যদি সাহসে কুলোয় / Shinzo Abe

এপ্রিলের ২০, ২০২১ খুন হয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকার এক দেশ, চাদের প্রেসিডেন্ট ঈদ্রিশ ডেবি ইতনো। একটা লাইন খরচ হয়নি আমাদের দেশের মিডিয়ায়। কারণ, সেদিন রাহুল গাঁধীর করোনা ধরা পড়েছিল, আর সেটাই ছিল মোটামুটিভাবে সারা দেশের টিআরপি’র কেন্দ্রবিন্দু। আর বঙ্গদর্শকদের জন্যে ছিল বিধানসভা নির্বাচনের গরম গরম আপডেট, এসব তো দেখাতেই হত। “পজিটিভ” খবর করার তাগিদ অস্বীকার করা যায় না। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর ২০১৫ সালে ঈদ্রিশ ইতনোর সাথে সাক্ষাত হলেও, দিশি মিডিয়া একজন সিটিং প্রেসিডেন্টের মৃত্যুকে একটুও গুরুত্ব দেয়নি।

তারপরে এল জুলাই ৭, ২০২১ আততায়ীর হাতে খুন হলেন হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়ে, সেদিনও ভারতীয় মিডিয়ায় কোন খবর হয়নি, কারণ সেদিন বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার অমৃতলোকে যাত্রা করেছিলেন, সাথে আবার ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় রদবদল। টিআরপি ছিল ওখানেই। প্রধানমন্ত্রী ওনার মৃত্যুতে টুইট করে শোকপ্রকাশ করলেও, তা খবর হয়নি। কারণ এইসব খবরের হয়ত দাম বা মান কোনটাই থাকে না।

গতকাল জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে খুন হলেন আততায়ীর হাতে, দেশের প্রধানমন্ত্রী জাপানি ভাষায় টুইট করলেন। ব্যাস! মিডিয়ায় শুরু হল তাণ্ডব। সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধি পিছনে, শিনজো আবে সামনে। ঠিক রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের মত, যেটা অনেকেই অবশ্য আফগানিস্তানের মতন ভুলেই গেছেন। বড় খবর চাপতে বিদেশি খবরের অতি-আমদানী এখন এই দেশের মিডিয়াকুলের কাছে জলভাত।

কিন্তু এক্ষেত্রে বোধহয় ভাতে জলটা বেশি ঢালা হয়ে গেল, নাকি নুন-লঙ্কা-পেয়াজ জোটাতে পারল না, আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না ! মানে বলতে চাইছি আততায়ীর পরিচয় জানানো হল। কিন্তু সে ঠিক কি করে বা করত তার সম্পর্কে বিশদে জানানো হল না। আদতে তিনি যে একজন জাপানের “অগ্নিবীর”, মানে সীমিত সময়ের জন্য নিযুক্ত একজন সেনাকর্মী এবং মাত্র বছর তিনেক সময়ের জন্য জাপানী সেনাবাহিনীর মেরিটাইম শাখায় কাজ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, সে খবরটা সুকৌশলে চেপে দেওয়া হল। কারণ তাহলেই তো অগ্নিবীর প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং প্রকল্পের বিপজ্জনক দিকটা বেয়াব্রু হয়ে যাবে। একজন সামরিক অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর জওয়ান যে এই ধরণের স্বল্পমেয়াদে সেনাবাহিনীতে কাজ করবার পর, সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে ঘুরে বেড়ালে যে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমনটা অগ্নিবীর প্রকল্পের সমালোচনায় আমরা আগেই জানিয়েছিলাম। শিনজো আবের হত্যা তার হাতেগরম প্রমাণ! কিন্তু নেহাতই পজিটিভিটির খোঁজে দেশের সংবাদমাধ্যম বোধহয় আপনাদের সেটা জানাতে ভুলে গেল।

তাই আজ একটা আস্ত এক্সপ্রেস ট্রেন বিস্ফোরণের অভিযোগে অভিযুক্তের বুকে ব্যথার খবর ফলাও করে প্রচার হয়, কিন্তু আরটিআই’এর উত্তর দেওয়ার জন্যে হাজার হাজার টাকা পঞ্চায়েতের প্যাডে স্ট্যাম্প মেরে চাওয়া হলে, তা খবর হয় না। বিক্রয়যোগ্যতা, রাজনৈতিক লাভের অঙ্ক আজ এই বাজারে মুখ্য। ফলস্বরূপ, ফ্যাক্ট চেকারদের আজ গারদের পিছনে থাকতে হয়, আর “মুঝে ড্রাগ দো”, বলে চিল্লানো সাংবাদিক এখন টেলিভিশনের পর্দা ভীষণ ভাবে আলো করে থাকেন।

যাদের বিক্রি বেশি,
তারাই আজ খবর,
যাদের বিক্রি নেই,
তাদের দাও কবর।

মেক্সিকো, ইথিওপিয়া, ইয়ামেন থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমারে বছরের পর বছর যুদ্ধ চললেও খবর হয় না, লাখ লাখ মানুষ মরলেও খবর হয় না, কারণ এই খবরগুলোর যে বিক্রয়যোগ্যতা, চটকদারিতা নেই। খবর দিয়ে লাভ কি! কি লাভ!

ঠিক, দেশীয় সংবাদমাধ্যম এখন লাভ-লোকসানের বাজারে পরিণত। তাই তাদের করবারীরা পাঠকদের আজ পণ্য হিসেবেই ভাবতে ভালবাসেন। চলতি বাংলা ভাষায় “মাল”। মালের আবার মান-ইজ্জত? হ্যাঁ, অনেকেই ঠিক এমনটা ভাবেন এবং ভাবান।

শিনজো আবে’র মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিন্দাযোগ্য, কিন্তু তাই বলে দেশজুড়ে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় খবর মিথ্যে হয়ে যায় না। সংবাদকারবারীদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার, দেশের মানুষের স্বার্থে প্রাইম টাইমের চেঁচামেচিটা গ্যাসের দাম নিয়ে করুন, অবশ্যই যদি সাহসে কুলোয়।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

পুনশ্চ: এখন তো শুনছি এই রাজ্যে কলেজের আলমারিতে বন্দুক রাখা হচ্ছে! তা দিয়ে কেউ সোজা বুকে গুলি করার নিদান দেবে কিনা জানা নেই।