রাইট টু … ঔদাসীন্য / I Don’t Care

সেদিন অনেকদিন পর এক বন্ধুর সাথে দেখা। তা প্রায় বছর দশেক হবে। চেহারায় বয়সের একটু ছাপ পড়লেও, হাবেভাবে সেই আগের মতই রয়ে গেছে। সেই একইরকম হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল। অমায়িক ব্যবহার। আর হ্যাঁ, সেই আগের মতই সে এই ভাটার দিনেও বামপন্থী রয়েছে। ইদানীং নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ব্যস্ততাবহুল কর্মজীবনের পাশাপাশি রাইট টু ইনফরমেশন বা তথ্য জানবার অধিকার আইন নিয়ে কাজ করছে। আমি শুনে প্রথমটায় কিছুটা হতবাক। কম বয়সের সেই পাগলামোটাও আগের মতই অটুট আছে।

মনে পড়ে গেল আমাদের সেই উত্তাল লেট টোয়েন্টিস-আর্লি থার্টিসের দিনগুলো। বন্ধু-বান্ধবদের জমায়েতে ওর করা সেই সমস্ত বক্তৃতার টুকরো টুকরো স্মৃতি। বামপন্থা মানে, আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমির অধিকার, রাইট টু এডুকেশান, রাইট টু ইনফরমেশান, মিড ডে মিল, একশো দিনের কাজ বা মনরেগা। হ্যাঁ, এগুলো বামপন্থীরাই ইউপিএ-ওয়ান সরকারের থেকে লড়াই করে আদায় করেছিলেন।

নামে মহাত্মা গান্ধী থাকলে কি হবে, যে ১০০ দিনের কাজ গ্রামীণ ভারতের আজ বিরাট ভরসাস্থল, তার কৃতিত্বের আসল দাবিদার বামপন্থীরাই। এমনকি মহামারী উত্তর সময়ে আজকের বিজেপি শাসিত দেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি-রোজগার মূলতঃ এই মনরেগার হাতধরেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং একথা একদা গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প বলে টিটকরি কেটেও, আড়ালে আবডালে বিজেপি নেতারাও স্বীকার করেন। আজকের কাটমানি আর তোলা আদায়ের দিনে এমন কাজের অধিকার আদায়ের ঘটনা সত্যি বিরল!

যাইহোক আমার সেই বন্ধু আরও জানাল, স্বাধীনতা আদায় করাটা যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম, ঠিক তেমনই অর্জিত স্বাধীনতাটা রক্ষা করাটাও স্বাধীনতা সংগ্রাম। অধিকার আদায় করলেই হয় না, তাকে দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাটাও জরুরি। তা নাহলে অধিকারটা মরে যায়। মনে পড়ে গেল সুনীল গাঙ্গুলীর “একা এবং কয়েকজন”। আর বন্ধুর মতে, এই মুহুর্তে রাইট টু ইনফরমেশন বা তথ্য জানবার অধিকার আইনটির অবস্থাও অনেকটা এইরকম। অর্ধমৃত। আর ও চাইছে একজন RTI কর্মী হিসেবে এই অধিকারটা বাঁচিয়ে রাখতে। আমরা যখন ক্রমশ মানুষ থেকে হিন্দু অথবা মুসলিম হয়ে পড়ছি, কথায় কথায় আমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে লাফালাফি করছি, থানায় ছুটি, তখন জানতেও পারছি না কিভাবে আমাদের “তথ্য জানবার অধিকার” আইনটা এক প্রকার লুঠ হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে ও দুটো ঘটনার কথা আমায় বলল।

প্রথম ঘটনাটা বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের বিদিশার। ভদ্রলোকের নাম রঞ্জিত সোনি। তিনি সরকারি তহবিলের নয়ছয় নিয়ে ১৩০ টিরও বেশি RTI অভিযোগ দায়ের করেছিলেন PWD অফিসে, লোকায়ুক্ত ও মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে। একাধিক সরকারি দপ্তর জড়িত ছিল। রঞ্জিত নিজে একসময় সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি করতেন এবং সেইসূত্রে দুর্নীতির বহর সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট স্পষ্ট ধারনা ছিল। তিনি এসবের প্রতিবাদ করায় বহু প্রতিদন্দ্বী ঠিকাদারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকদের চক্ষুশূল হন। এই সীমাহীন দুর্নীতির কারণেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে, তিনি নিজের ঠিকাদারি ব্যবসা একসময় গুটিয়ে ফেলেন। আর তারপর থেকেই সরকারি দপ্তর গুলোতে ঠিকাদার নির্বাচন সংক্রান্ত নানা পদ্ধতিগত এবং আর্থিক বেনিয়মের স্বরূপ উন্মোচনে RTI অ্যাক্টকে হাতিয়ার করেন। ফলে মৌচাকে ঢিল পড়ে এবং এনার মুখবন্ধ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর তাই গত ২রা জুন খোদ PWD অফিস চত্বরের মধ্যে জেলা আদালত ও পুলিশ লাইন থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে বিকেল বেলা পাঁচটা নাগাদ রঞ্জিত সোনীকে হত্যা করা হয়। পুলিশ অবশ্য আততায়ীদের গ্রেপ্তারও করেছে এবং সমগ্র হত্যাকাণ্ডটিকে পুরানো ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিহিংসা হিসেবে দেখাতে চাইছে। কিন্তু সরকারি দপ্তরে ও প্রশাসনিক স্তরে গজিয়ে ওঠা বাস্তুঘুঘু-রাঘববোয়ালদের দুর্নীতি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। এব্যপারে কেস ফাইলে কোথাও কোন উল্লেখ নেই।

এখন এসব নিয়ে খবর করা নিয়ে আমাদের মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে তেমন কোন তোলপাড় নেই। নেতা-নেত্রীদের কোন ট্যুইট নেই। জাতীয়স্তরের খবরের চ্যানেল গুলোতে নেই কোন টক-শো। তারচেয়ে বরং একটু প্রফেট বা মা-কালী হোক! তাতে আঁচ বেশি, কাজেই টিআরপি বেশি!

এখন এতটা পড়ে যাঁরা ভাবছেন এসব হল হিন্দি গো-বলয়ের ঘটনা, আমরা হলাম গিয়ে এগিয়ে বাংলা, তাদের জন্য আমার সেই বন্ধুটি আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরল। এটি গত পাঁচ তারিখের মানে ৫ই জুলাইয়ের ঘটনা। নদীয়া জেলার খিসমা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জনৈক বাসিন্দা RTI অ্যাক্টের আওতায় কিছু তথ্য জানতে চেয়ে পঞ্চায়েতের কাছে গত ২০ শে জুন আবেদন করেন। উদ্দেশ্য গ্রাম পঞ্চায়েতের দুর্নীতি-স্বজনপোষন জনসমক্ষে আনা। এর উত্তরে গত ৫ই জুলাই খিসমা পঞ্চায়েতের তরফে যে উত্তর পাঠানো হয়েছে তা জানলে যে কেউ চমকে যাবে। চিঠিতে স্পষ্ট জানানো হয়েছে তাঁর সেই তথ্য দিতে সরকারের ৫০,০০০ টাকা খরচা হবে। কাজেই নির্দিষ্ট চালানে (TR-7) সরকারি কোষাগারে ৫০,০০০ টাকা জমা করে, তার দিন চারেক পর তাঁকে পঞ্চায়েত অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। মানে সোজাকথায় ঐ সংশ্লিষ্ট গ্রামবাসীটি যাতে অর্থাভাবের কারণে এসব নিয়ে বেশিদূর না এগোয় তার ব্যবস্থা করতে চেয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত। কারণ প্রথমতঃ খরচের অজুহাত দিয়ে এই পরিমাণ বিপুল অর্থ আদায়ের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই RTI অ্যাক্টে। দ্বিতীয়তঃ RTI অ্যাক্টে কোন তথ্য জানতে চাওয়া ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ডেকে পাঠানো যায় না। তাকে ডাকযোগে প্রয়োজনীয় নথি দিতে হয়। আর তৃতীয়তঃ আমরা যদ্দুর জানতে পেরেছি তিনি যেসব সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য জানতে চেয়েছেন তার জেরক্সের জন্য ৫০,০০০ টাকা খরচা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। মানে খুব স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতিকে আড়াল করতে এটি একটি অপচেষ্টা মাত্র। কিন্তু এসব নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোথাও বিন্দুমাত্র হইচই হয়েছে কি ! আয়োজিত হয়েছে কি কোন টক-শো! আমাদের জানা নেই। ইনফ্যাক্ট আমাদের বেশিরভাগের তা নিয়ে কোন মাথাব্যাথাও নেই।

আর তাই স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠছে আমরা কি আদৌ আমাদের অধিকার রক্ষায় যত্নবান! আমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ যতটা স্পর্শকাতর, লড়াই করে পাওয়া অর্জিত অধিকার কি ততটা স্পর্শকাতর নয়! মানে সোজা কথায় আমাদের অধিকারগুলো কি আমাদেরকে সেভাবে স্পর্শ করে না! বিভিন্ন মানুষের সাথে আমি এ বিষয়ে কথা বলে দেখেছি, আমরা বেশিরভাগই আমাদের অধিকার সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নই।

আর তাই মাঝেমধ্যে মনে হয় এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি প্রজাতিকে কোন দেবদেবী বা পয়গম্বর কি আদৌ উদ্ধার করতে পারবে? এমন ঔদাসীন্যের মাঝে আমার সেই বন্ধুটির মত গুটিকয় মানুষ কি পারবেন, তথ্য জানবার অধিকার আইনটিকে বাঁচিয়ে রাখতে?

আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এব্যাপারে ইতিবাচক থাকতে চেয়েও পারছি না।

ধন্যবাদান্তে
সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়