খবরে বোরোলীন / The Unanswered Questions
![খবরে বোরোলীন / The Unanswered Questions](https://riseofvoices.com/wp-content/uploads/2022/08/png_20220809_185832_0000-845x550.png)
সংবাদমাধ্যমের ফোকাস এখন পার্থ-অর্পিতা, জুতোছোঁড়া, জেলখাটা মুখপাত্রের “দেখ কেমন লাগে”, দিল্লির “সেটিং-মিটিং” ইত্যাদি ঘুরে আপাততঃ বিহারে এসে ঠেকেছে। এতে অবশ্য রাজ্যের মানুষের “পকেটে আগুন-জীবনে ফাগুন” অবস্থার উন্নতি হবে কিনা, তা বিশেষ জানা যাচ্ছে না। কিন্তু রাজ্যজুড়ে যে একদল চোর-চিটিংবাজের রাজত্ব চলছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর খবরে দুর্নীতি প্রসঙ্গ এলেই, পাশে চলেছে অর্পিতার রিল, আর সঙ্গে শ্রীপার্থ যার দায় দল নেয়নি! তিনি আপাতত জেলবন্দী। সেখানে তিনি খাসির মাংস খেলেন কিনা, কোমডে বসে ঘুমোলেন কিনা ইত্যাদি নিয়ে “পজিটিভ” সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত চিন্তিত।
অন্যদিকে ৫১০ দিন ধরে যোগ্য শিক্ষক প্রার্থীরা রোদে, ঝড়ে, জলে অবস্থান বিক্ষোভ করছে, তারা কেউ খাচ্ছেন কিনা, খেলেও কি খাচ্ছেন, রোজ স্নান করছেন কিনা, আন্দোলনকারী পুরুষ-মহিলাদের শৌচকর্মের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা, শরীর/মন ভাল আছে কিনা তা নিয়ে ডাক্তার/মনোবিদের বিশেষ টিপ্পনী – এইসব নিয়ে একটি খবরও কোন প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমকে করতে দেখা গেল না।
আজকেও এই রাজ্যের হাসপাতালগুলোতে লাখ লাখ মানুষ যখন চিকিৎসার আশায় দাঁড়িয়ে আছেন, তখন বোলপুরের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তার যে ব্যতিক্রম নয় আমরা সবাই জানি। কিন্তু হল কি! সিবিআই হাজিরা এড়ানো “চড়াম-চড়াম” বাবুর বাড়িতে আজই জেলা প্রশাসনের তরফে একটি মেডিক্যাল টিম যায়। তারপর “চড়াম-চড়াম” বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক চিকিৎসক বলেন, “ফিসচুলা, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাংজাইটি, সিওপিডি সহ একাধিক সমস্যা রয়েছে অনুব্রতর। এই মুহূর্তে অপারেশন করার কোনও জায়গা নেই। খুব হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়েছে। এখন জার্নি না করার মতো তেমন কিছু বলিনি। কতদিন বেড রেস্ট নিতে হবে তেমন কোনও সুনির্দ্দিষ্ট বিধি-নিষেধের ব্যাপার নেই। তবে উনি যে খুব সুস্থ রয়েছেন তাও বলা যাচ্ছে না। আমার মনে হয় এই সময় বাড়ির বাইরে কোথাও না গেলেই ভালো!”
এখন সেই বাড়ির বাইরেটা যদি নিজাম প্যালেস না হয়ে কালীঘাট বা তপসিয়া হয় সেক্ষেত্রে কি উত্তর একই থাকবে! আমরা জানি না। কিন্তু যতটুকু জানতে পারা গেল তাতেই উঠে গেল অজস্র অস্বস্তিকর প্রশ্ন।
দিন দুয়েক আগে রাজ্যের প্রধান চিকিৎসা উৎকর্ষ কেন্দ্র এসএসকেএম যা দেখতে পেল না, বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল তা কী ভাবে দেখল! আর তাছাড়া হঠাৎ উপযাজক হয়ে মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক দল রোগীর বাড়িতেই বা গেল কেন? এমনটা তো আমার আপনার ক্ষেত্রে ঘটে না!
সুপারের সাফাই, “জেলা প্রশাসন আমাদের কাছে আবেদন করেছিলেন একটি চিকিৎসক দল পাঠানোর জন্য। তাই গিয়েছিল!”
এমন উত্তর পেয়ে স্বভাবতই আমাদের জানতে ইচ্ছে করছে, অনুব্রত মন্ডল মহাশয় জেলার কোন প্রশাসনিক পদে আছেন যে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জেলা প্রশাসনের তরফে, মহকুমা হাসপাতাল থেকে তার বাড়িতে বিশেষ চিকিৎসক দল পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হল! যে ব্যক্তি বীরভূম থেকে গাড়ি চেপে চিকিৎসা করাতে সুদূর কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে আসতে পারেন, তিনি বাড়ির অদূরেই বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে যেতে পারলেন না কেন? চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কী এমন অসুস্থতা বৃদ্ধি? সুপার বললেন, “ফিসচুলা। জানেনই তো, ফিসচুলা হলে যন্ত্রণায় বসা যায় না”। তাহলে কলকাতা থেকে বোলপুর গাড়িতে বসে “নকুলদানা” তত্ত্বের জনক ফিরলেন কিভাবে?
আমাদের মনে হয়েছে হঠাৎই অনুব্রত মন্ডলকে অসুস্থ প্রমাণ করতে জেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের এমন নজিরবিহীন “অতি সক্রিয়তা” বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে দিল। অনুব্রত বাবু সিবিআই এর খপ্পরে পড়ে যদি মুখ খুলে ফেলেন, তাহলে যে জেলা প্রশাসন তথা রাজ্য সরকারের অনেক রাঘব বোয়ালের মুখ পুড়বে, তা বলাই বাহুল্য। আর সেটা আগাম বুঝেই কি কেষ্টবাবুর নিজাম প্যালেস যাওয়া আটকাতে জেলা প্রশাসনের তরফে এমন অতি সক্রিয়তা!
পার্থবাবুর গ্রেপ্তারির পর থেকেই যে তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক বাঘা বাঘা নেতাদের হৃদকম্প শুরু হয়ে গেছে সেটা তাদের চোখমুখের ভাষাতেই পরিষ্কার!
চুরি-চিটিংবাজি-তোলাবাজির দাগ যে সকাল বিকেল বোরোলীন মাখলেও যায় না সেটা এঁদের কারোরই অজানা নয়। জল-মুড়ি, গুড়-বাতাসা, নকুলদানা অথবা চড়াম চড়াম ঢাকের আওয়াজ যে জনমানসে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, খোদ কলকাতার রাজপথে পার্থর দিকে ধেয়ে আসা চপ্পল অথবা অনুব্রতকে উদ্দেশ্য করে উড়ে আসা “গরুচোর” চিৎকারই তার বড় প্রমাণ।
আর এসবের মাঝে সংবাদমাধ্যমকেও বুঝতে হবে, পার্থ-অর্পিতা জেলে কেমন আছেন, কি খেলেন, কোথায় চান করলেন, চানের জলটা কলের জল না বালতি করে তোলা জল, জামাকাপড় কাচলেন কিভাবে, চপ-বেগুনি-খাসির মাংস ইত্যাদি আবদার করে পেলেন কি পেলেন না, এসব জানতে আমরা কেউই আগ্রহী নই। কাজেই এই সমস্ত টাইমপাস সাংবাদিকতা বন্ধ করুন।
আমাদের মাথাব্যথা সেইসব ছেলেমেয়েদের জন্যে, যারা রোদে পুড়ে, জলে ভিজে নিজেদের ন্যায্য শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরির জন্যে ৫১০ দিন ধরে লড়াই করে চলেছেন।
এর পাশাপাশি আমাদের মাথা ব্যাথার কারণ সেই সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারাও, যারা অযোগ্য হয়েও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে এখনও সরকারী স্কুল গুলোতে চাকরি করে যাচ্ছেন! এদের হাতে বাংলার সার্বজনীন শিশুশিক্ষা যে আদৌ নিরাপদ নয়, সেটা নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না। কাজেই বাংলার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এই সমস্ত অযোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে চাকরি থেকে বরখাস্ত না করলে আগামী অনেকগুলো প্রজন্ম একদল আযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে পড়বে।
সংবাদমাধ্যমগুলোতে অবশ্য এইসব দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত কোন প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছি না। এমন কি আমাদের মনে হয়েছে সংবাদমাধ্যমের অপেশাদারী মনোভাবের কারণেই নীচের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলো জনমানস থেকে হারিয়ে গেছে। যেমন:
- অর্পিতাদেবীর বারুইপুরের বাগানবাড়ির চুরি কিনারা করতে সরকার বা প্রশাসনের তরফে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কি?
- অর্পিতাদেবীর বাড়ির থেকে উধাও হয়ে যাওয়া চার-চারটি গাড়ির হদিশ কি ইডি বা পুলিশ পেয়েছে? কারা কারা এর সাথে যুক্ত তাদের কি চিহ্নিত করা গেছে?
- প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী, পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাক্তন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রধান মানিক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তের কি হল?
- যে সমস্ত শাসক ঘনিষ্ঠ আমলা /পর্ষদ সভাপতি / চেয়ারম্যানদের নাম এই নিয়োগ দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই বা তদন্তের গতি প্রকৃতি কোনদিকে এগোচ্ছে ?
আমাদের কোন সহৃদয় সাংবাদিক বন্ধু এবিষয়গুলোতে আলোকপাত করলে ভালো লাগবে।
আমাদের অনুরোধ অযথা খবরের গায়ে বোরোলীন লাগাবেন না। বাংলা আজ যে দগদগে সামাজিক ক্ষতর মুখোমুখি তার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও সমালোচনার মধ্যেই উত্তরণের বীজ লুকিয়ে আছে।
ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.