অগ্নিপথ : কোন পথে দেশ? / The Agniveer Files
এ হল সেই অগ্নিপথ যাতে অমিতাভ বচ্চন নেই। কিন্তু তাতে কি! সিনেমাতে বচ্চনরা যে ধরণের স্টান্ট-ডায়লগবাজি করে সিটি-হাততালি কুড়োতেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত অগ্নিপথে তার থেকেও বড় স্টান্ট রয়েছে। যাকে লোকে বলে খেয়ালি পোলাও! এখানে বলা হচ্ছে আমি আপনি বিশ্বগুরু হব, পাকিস্তান-চীনকে শায়েস্তা করব, তাও আবার ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে।
যাদের “ভাড়াটে সৈন্য” শব্দটা নিয়ে আপত্তি, তাদেরকে একবার ছোট্ট করে জানিয়ে দিই, অগ্নিপথ স্কিমটা ঠিক কি। এটা আমরা নিয়েছি বিজেপির আইটি সেল থেকে ধার করে। তারজন্য সবার আগে ওনাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ ওনারা যেভাবে সহজভাষায় অগ্নিপথ প্রকল্পটা বুঝিয়েছেন, সেটা কোন কেন্দ্রীয় নেতামন্ত্রী এখনও পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি। এমনকি সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তারাও ভাঙ্গা ঢাক-ভাঙ্গা কাঁসর পিটিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে, তাই বিক্ষোভকারীদের মাঝেমধ্যে দিতে হচ্ছে “পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্লিয়ারেন্সে পাবেন না” গোছের প্রচ্ছন্ন হুমকি। যাইহোক আর কথা না বাড়িয়ে স্কিমটা দেখে নেওয়া যাক:
- এই অগ্নিপথ প্রকল্পে ১৭ বছর ৬ মাস থেকে ২১ বছর (আন্দোলনের চাপে অবশ্য শুধুমাত্র এই বছরের জন্য, যেহেতু বিগত ২ বছর করোনার কারণে বাহিনীতে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল, তাই উর্ধ্ব বয়সসীমা বাড়িয়ে ২৩ বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে) বয়সীরা আবেদন করতে পারবেন। ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা, ক্লাস টেন পাস। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সময় যে ধরনের পরীক্ষা নেওয়া হত, সেই আগের মতই সমস্ত পরীক্ষা নেওয়া হবে ব্যাক্তি নির্বাচনের সময়।
- নির্বাচিত হলে ঐ ব্যক্তি মোট ৪ বছর সময়কালের জন্য সেনাবাহিনীতে কাজ করতে পারবেন। এর মধ্যে প্রথম ৬ মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারপর পাঠানো হবে ফিল্ড ডিউটিতে।
- প্রথম বছরের বেতন প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা, যার মধ্যে ৯ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হবে, মানে মাসে ২১ হাজার টাকা হাতে পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় বর্ষে মাসিক বেতন বেড়ে ৩৩ হাজার টাকা হবে এবং ১০ হাজার টাকা কেটে নিয়ে হাতে দেওয়া হবে ২৩ হাজার টাকা। তৃতীয় বছরে মাসিক বেতন হবে ৩৬ হাজার টাকা এবং ১১ হাজার টাকা কেটে নিয়ে প্রতি মাসে হাতে দেওয়া হবে ২৫ হাজার টাকা। আর চতুর্থ বছরে মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে, যার মধ্যে ১২ হাজার টাকা কেটে নিয়ে হাতে দেওয়া হবে মাসে ২৮ হাজার টাকা। এই বেতনের উপর কোনও ইনকাম ট্যাক্স থাকবে না।
- এখন ৪ বছর ধরে এই যে কাটাকুটি খেলা হল, তার কারণ ৪ বছর পর চাকরির মেয়াদ শেষ হলে এককালীন ১১ লাখ ৭১ হাজার টাকা অবসরকালীন প্যাকেজ হিসাবে পাওয়া যাবে। তারপর যোগ্যতার মানদণ্ড অনুসারে, এদের মধ্যের সর্বোচ্চ ২৫% জওয়ানকে সেনাবাহিনীতে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হবে, বাকি ৭৫% সৈন্যদের “অগ্নিবীর” দক্ষতা শংসাপত্র দেওয়া হবে, যার ভিত্তিতে সরকার আশা করছে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে তাদের কর্মসংস্থান হবে।
- পরবর্ত্তীতে দেশজোড়া বিক্ষোভ প্রতিবাদে দিশেহারা হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে এই অগ্নিবীরদের জন্য চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে বলে ঘোষণা করছে। এমনকি নতুন জীবন বা ব্যবসা শুরু করবার জন্য স্বল্প সুদে ঋণও দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
- এমনকি ঐ ৪ বছরের সময় কালে, ঈশ্বর না করুক, যদি কোনও অগ্নিবীর বীরগতি প্রাপ্ত হন, তাহলে তার বাকী সমস্ত স্যালারি প্যাকেজ তার পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হবে। একজন রেগুলার সেনার মতই একজন অগ্নিবীর মেডেল, পুরস্কার ইত্যাদি সবই পাবেন, পাশাপাশি ৪৮ লাখ টাকার জীবন বীমার অর্থ এবং ৪ বছরের কর্মজীবনের অবশিষ্ট সময়ের বেতন পাবেন।
- ৪ বছরের কর্মজীবনের মধ্যে কেউ যদি গুরুতর আহত হয়ে অথর্ব বা পঙ্গু হয়ে পড়েন তাহলে তারজন্য রয়েছে সরকারের তরফে এককালীন আর্থিক সাহায্য। ১০০ ভাগ পঙ্গুত্বের জন্য পাবেন ৪৪ লাখ টাকা। ২৫ লাখ টাকা পাবেন ৭৫% পঙ্গুত্বের জন্য এবং ১৫ লাখ টাকা পাবেন ৫০% পঙ্গুত্বের জন্য। এছাড়াও পাবেন কর্মজীবনের অবশিষ্ট সময়ের বেতন এবং এককালীন ১১.৭১ লাখ টাকা, যেমনটা তার কর্মজীবন শেষে পাওয়ার কথা ছিল।
এখন হঠাৎ এমন একটা উদ্ভট স্কিমের কথা মাথায় এল কেন! কারণ হিসেবে সরকারী তরফে বলা হচ্ছে পয়সা নেই। মাইনে আর পেনশন দিতে সবটাকা চলে যাচ্ছে। ফলে সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য নামমাত্র টাকা অবশিষ্ট থাকছে। তাই মুলতঃ পয়সা বাঁচাতেই এই উদ্যোগ। চুক্তির ভিত্তিতে ৪ বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে নিয়োগ। এদেরকে পেনশন এবং অন্যান্য অবসরকালীন যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা (মানে পিএফ, গ্র্যাচ্যুইটি বা পেনশন) একজন সেনাবাহিনীর সৈনিক পেয়ে থাকেন তা দিতে হবে না। এতে সরকারের টাকা বাঁচবে, আর সেই পয়সায় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ করা হবে। আর তাই সোজা কথায় ক্যাজুয়াল অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক সেনা দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা। এজন্যেই ভাড়াটে সৈন্য শব্দটির জন্ম।
তাছাড়া কেমন ভাড়াটে সেনা কয়েকটা সম্ভাবনার কথা দিয়ে বোঝালে বুঝতে পারবেন। শুধু অবসরকালীন পেনশন, গ্র্যাচুইটি বা পিএফ এনারা পাবেন না তাই নয়, এনাদের চিকিৎসার ভারও সরকার নেবে শুধুমাত্র ঐ ৪ বছরের কর্মজীবনের জন্য। এমনকি সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন বা শপের পরিষেবাও সে পাবে না। মানে ৪ বছরের চুক্তি ছিল তোমার সাথে, ৪ বছর শেষ তো ব্যস, তোমাকে আমি চিনি না, সার্টিফিকেট আর ১১ লাখ টাকা নিয়ে মানে মানে কেটে পড়। কিন্তু এই যদি সরকারের মানসিকতা হয়, তাহলে আমার সেই সৈনিক ভাইটি বা বোনটি কেন বিপজ্জনক কোন কাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করতে যাবেন! এমনকি তিনি যখন জানেনই না, ৪ বছর পর আদৌ তিনি সেনাবাহিনীতে থাকবেন কি না, তখন কেনই বা দেশ এবং দশের সুরক্ষা ও সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরুপে নিয়োজিত করবেন! এখানে আরেকটা জিনিষ আমাদের মাথায় রাখতে হবে, সর্বোচ্চ ২৫% জওয়ানকে পরবর্ত্তী ১৫ বছরের জন্য স্থায়ী ভাবে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হবে। মানে প্রতি ১০০ জনে যে ২৫ জনকেই নেওয়া হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর আর তাছাড়া যিনি উচ্চমাধ্যমিকের পর লেখাপড়া ছেড়ে সেনাবাহিনীতে গেলেন, ৪ বছর পর ফিরে এসে আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় ফের পড়াশোনা করতে পারবেন! তার পরিবার তো ততদিনে তার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে! যে সমাজে ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার এমবিএ করা ছাত্ররা শ্মশান মর্গের ডোমের চাকরির পরীক্ষা দেয়, সেই সমাজে একজন উচ্চমাধ্যমিক পাশ অগ্নিবীর চাকরির বাজারে আদৌ কোন সুবিধে করতে পারবেন!
এখন আট বছরের আচ্ছে দিন কাটিয়ে অমৃতকালে প্রবেশ করা ভারতবাসী যখন বিশ্বগুরু হওয়ার স্বপ্নে ব্যস্ত, ২০৪৭ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষে অমৃত মহোৎসব উদযাপনে বিভোর, তখন সরকারের কাছে সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পয়সা নেই জানতে পেরে, খানিকটা অবাক হতে হয় বৈকি! কেন পয়সা নেই, তবে কি আচ্ছে দিন ভাঁওতা ছিল, জুমলা ছিল, এসব রাজনীতির কচকচানিতে আমরা ঢুকতে চাই না। আমরা থাকতে চাই অগ্নিপথেই।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, ৬ মাসের এই সেনাবাহিনীর ট্রেনিং খুবই প্রাথমিক। একজন সৈনিক ন্যুনতম ৩-৪ বছর (কেউ কেউ বলছেন ৬ বা ৮ বছর) সেনাবাহিনীতে কাজ করলে, তবেই তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার ফলে ফিল্ডে গিয়ে কঠিন সেনবাহিনীর কাজ করবার দায়িত্ব গ্রহণের উপযুক্ত হন। আর এখানেই উঠছে আসল প্রশ্নটা। ঠিক যখন একজন সৈনিক সেনাবাহিনীতে তার কর্ম জীবনের ৪ বছর কাটিয়ে ক্রমশঃ সেনাবাহিনীর কাজকর্মে সড়গড় হয়ে উঠছেন, প্রস্তুত হচ্ছেন কঠিন গুরুদায়িত্ব নেওয়ার জন্য, ঠিক তখনই তাদের মধ্যে থেকে ৭৫% কে বাহিনী থেকে ছেঁটে ফেলে কার লাভ হচ্ছে! এতে আদৌ দেশের বা সেনাবাহিনীর কোন উপকার হচ্ছে কি! এ প্রশ্নের স্পষ্ট কোন উত্তর এখনও কেউ দিতে পারেননি। বরং একটা ব্যাপার ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে, যে ২৫% কে শেষপর্যন্ত দক্ষতার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে পুনরায় ১৫ বছরের জন্য রেখে দেওয়া হবে তারাই শেষ পর্যন্ত দেশের সেনাবাহিনীর আসল কাজে আসবে।
আর আমাদের রাইজ অফ ভয়েসেসের প্রশ্নটা এখানেই। একদিকে তো বলছি পেনশনের পয়সা বাঁচিয়ে সেই পয়সায় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ করব। তাই অগ্নিপথ। কিন্তু যদি আমি আগে থেকেই ঠিক করে রাখি শেষ পর্যন্ত ২৫ জন লোককেই সেনাবাহিনীতে নেব, তাহলে শুধু শুধু জনগণের করের টাকায় ১০০ জনকে ট্রেনিং দেব কেন? এটা কি বাজে খরচ নয় ! এই টাকাটা কি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণে ব্যবহার করা যেত না! তাছাড়া কোন বছর যদি ২৫ জনকে নেওয়া না হয় , তাহলে তো অপচয়ও বাড়বে! মানে ঠিক দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে না।
তবে কি প্ল্যান অন্য! আসল উদ্দেশ্য পাড়ায় পাড়ায় সেনাবাহিনীর ট্রেনিং প্রাপ্ত লোক ঢুকিয়ে দিয়ে একটা পুলিশ-আর্মি জর্জরিত দেশ বানানো! আসলে “উই হ্যাভ টু মাচ ডেমোক্রেসি”! এটা তার পাল্টা। এটাই অগ্নিপথের আসল গন্তব্য?
নাকি সামনে ২০২৪ এর ভোট, সরকারের পয়সা নেই, অথচ বেকার সমস্যায় জর্জরিত যুব সমাজকে চাকরি দিতে হবে, আর তাই এমন সিভিক সেনার গাজর! সেনাবাহিনীতে অস্থায়ী চাকরির টোপ ঝুলিয়ে স্থায়ী “বহুমত” সরকারের খোঁজ!
আপনাদের কি মত ? জানান আমাদেরকে।
আর তাছাড়াও একটা নৈতিকতা বা চক্ষুলজ্জার ব্যাপার আছে তো! আমি আমার দেশের ছেলেমেয়েদের কোন অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা বা চাকরি স্থায়ী হওয়ার নিশ্চয়তা না দিয়ে, তাদের দিয়ে সেনাবাহিনীর কাজ করিয়ে নিচ্ছি! এটা কি আদৌ ন্যয়সঙ্গত! ভাবুন! ভাবা প্র্যাকটিস করুন।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.