মাননীয়া উবাচ : একটি ময়নাতদন্ত / An Investgation

তাঁকে আমরা মা-সারদা না ভাবলেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিই।

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সবথেকে সফল বিরোধী দলনেতা-নেত্রীদের কথা বলতে গেলে, জ্যোতিবাবুর পরেই যাঁর নাম আসবে সেটা অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেভাবে দেখতে গেলে আগের বাক্যে “নেত্রী” স্ত্রীলিঙ্গটি ঢোকানোই হয়েছে ওনার নাম উল্লেখ করতে হবে বলে।

ঠিক তেমনই এরই পাশাপাশি বাংলার ইতিহাসের এখনও পর্যন্ত সবথেকে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ও কালিমালিপ্ত সরকার পরিচালনার দায়ভারটিও রয়েছে তাঁর ঘাড়ে।

কাজেই এমন একটি বর্ণময় চরিত্র যখন নিজের সরকার ও দলের গায়ে লেগে যাওয়া দুর্নীতির কালিমা মুছতে মুখ খোলেন, তখন তার সেইসব বক্তব্যের ময়নাতদন্ত করতেই হয়।

আর তাই এই পর্বের বাংলার খুঁটিনাটিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া গতকালের ভাষণের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ রইল আপনাদের জন্য।

“এখন তো ভাইরালের যুগ। এতদিন জানতে পারলাম না। এত যে টাকা উঠলো আমি তো জানব। কোনও জায়গা থেকে জানতে পারলাম না। কোনও মিডিয়া টেলিভিশনও তো জানায়নি। জানলে তো অ্যাকশন হয়।”

কে বলছেন?
মুখ্যমন্ত্রী

কবে বলছেন?
২৫ শে জুলাই, ২০২২

কোথায় বলছেন?
সরকারী অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে।

উদ্দেশ্য?
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের নির্যাস হল পুরো দুর্নীতিটা এতই গোপনে হয়েছিল যে কোন মিডিয়া চ্যানেল পর্যন্ত জানতে পারেনি, তাই খবরও করেনি। কাজেই তাঁর এই না জানতে পারাটা যুক্তিযুক্ত।

সঠিক বলছেন কি?
সেটা জানবার জন্য আপনাদেরকে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে আট বছর আগে এক শনিবারের বিকেলে। বিশিষ্ট সাংবাদিক স্বর্গীয় শ্রী অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ আমলা ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহোদরও বটে) জি-২৪ ঘন্টা চ্যানেলে প্রথম টেট কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস করেন। ভিডিও লিঙ্কটি দেওয়া হল যাতে আপনারা ক্রসচেক করতে পারেন।

সেখানেই প্রথম আভাস পাওয়া যায় সরকারী স্কুলগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে বড় রকমের দুর্নীতি ও টাকার খেলা চলছে। আর এই টেট দুর্নীতি আর এসএসসি দুর্নীতি (যাতে পার্থবাবু আপাতত ফেঁসেছেন) আসলে সহোদর ভাইবোনের মত। দুটোই সরকারী স্কুল শিক্ষক নিয়োগেরই পরীক্ষা, শুধু ক্লাসগুলো আলাদা। “টেট” বা টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট হল ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা। আর ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হল এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশন। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই কেলেঙ্কারির চরিত্রটা এক। পয়সা খেয়ে শাসক অনুগত অযোগ্যদের শিক্ষকপদে নিয়োগ। একটু খুঁজলেই হয়ত পার্থবাবুর হাত যে টেট পর্যন্তও বিস্তৃত, তাও পাওয়া যাবে। কাজেই কোন টিভি চ্যানেল বা মিডিয়া সরকারী স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে কেলেঙ্কারির খবর করেনি এটা নির্জলা মিথ্যা। আর তাছাড়া মাস কয়েক আগে সংবাদমাধ্যমগুলোতে আনিস খান হত্যাকাণ্ডের খবর নিয়ে ঢি-ঢি পড়ে যাওয়ায় উনিই তো রাজ্য সরকারের সদর দপ্তর নবান্নে বসে সংবাদ মাধ্যমকে রীতিমত হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, আমার সরকার বিজ্ঞাপন দেয়, কাজেই সব সময় সরকারের স্বপক্ষে পজিটিভ খবর করতে হবে। তা নাহলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে না। এরপর উনি আশা করেন কি করে সংবাদমাধ্যম ওনার সরকারের দুর্নীতি নিয়ে খবর করবে !

কে অর্পিতা! আমি চিনতাম না। রাজ্যের বিভিন্ন ক্লাবের পূজো উদ্বোধনে আমায় ডাকে। সেখানে উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রনে অনেকে আসে। এই মেয়েটিও এসেছিল। সো হোয়াট ক্যান আই ডু! পরে শুনেছিলাম ‘পার্থ’র বন্ধু। আমি জানব কি করে কে কার বন্ধু! আমি কি ভগবান!
যদি কেউ চোর হয় ডাকাত হয় তৃণমূল কংগ্রেস তাকে রেয়াত করে না… আমি নিজের বিধায়ক সাংসদদের রেয়াত করি না। মন্ত্রীকেও না।

বক্তা কে?
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী।

“পার্থ”টা কে?
গত সপ্তাহেও তিনি পার্থদা বলতেন। হঠাৎ “পার্থ” তে নেমে এসেছেন যখন তখন পার্থবাবু প্রমাদ গুনতেই পারেন, তিনি ধরে নিতেই পারেন ‘পার্থ-দায়’ ঝেড়ে ফেলবার এটা প্রথম ধাপ। যাইহোক তা এই “পার্থ”, পুরো নাম পার্থ চট্টোপাধ্যায়, হলেন মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্য মন্ত্রীসভার প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং বর্তমান শিল্পমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী যে দলটির সর্বেসর্বা তার মহাসচিবও হলেন এই পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আমরা সবাই জানি তিনি হলেন মুখ্যমন্ত্রীর দল ও সরকারের অঘোষিত নম্বর টু।
কাজেই সেই “পার্থ” র এমন গন্ডায় গন্ডায় বান্ধবীর হাল-হদিশ, রাজ্যের প্রতিটা কোণা থেকে এত বিপুল পরিমাণ টাকা তোলবার খবর, স্বনামে-বেনামে খোঁজ পাওয়া এই বিপুল জমি-বাড়ি-নগদ টাকার খবর, এসব কিছুই যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কাম পুলিশমন্ত্রী হয়ে উনি না জেনে থাকেন তাহলে সেটা তাঁর সীমাহীন প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা উদাসীনতাকেই প্রকট করে।

মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা কজন সাংসদ-বিধায়ক বা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন?
একজনও নয়।

যে পার্থবাবুর বিরুদ্ধে এত্ত অভিযোগ তাঁকেই এখনও মন্ত্রীসভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী বহিষ্কার পর্যন্ত করেননি। দলের মহাসচিব পদেও তিনি দিব্যি বহাল রয়েছেন। এর আগেও মন্ত্রীসভার একাধিক সদস্যদের বিরুদ্ধে চিটফান্ড দুর্নীতি থেকে নারদা স্টিং ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে। সেসব খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছে। তারা অনেকে তদন্ত পর্বে জেলও খেটেছেন। কিন্তু এখন তাকালেই দেখা যায় তাঁরা প্রায় সবাই আপনার ছত্রছায়ায় রয়েছেন। আপনি তাদের আশ্রয় দিয়েছেন এই ছুতোয় যে অভিযোগ প্রমাণ হয় নি। অথচ আমাদের ভারতবর্ষে কোন জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী-সান্ত্রির বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে পদত্যাগের রেওয়াজ আছে। আদালতে নির্দোষ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সরকারী প্রশাসনিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করেন না।
কিন্তু আপনার মন্ত্রীসভার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমটা খুবই দৃষ্টিকটু। মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে আপনাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে রেখে আদৌ দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়।

কাজেই অনেক রাজ্যবাসী মনে করেন হোয়াট ক্যান আই ডু-এর উত্তর একটাই!

প্লিজ রিজাইন! পদত্যাগ করুন।

আপনার সততার প্রতীক অগ্নিকন্যা ইমেজটা অক্ষত রাখবার জন্যই এটা জরুরি।

১ লক্ষ চাকরি দিলে ১০০-২০০টা ভুল হতেই পারে। শুধরে নিতে হবে।
১০০ টা চাকরি দিলে ১ টা পছন্দের লোক আপনি নিতেই পারেন ।

বক্তা?
সেই মুখ্যমন্ত্রী।

উদ্দেশ্য?
যোগ্য পাশকরা চাকরি প্রার্থীদের সরকারী চাকরি না দিয়ে অযোগ্যদের টাকার বিনিময়ে সরকারী চাকরি বিক্রি করা একটি সংগঠিত অপরাধ। এটা কোন ক্লেরিকাল মিসটেক বা পদ্ধতিগত ত্রুটি নয়। মুখ্যমন্ত্রী সেই অপরাধকে সামান্য ভুল বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন।

আর এটা কোন বেসরকারী বা ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থায় নিয়োগ চলছে না যে ইচ্ছেমত পছন্দের লোক ঢোকানো যাবে।
এটা সরকারী নিয়োগ যার মাইনে আসে জনগণের করের টাকা থেকে। কাজেই সেখানে ইচ্ছেমত পছন্দমত কাউকে নিয়োগ করা যায় না। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে নির্দিষ্ট যোগ্যতামানের নিরিখে সরকারী সমস্ত পদে নিয়োগ হয়ে থাকে। এমনকি অস্থায়ী কর্মচারী বা ঠিকাদার নিয়োগেও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে।
কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এমন কথা অত্যন্ত অনভিপ্রেত যা নতুন আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। আমাদের তো মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরগুলোতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন মর্জি-মাফিক পছন্দের লোক ঢোকানো চলছে বহুদিন ধরেই এবং তাতে মুখ্যমন্ত্রীরও প্রশ্রয় আছে।

যদি রাজনীতি না করতাম তাহলে জিভ কেটে নিতে পারতাম।

কাদের?
বিরোধীদের! মানে সিপিআই(এম) আর বিজেপি’র ।

কে বলছেন?
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে।

কোথায়?
একটি আদ্যপান্ত সরকারী অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে।

সেই মঞ্চে আর কারা আছেন?
বাংলার বিশিষ্টজনেরা, যাঁরা শিল্প-সাহিত্য- বিজ্ঞান- বাণিজ্য অথবা নানাবিধ সামাজিক কাজকর্মে নিজেদের অবদানের জন্য বাংলা তথা দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। তাঁদের সেই কাজকে স্বীকৃতি জানিয়ে বিশেষ বঙ্গভূষণ ও বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার প্রদান উপলক্ষেই সরকারের তরফে এই অনুষ্ঠানের আয়জন করা হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এমন স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক শব্দবন্ধ শুনে তাঁদের কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে?
না। তাঁরা সবাই চুপ।

কেন? তাদের জিভ কি আগেই কাটা গেছে?
আমরা বাংলার মানুষ জানি না। উত্তরটা খুঁজছি।

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস। আমাদের কাজ খবরের আসল চিত্র ও চরিত্র আপনাদের সামনে রাখা। ওপরের পর্যবেক্ষণগুলো বাংলার প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের করার কথা ছিল। কিন্তু ওঁরা করতে পারেন না। ওঁদের জিভ অনেক আগেই কাটা পড়েছে।

তাই আমাদের করতে হয়।

এখানে অর্পিতা-মোনালিসা -অহনা -দ্বীপান্বীতাদের পাবেন না। পাবেন না ভাজা মাছটি উলটে খেতে না জানা বৈশাখীকে, যার চোখে পার্থবাবু অসৎ কিন্তু জল শোভন দশ-এ দশ।

আমাদের চোখ থাকে নির্ভেজাল খবরে ও তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে।

কাজেই সঙ্গে থাকুন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://youtu.be/DJ0eUTq4TeE
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_64709_44649692_4_71_26-07-2022_1_i_1_sf.html
c) https://epaper.anandabazar.com/imageview_64709_44610424_4_71_26-07-2022_0_i_1_sf.html
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-07-26/202207260017416.jpg&category=0&date=2022-07-26&button=
e) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-07-26/202207252338366.jpg&category=0&date=2022-07-26&button=
f) https://www.thewall.in/news/baishakhi-banerjee-sought-against-partha-chatterjee/