আদিবাসী-জঙ্গল খতরে মে হ্যায় / Tribals and Forests are in Danger

দিন কয়েক আগেকার কথা। খবরের কাগজে নিউজ চ্যানেল গুলোতে হইহই-রইরই কাণ্ড। মাস্টারস্ট্রোক এসেছে। সৌজন্যে যথারীতি মোদী-শাহ জুটি। বিগত এক দশকের সংবাদপত্র বা নিউজ চ্যানেলের বাইট নিয়ে নাড়াচাড়া করলে আপনার মনে হতে বাধ্য, এনারা দুজন ছাড়া সারা ভারতে মাস্টারস্ট্রোক দিতে পারে এমন লোক প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু অন্যান্য বার তার সাথে একটা ছোট্ট খচখচানি থাকে। ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়ে অন্যদলের নির্বাচিত বিধায়ক কেনা-বেচা করে একটি নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়াটাকে আপনাকে মাস্টারস্ট্রোকের মান্যতা দিতে হবে।

কিন্তু এবার আর সেসব খচখচানির বালাই নেই। এবারের স্ট্রোকটা এক্কেবারে ক্লিন। একজন আদিবাসী রমণী এই প্রথম দেশের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। নাম দ্রৌপদী মুর্মু। ব্যাস সংবাদমাধ্যমকে আর পায় কে! অঙ্ক কষে সাংবাদিকেরা বার পর্যন্ত করে ফেললেন সারা দেশের কয়টি লোকসভা এবং বিধানসভা ক্ষেত্র আদিবাসী অধ্যুষিত এবং সেগুলিতে কিভাবে মোদী-শাহদের আগামী নির্বাচন গুলিতে ভোটবাক্সে সুফল মিলবে। এমনকি সঙ্ঘ পরিবার নাকি আগামী দিনগুলোতে দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকগুলোতে কৌশলে প্রচার পর্যন্ত সংগঠিত করবে বলে জানানো হল আমাদেরকে। শুধু যেটা বলা হল না সেটা হল দেশের রাষ্ট্রপতিকে সামনে রেখে প্রচার সংগঠিত করে ভোটবাক্সে ফায়দা তোলাটা অনৈতিক এবং বেআইনি।

কিন্তু আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বা রাজনীতি বিগত এক দশকে কবে আবার নীতি নৈতিকতার ধার ধেরেছে! নীতি নৈতিকতার কচকচানিকে দূরে রেখে ক্ষমতার পাউরুটিতে সফলভাবে দাঁত বসানোটাই এখন মাস্টারস্ট্রোক! আর যাঁরা এটা পারেন তারাই আজকের সংবাদমাধ্যমের ভাষায় চাণক্য! চাণক্য বেঁচে থাকলে তাঁর নাম ভাঙিয়ে চলতে থাকা এমন লোক ঠকানো রাজনীতি আদৌ হজম করতে পারতেন কি না বলা কঠিন!

তা যাইহোক, আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস অবশ্য জানি জনৈক আদিবাসী রমণী রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌছালে, একটা ইতিহাস রচনা হবে ঠিকই কিন্তু তাতে আদিবাসী সমাজের ভোল বদলে যাবে বা আখেরে বিশেষ কিছু লাভ হবে এমনটা নয়। এর আগে আমরা সংখ্যালঘু রাষ্ট্রপতির জমানাতে গুজরাট দাঙ্গা হতে দেখেছি, দলিত রাষ্ট্রপতির জমানাতে দেখেছি তাঁর রাজ্য উত্তরপ্রদেশেই সীমাহীন দলিত নির্যাতন! কিন্তু তাই বলে এবারও এত তাড়াতাড়ি এমন একটি ঘটনা সামনে আসবে ভাবিনি! ইংরাজীতে একে বলে “জাম্প দ্য গান”।

অফিসিয়ালি আদিবাসী নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছাতে এখনও কমবেশি একপক্ষ কাল বাকি আছে। অথচ তার আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একেবারে রুল জারি করে আদিবাসীদের জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হল। আমাদের দেশে মূলতঃ আদিবাসীরাই জঙ্গল সন্নিহিত গ্রামগুলিতে বসবাস করেন এবং এদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই নিকটবর্তী বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। আর তাই আগে নিয়ম ছিল বনাঞ্চল কেটে কোন শিল্প বা অন্যকিছু করতে গেলে গণশুনানির মাধ্যমে সন্নিহিত আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামসভার আগাম অনুমতি নিতে হবে। একথাই আমরা দেওচা-পচামী প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। আপনারা চাইলে পড়ে নিতে পারেন। সেই গ্রামসভার অনুমতি এলে, তবেই পরবর্তী সমস্ত অনুমতি পাওয়ার পদ্ধতিগত সমস্ত পর্যায় এবং শর্ত সফলভাবে পূরণ করলে বা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলে তবেই কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র পাওয়া যেত।

কিন্তু নতুন নিয়মে আদিবাসী গ্রামসভার অনুমতির আর প্রয়োজন থাকছে না। এখন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার আগেই জঙ্গলের জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার নীতিগত অনুমতি দিয়ে দেবে। ক্ষতিপূরণ বাবদ বৃক্ষ রোপণের অর্থ আদায় করবে। তার পর রাজ্য সরকার বনবাসীদের অরণ্যের অধিকার সংক্রান্ত দাবিদাওয়া খতিয়ে দেখবে এবং তাদের পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করবে। তারপর রাজ্য সরকার গুলির তরফে বনাঞ্চল কেটে প্রকল্পের জন্য সবুজ সঙ্কেত এলে কেন্দ্রীয় সরকার বাকি সব পদ্ধতিগত শর্তাদি খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে।

মানে সোজাকথায় আদিবাসী স্বার্থরক্ষার সমস্ত দেখভালের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে। যদিও কেন্দ্রের তরফে বলা হচ্ছে নতুন বিধিতে পৃথকভাবে আদিবাসী গ্রামসভার অনুমতি নেওয়ার কথা উল্লেখ না করলেও, রাজ্য সরকারগুলিকে বনাঞ্চল অধিকার আইন – ২০০৬ মোতাবেক প্রতিটি প্রস্তাব বিবেচনা করতে হবে এবং গ্রামসভার অনুমতি সহ অন্যান্য আদিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে যা হবে, তা হল রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে শিল্প ও বিনিয়োগের টানার প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। ঠিক যেমন আমাদের রাজ্যে দেওচা-পচামী কয়লা প্রকল্পের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের ওপর প্রশাসনিক বলপ্রয়গের অভিযোগ উঠেছিল, তেমনই দেশের অরণ্য এবং আদিবাসী অধুষ্যিত রাজ্যগুলিতে অনেকটা সেরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক কি কারণে সংশ্লিষ্ট গ্রামসভার অনুমতি ছাড়াই বনাঞ্চল কেটে বিভিন্ন প্রকল্পকে নীতিগত অনুমোদন দিতে চাইছে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। কারণ ইতিহাস বলছে, ধাপে ধাপে সংস্কারের নামে, ইজ অফ ডুয়িং বিজনেসের নামে এভাবেই মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়ে থাকে।

আমরা চাই দ্রৌপদী মুর্মু মুখ খুলুন। তিনি শুধু একজন বিজেপি নেত্রী বা হবু রাষ্ট্রপতি নন, এর পাশাপাশি ওনাকে এক সাওঁতাল রমণীও হতে হবে। তবেই না একজন আদিবাসী রমণীর রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছে যাওয়ার স্বার্থকতা! আমরা চাই না উনি শুধুমাত্র কতিপয় রাজনীতিবিদের মাস্টারস্ট্রোকের ঘুঁটি হয়ে রয়ে যান।

আর সবশেষে এত সব গুরুগম্ভীর সিরিয়াস লেখালেখির শেষে একটা হাসির খোরাক দিয়ে যাই।

আমাদের বনমন্ত্রী বালুবাবু হঠাৎ আবেগতাড়িত হয়ে প্রকাশ্যে বলে বসেছেন, এবার থেকে আপনার আমার নিজের জমিতে বা বাগানে আপনার আমার নিজের হাতে লাগানো গাছ কাটতে গেলেও নাকি রাজ্য সরকারের অধীনস্থ বন দপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। স্বভাবতই তা নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে শুরু হয়েছে শোরগোল! আর বাজারে চলছে দেদার হাসি ঠাট্টা। আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস এসবের মধ্যে না ঢুকে বরং বালুবাবুকে পরামর্শ দেব একবার ফারাক্কার দাদনটোলা গ্রাম থেকে ঘুরে আসতে। ওখানে গেলে ওনার হাওয়াবদল যেমন হবে, ঠিক তেমনই উনি নিজের চোখে দেখতে পাবেন কিভাবে ওনাদের সরকারের খাঁকি পুলিশের লাঠি-বন্দুকের ডগায় আদানি গ্রুপের হাইটেনশন লাইনের বিদ্যুত খুঁটি পোঁতবার কাজ চলছে, কিভাবে বাগান মালিকদের পিটিয়ে শায়েস্তা করে আম-লিচু বাগান ভেদ করে যথেচ্ছ গাছ কেটে প্রতিবেশী বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ বেচবার পাকাপাকি বন্দোব্যস্ত চলছে। শিল্পপতিদের স্বার্থে যে সরকারের প্রশাসনিক মেশিনারি পুলিশ র‍্যাফ সঙ্গে নিয়ে গাছ কাটতে কোন রকম অনুমতির তোয়াক্কা না করে লোকজনের বাগানে ঢুকে আসে সেই সরকারের বনমন্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনলে “গেছোদাদা”র প্রসঙ্গ উঠবেই।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://www.anandabazar.com/west-bengal/central-government-planned-to-cut-down-forests-without-the-consent-of-the-natives/cid/1355688
b) https://thewire.in/government/environment-ministrys-new-forest-diversion-rules-are-bad-news-for-forest-rights
c) https://thewire.in/rights/new-forest-conservation-rules-consent-dwellers-diversion
d) https://tv9bangla.com/kolkata/have-to-take-government-permission-to-cut-down-the-trees-of-your-own-house-in-west-bengal-au62-599924.html
e) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-07-11/202207102339531.jpg&category=0&date=2022-07-11&button=