হাজিরা এড়ানোর সেরা ১০ উপায় / How To Skip Summons

আরও সংকটে পড়ে গেল রাজ্যের শাসক দল। গত সোমবার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চে আইনজীবী শামিম আহমেদ ১৯ জন নেতা-মন্ত্রীর একটি তালিকা-সহ তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব দিয়ে বলেন, ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই নেতা-মন্ত্রীদের সম্পত্তি বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। তিনি আর্জি জানান, পাঁচ বছরে এঁদের সম্পত্তি কী ভাবে এত বাড়ল, তা খতিয়ে দেখুক ইডি। এর প্রেক্ষিতে ওই মামলায় ইডিকে একটি পার্টি করার নির্দেশ দেয় হাই কোর্টের বেঞ্চ। একেই শ্রীপার্থ শ্রীঘরে, কেষ্টকে নিয়ে চলছে টানাটানি। এমনিতে শাসক দল ছিল বেকায়দায়, এই মামলার পর তাদের অবস্থা আরও খারাপ, যেটা আজ শাসক দলের সাংবাদিক সম্মেলনে ব্রাত্য বসু, ফিরহাদ হাকিম থেকে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে স্পষ্ট। হয়ত আর কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কিছু নেতা-মন্ত্রীদের ঘরে ইডি’র ডাক আসতে চলেছে। তবে কি বাঁচার উপায় নেই?

অবশ্যই আছে। যদিও সবচেয়ে ভালো উপায় সারা জীবনে চুরি-দুর্নীতি না করে মানুষের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে যাওয়া। কিন্তু যা ঘটনাপ্রবাহ আমরা গত কয়েক বছরে দেখেছি, তাতে বঙ্গবাসী বিশ্বাস করে, রাজ্যের শাসক দলের পক্ষে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাজনীতি এক্কেবারেই সম্ভব নয়। তাই যদি ইডি-সিবিআই’এর ফের ডাক আসে, তাহলে তাঁরা রক্ষা পেতে পারেন কোন কোন মাস্টারস্ট্রোকে। রইল সেরা দশ উপায় যা আমাদের নেতা-নেত্রীরা অতীতে অনুসরণ করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন।

১) বুকে ব্যাথা : এই পদ্ধতি পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত। অতীতে শাসক দলের বহু প্রভাবশালী সফলভাবে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন। তবে এর বহুল প্রয়োগে আদালত সার্বিক বিচলিত হলেও বুকে ব্যথার জুড়ি নেই। এসএসকেএম তো আছেই, না হলে এরিয়ার সরকারি হাসপাতাল, সেটাও না হলে সাদা কাগজে প্রেসক্রিপশন নিয়ে রেস্টে চলে যান। মনে রাখবেন বাংলার মহারাজও এই বুকে ব্যাথা কেস দেখিয়েই দিল্লীবাবুর হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রক্ষা পেয়েছিলেন।

২) পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি : হাজিরার দিন পূর্ব নির্ধারিত দলীয় কর্মসূচি অথবা ঠিক হয়ে থাকা সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম বা মিটিং থাকায় যাওয়া সম্ভব নয়, এমন গোছের চিঠি লিখে হাজিরা এড়ানো সম্ভব, কিন্তু এর বহুল প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। দু-তিনবার চলতে পারে ম্যাক্সিমাম। এটি মূলতঃ হয় ঠিক যখন শিয়রে কোন গুরুত্বপুর্ণ ভোট আসে তখন! এসময় রাজনৈতিক নেতাদের ব্যস্ততা যে বেশি থাকবে জানা কথা, তবুও ঠিক ঐ সময় গুলোতেই এক অজানা কারণে ইডি/সিবিআই স্বতঃপড়নোদিত ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় গরম গরম বাকযুদ্ধ! কিন্তু ভোট মিটে গেলেই আবার সব ঠান্ডা। সারদা রোজভ্যালি ইত্যাদি চিটফান্ড কাণ্ড বা নারদ স্টিং অপারেশন কাণ্ডে বিগত এক দশক ধরে এই নাটকটা চলছে এবং আমরা দেখছি। যদিও আমাদের মধ্যে তা নিয়ে কোন একঘেয়েমি বা বিরক্তি নেই।

৩) ফুলবদল : এটি একটি অনন্য অপশন। রাজ্যের বহু নেতা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে নিজেদের শরীর থেকে সমস্ত দুর্নীতি ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন, উদাহরণ হিসেবে শুভেন্দু, শোভন, মুকুল, শঙ্কুদেব ইত্যাদি বেশ কিছু মানুষ আছেন আমাদের রাজ্য থেকে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও ঐ একই শ্রেনীভুক্ত! এরা চুরি চিটিংবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও শেষ কবে সিবিআই/ইডির থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সমন পেয়েছেন নিজেরাও মনে করতে পারবেন না।

৪) যেতে যেতে পথে হল দেরি : অতি সম্প্রতি এই পদ্ধতির প্রয়োগ সফল ভাবে করেছেন মেখলিগঞ্জের জনপ্রতিনিধি। আসছি বলে ট্রেনে উঠলেও, মাঝ রাস্তায় উনি উধাও। এখনো তদন্তকারী সংস্থা ওনার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। অনেকটা সুভাষ ঘরে ফেরে নাই স্টাইল! হাজার হোক প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক কি না!

৫) বিদেশ বিভুঁই : আপনার যদি ট্যাকের জোর থাকে, তবে এদিক ওদিক করে, যেকোনো ছুতোয় চলে যান বিদেশ। দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াটুর মত ছোট দেশগুলোতে নাগরিকত্ব পেতেও আপনার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মেহুল চোক্সী, বিজয় মাল্য থেকে বিনয় মিশ্র এই পদ্ধতিতে এখনো অধরা। আর হ্যাঁ, দ্বীপরাষ্ট্রে থাকতে থাকতে বিশ্বসুন্দরী আপনার নাগাল পেলেও সিবিআই-ইডি আপনাকে চট করে বিরক্ত করবে না।

৬) অ্যাক্ট অফ গড : আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে আগামী ২৪, ৪৮ বা ৭২ ঘন্টার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘুর্নিঝড় দক্ষিণবঙ্গে আছড়ে পড়তে পারে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, মেয়র বা জনপ্রতিনিধি হিসেবে আগত দুর্যোগের দিনে মানুষের পাশে থেকে দুর্যোগ মোকাবিলার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার তদারকির কাজে ব্যস্ত থাকায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এখনই হাজিরা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই বলেও পার পাওয়া সম্ভব বলে আমাদের বিশ্বাস। ববি হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মত কয়েকজন রীতিমত হাতে কলমে করে দেখিয়েছেন!

৭) উকিল/জজে আস্থা: রাজনৈতিক নেতাদের হাতে অনেকক্ষেত্রেই জাঁদরেল উকিল থাকেন যিনি আদালত কক্ষে কুযুক্তির জাল বুনে তাঁদেরকে সিবিআই/ইডির তদন্ত থেকে আড়াল করেন। মনু সিংভি, চিদম্বরম এমন কেস লড়ে থাকেন (এটি বিজ্ঞাপন নয়)। এমনকি তাতেও কাজ না হলে হঠাৎই রাজ্যের প্রশাসনিক সর্বময় কর্তা বা কর্ত্রী সটান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করে আব্দার করে বসেন, সিবিআই বা ইডি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া থেকে আদালত যেন বিরত থাকে। উদাহরণ: আনিস খান হত্যাকাণ্ড। রাজ্য সরকারের সিট আসল দোষী প্রভাবশালীদের যে আড়াল করছে সেটা আজ জলের মতন পরিষ্কার। কিন্তু তাও আদালত থেকে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আসছে না। শুধু তারিখ পে তারিখ আসছে। আর নো সিবিআই তদন্ত মানে নো জিজ্ঞাসাবাদ, এসব হাজিরা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই!

৮) হেড লাইন ম্যানেজমেন্ট: নেতারা যাদের ক্ষতি করেছেন, তাদের সরকারি ভাবে ক্ষতিপূরণ ও একটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিলে, শুধু মানুষ না, মিডিয়াও সব ভুলে একটা মানবিক পজিটিভ দিক খুঁজতে লেগে যাবে। সেইসঙ্গে অবশ্য প্রভাবশালী নেতানেত্রী / মন্ত্রী-সান্ত্রীদের বাঁচাতে জোগাড় করতে হবে একটা বলির পাঁঠাকে যাতে প্রমাণ করা যায় ন্যয় বিচার হচ্ছে। যেমন ভেবে দেখুন বগটুই কান্ডে তৃণমূলের যে মামুলি ব্লক সভাপতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তার নামটা ঠিকঠাক মনে আসছে কি! যাঁকে বোম মেরে খুন করায় বগটুই কাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল তারই বা নাম কি! মনে পড়ছে কি আদৌ! গণ্ডগোলের সূত্রপাত কিন্তু দলের নাম করে পাথর খাদান, বালি খাদান থেকে আদায় করা তোলাবাজির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে! আর এঁদের পেছনে যাদের হাত ছিল তারা কিন্তু সব বীরভূম জেলার দোর্ডন্ডপ্রতাপ নেতা-মন্ত্রী! অথচ কোন নেতা-মন্ত্রীকে সিবিআই /ইডি ডাকেনি। সব ধামাচাপা পড়ে গেছে! সবাই চুপ! বিজেপির ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি কিন্তু “ল্যাংচা বিপ্লব” এর মতই চূড়ান্ত ফ্লপ! কোথায় বিরোধী দলনেতা! বগটুই কাণ্ড নিয়ে আর তেমন সাড়াশব্দ শুনি না তো তাঁর মুখে! লাক্সারি বাস ভাড়া করে একদিনের ট্যুর করেই এনার্জি শেষ!

৯) আনকমন রোগ : অণ্ডকোষে সাইনাস, অর্শ বা ফিশচুলার মত কিছু রোগ বা সিওপিডি। এমনকি অ্যাংজাইটিও এক ধরনের অসুস্থতা! তেমন করে বলতে পারলে জিজ্ঞাসাবাদের থেকে ছাড় মিলতে পারে। বীরভূমের কেষ্টকাকু বুকে ব্যাথা দূরে সরিয়ে এগুলো নিয়ে খুব ট্রাই করছেন!

১০) প্রভাবশালী মাসি-পিসি : অনেক নেতা-নেত্রীদের আবার প্রভাবশালী পিসি-মাসি থাকেন যিনি প্রয়োজনে কলকাতায় ধর্না দেন বা নিজাম প্যালেস ঘেরাও করেন অথবা দিল্লি পর্যন্ত ছুটে যেতে পারেন। এভাবেও অনেক কিছুই ধামাচাপা দেওয়া যায়। আমরা দেখেছি, তারপর সিবিআই /ইডি আর তেমন করে অভিযুক্ত নেতা নেত্রীকে বিরক্ত করে না। সম্প্রতি বারংবার জিজ্ঞাসবাদের জন্য ডেকে পাঠালেও কয়লা পাচারকান্ডে সিবিআইএর দায়ের করা প্রাথমিক চার্জশিটে কিন্তু বিশ্ব বাংলার বিখ্যাত ভাইপো এবং তাঁর স্ত্রীর নাম পাওয়া যায় নি। এর পেছনে অনেকেই দার্জিলিংএ তাঁর পিসির বহুল চর্চিত “চা-বিস্কুট” মিটিং এর ছায়া দেখতে পান। তাছাড়াও শোনা যায় চোখের চিকিৎসা করাতে ভাইপো যখন সম্প্রতি দুবাইতে যান, তখন সেই দুবাইতেই ছিলেন জয় শাহ। আর এদিকে ইডিও জানায় কয়লা পাচার কাণ্ডের কাণ্ডারী বিনয় মিশ্রও নাকি দুবাইতে আত্মগোপন করে আছেন। ফলে অনেকেই দুই আর দুই চার করতে চাইছেন! যদিও আমাদের অবস্থা অনেকটা “মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি” র মত।

যদিও পরিশেষে জানিয়ে দিই, এসব কারসাজি কৌশল গুলো কিন্তু আমার আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কাজেই ভুলেও এগুলির ভরসায় চুরি-যোচ্চুরি করতে যাবেন না যেন! আমাদের কোন প্রভাবশালী বাবা-কাকা বা পিসি-মাসি নেই!

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

পুনশ্চ : আজ ব্রাত্য বাবু সাংবাদিক সম্মেলনে যে অতৃণমূল-অবিজেপি নেতাদের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তুললেন, তাদের ব্যালান্স শীটের দিকেও আমরা নজর রাখছি। অবশ্যই তার সাথে ফুলবদলানো নেতা-নেত্রী দেরও ঘোষিত সম্পত্তির পরিমান আমরা আনব আপনার সামনে।