকার একটি বন্ড কিনে, সেটি অন্য কোন ব্যক্তিকে নগদ টাকায় বিক্রি করে দিতেই পারি। সেই নগদ টাকা যে ব্যক্তি আমায় দিচ্ছেন সেটা কালো না সাদা আমি জানি না। কাজেই ইলেক্টোরাল নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার আটকে গেল বলে যে দাপাদাপি চলছে তা ঠিক নয়।

তাছাড়া যে Article 21 of Indian Constitution এর কথা বলে অনুদান দাতাদের গোপনীয়তা রক্ষার মৌলিক অধিকারের কথা এই ইলেক্টোরাল বন্ডের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে তা সংবিধান মতে শুধুমাত্র কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোন সংস্থার ক্ষেত্রে বা এনজিও বা ট্রাস্ট্রের ক্ষেত্রে নয়। মানে সোজা কথায় কোন সংস্থা, এনজিও বা ট্রাস্টের মত কারোর রাজনৈতিক যোগ ও আর্থিক সুযোগ সুবিধার আদান-প্রদান আদৌ সংবিধান সম্মত নয়।

এছাড়াও ইলেক্টোরাল বন্ডের ক্ষেত্রে এই গোপনীয়তা এমনভাবে রক্ষা করা হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষ মানে ভোটদাতারা কোনমতেই জানতে না পারে কে কাকে কত অনুদান দিচ্ছে অথচ সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল তা ঠিকই জানতে পারছে। উলটে Article 19(1)(a) of Indian Constitution আমাদেরকে যে স্বাধীন মত প্রকাশের পাশাপাশি তথ্য জানবার মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে তাও বিঘ্নিত হচ্ছে।

এছাড়াও Article 12 of Indian Constitution অনুযায়ী মৌলিক অধিকার রক্ষা করবার দায়িত্ব সরকারের। অথচ এই ইলেক্টোরাল বন্ডের ক্ষেত্রে সরকারই জেনে যাচ্ছে অনুদান দাতার নাম-ধাম।

মানে ইলেক্টোরাল বন্ড হল নোটবন্দির মতই একটি আপাদ মস্তক ভুলে ভরা একটি স্কিম যার মাধ্যমে নির্বাচনী ক্ষেত্রে কালোটাকার রমরমা তো বন্ধ হবেই না উলটে বাড়বে এবং তা চিহ্নিত করা বা বোঝাও যাবে না। সেই সঙ্গে দেশের নির্বাচনীক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজির এমনকি বিদেশী পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটবে যা আগামী দিনে দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে অথচ এসবই চলবে আপনার আমার অগোচরে!

সোজা কথায় নির্বাচনী ঋণপত্র আদতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল গুলির স্বার্থে তৈরি একটা লোক ঠকানো প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।

কারা আপত্তি জানিয়েছেন

২০১৭-১৮ সালের বাজেটে এই ইলেক্টোরাল বন্ড স্কিম চালু হওয়ার পরপরই ঐ বছরেরই মে মাসের ২৬ তারিখ নির্বাচন কমিশন প্রথম চিঠি লিখে এই আপত্তির কথা জানায়।
এরপর ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর উর্জিত প্যাটেল সরকারকে দু -দুটি চিঠি লিখে (২১ এবং ২৭ শে সেপ্টেম্বর) তার আপত্তির কথা জানান। তিনি জানান এই স্কিমের ফলে একদিকে যেমন নির্বাচনী ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটবে ঠিক তেমনই কালো টাকা সাদা হওয়ার পথও খুলে যাবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এব্যাপারে রা কাটেনি। কারণ এই মুহুর্তে এই ঋণপত্রর মাধ্যমে সবথেকে বেশি সুবিধা পেয়েছে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি। কাজেই তাদের নেতৃত্বাধীন সরকার এর বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না এটাই স্বাভাবিক। এমনকি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিতেও তেমন বিশদে এই স্কিম নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি।

শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে দেশের ছয়টা রাজ্যের বিধানসভা ভোটের খরচ তোলবার জন্য চার বারের জায়গায় প্রথা বহির্ভূতভাবে ছয় বার এই ঋণপত্র বিক্রি করা হয়। মে এবং নভেম্বর মাসে দুটি অতিরিক্ত “উইন্ডো” খোলা হয়। হয়ত সেটি বে-আইনি নয় কিন্তু অবশ্যই রাজনৈতিক স্বার্থে ঋণপত্রের ব্যতিক্রমী ব্যবহার যার বেশিরভাগ সুবিধাই যথারীতি পকেটস্থ করেছে যথারীতি ক্ষমতাসীন শাসকদলগুলি। এনিয়েও মিডিয়া এক প্রকার নীরবই ছিল। কিন্তু কেন চুপ ছিল বলছি একটু পরে।

ন্যায়ালয়ের সময় নেই

এই ইলেক্টোরাল বন্ডের বিরুদ্ধে দেশের দুটি এনজিও এবং একটি রাজনৈতিক দল সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। সেটা ছিল সম্ভবতঃ ২০১৯ সাল। এনজিও দুটি হল Association of Democratic Reforms (ADR) এবং Common Cause। আর রাজনৈতিক দলটির নাম সিপিআই(এম)। তারা দাবি জানায় ইলেক্টোরাল বন্ডের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার। কিন্তু তিনজন জজ সাহেবের বেঞ্চ – ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগোই, বিচারক দীপক গুপ্তা এবং বিচারক সঞ্জীব খান্না মামলাটি প্রাথমিকভাবে শুনলেও কোন স্থগিতাদেশ দেননি। শুধু বিশদে শুনবেন বলে পরবর্তী শুনানির অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু তারপর থেকে এই মামলা কোন “অজ্ঞাত” কারণে আর তেমন এগোয়নি। কারণ দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের শোনবার সময় হয়নি।

কারা কত টাকা পেল!

এবার যে তথ্যগুলো দেবো সেগুলো খুবই চমকপ্রদ! সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক লোকেশ বাত্রা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছ থেকে আরটিআই করে জেনেছেন এই তথ্য গুলি।

  • ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছে। বিক্রি হওয়া বন্ডের ৯২% হল এক কোটি টাকা মূল্যের বন্ড। আমরা সবাই জানি এক কোটি টাকা মূল্যের বন্ড কেনবার সামর্থ্য আমাদের দেশে আছে মূলতঃ বেসরকারী সংস্থা এবং কর্পোরেট গুলির। কাজেই আমাদের নির্বাচনীক্ষেত্রে যে বেসরকারী কর্পোরেট পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটেছে তার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেল। এমন বিপদের আশঙ্কাই প্রকাশ করা হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। আমরাও ওপরে তাই লিখেছি ।
  • এই বন্ডের ৬৮% জমা পড়েছে বিজেপির তহবিলে। ওপরের আলোচনাতেও আমরা এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করেছি। বলেছি এই নির্বাচনী বন্ডের সিংহভাগ সুবিধা পাবে ক্ষমতাসীন শাসকদল।
  • এই বন্ড স্টেট ব্যাঙ্কের যে ১৭ টি শাখার মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে তারমধ্যে সবথেকে বেশি বিক্রি হয়েছে কলকাতার প্রধান শাখায়। ৪৯১১ টি। এরপর রয়েছে দেশের শিল্পনগরী মুম্বাই। এখন এর অর্থ আমাদের রাজ্যের শাসক দলও এই বন্ডের একজন বড় সুবিধাভোগী। বিগত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি এই দুই রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসকদল মিলে যে পরিমাণ বিপুল অর্থ বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য খাতে খরচা করেছে তার আমরা সবাই সাক্ষী আছি। এমনকি সংবাদমাধ্যম গুলিকে টাকা-পয়সা খরচা করে বিজ্ঞাপন পাইয়ে দিয়ে হাত করে যেভাবে দুই দলের কৃত্রিম বাইনারি তৈরি করে জনমতকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা হয়েছে তাও আমরা কম বেশি সবাই এখন বুঝতে পারছি। আর সেই বিপুল অঙ্কের টাকার একটা বড় অংশই কিন্তু এসেছে এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। আর এজন্যই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে তেমন কোন হইচই বা আলোচনা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আমরা দেখতে পাইনি। কারণ তারাও এই টাকার এক একজন বেনিফিসিয়ারি বা উপভোক্তা !

কাজেই আজ আমাদের সতর্ক হওয়ার দিন। শুধু জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকা তুললেই “দেশপ্রেম” হয় না, প্রজাতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে এই বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের ভূত ঘাড় থেকে নামিয়ে ভোটবাক্সে সুচিন্তিত মতদানটাও দেশপ্রেম! জনমত সমীক্ষা অথবা ফুটেজ/কভারেজের নামে সংবাদমাধ্যমের দেখানো পথে কে জিতবে, কে হারবে না ভেবে, কার জেতা উচিৎ ভেবে দেখাটাও দেশপ্রেম। বিপুল টাকা পয়সার খেলা থেকে আমাদের গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখাটাও দেশপ্রেম। “প্রজাতন্ত্র” কে পুঁজি ও বড়লোকি ব্যবস্থার দাস বানাবার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠাটাও দেশপ্রেম!

আর তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রজাতন্ত্রকে বাঁচাতেই আমাদের জানা জরুরি “কারা এই গৌরী সেন” যাঁরা রাজনৈতিক দলগুলিকে কোটি কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দিচ্ছেন অথচ কোন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন না! এও কি সম্ভব!

মনে রাখবেন শুধু দুটো এনজিও আর সিপিআই(এম) নয়, ইলেকশন কমিশন থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অথবা লোকেশ বাত্রার মত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকরাও রয়েছেন ইলেক্টোরাল বন্ডের বিরুদ্ধে এই লড়াইতে। আমরা “রাইজ অফ ভয়েসেস”ও থাকবো এই লড়াইতে।

আপনারা থাকবেন কি ?

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://thewire.in/government/as-electoral-bonds-go-on-sale-again-concerns-on-schemes-opacity-remain-unheard
b) https://thewire.in/government/big-money-continues-to-drive-sale-of-electoral-bonds-reveals-data-from-sbi-dea
c) https://indianexpress.com/article/explained/electoral-bond-scheme-transparency-elections-7243078/
d) https://www.tribuneindia.com/news/comment/apprehensions-persist-over-electoral-bonds-359730
e) https://telanganatoday.com/opinion-elections-expenditure-and-economy
f) https://www.scobserver.in/journal/electoral-bond-scheme-where-do-the-adr-ec-union-stand-on-the-issue/
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-26/202201252339533.jpg&category=0&date=2022-01-26&button=
h) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-30/202201292338172.jpg&category=0&date=2022-01-30&button=
i) https://www.youtube.com/watch?v=WZAJdsqs4QE
j) https://www.youtube.com/watch?v=ewx-HY-BTHw