হিসেব নেই / Gross Domestic Product
১৩৮ কোটির দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। গোটা বিশ্বের প্রায় ১৮% মানুষ বাস করে এই দেশে। দেশের সমস্ত ক্ষেত্রের শ্রমিকের সংখ্যা মোটামুটিভাবে ৫২ কোটির উপরে। চিনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমজীবী মানুষকে সাথে নিয়েও মোট জিডিপি’র নিরিখে ভারতের অবদান সারা বিশ্বে মাত্র ৩%। শুনলে অবাক হবেন, সারা ইউরোপ মহাদেশে যত শ্রমিক আছেন, তার দ্বিগুণের বেশি শ্রমিকের বাস আমাদের এই দেশে। আর মোট জিডিপি’র নিরিখে আমাদের দেশ বিশ্বে পঞ্চম হলেও, মাথাপিছু জিডিপি’র নিরিখে আমাদের স্থান গোটা বিশ্বে ১৪২। এমনটা কেন? জেনে নিই সহজ ভাষায়।
জিডিপি কথাটির অর্থ হল, গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট, বাংলায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। কোনও একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে (দেশ, রাজ্য, জেলা ইত্যাদি) এক বছরের সময়সীমার মধ্যে ভেতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্যকে বলা হয় জিডিপি। আগের বছরের তুলনায় পরের বছরে এ উৎপাদন যে হারে বাড়ে সেটি হচ্ছে জিডিপির বৃদ্ধি, আর কমলে হয় হ্রাস।
এই জিডিপি সাধারণ ভাবে দুই ধরনের, নমিনাল আর পিপিপি। সহজ ভাষায় একটি দেশের সব মানুষের মোট আয় যোগ করলে যে যোগফল বেরোবে, সেটা জিডিপি নমিনাল। আর সেই যোগফলকে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে বেরোবে মাথাপিছু জিডিপি নমিনাল বা একজন মানুষের গড় আয়।
আর জিডিপি পিপিপি’র ক্ষেত্রে ধরতে হবে, দেশের প্রতিটি মানুষের ব্যয়। এক্ষেত্রে অবশ্য হিসেব বার করা অপেক্ষাকৃত সহজ। দেশের প্রতিটি মানুষের খরচ + প্রতিটি বিনিয়োগ + (সরকারী ব্যয়) + (রপ্তানি − আমদানি), এর যোগ করলেই বেরিয়ে পড়বে জিডিপি পিপিপি। এই ফর্মুলাতে আপনিও বের করে নিতে পারেন, আপনার পরিবারের জিডিপি। ইয়ার্কি নয়, সত্যি।
সাধারণভাবে ফল যা বেরোবে তাতে সাধারণ ভাবে আপনার ব্যয়ের থেকে আয় বেশি হওয়ার কথা। দেশের ক্ষেত্রেও সেটাই হওয়া দরকার। কিন্তু তা হচ্ছে কি? আসুন দেখে নিই।
২০২২ এর সরকারী হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে আজকের দিনে একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ১৬,৭৯৯.৫৫ টাকা।
আর গড় ব্যয়, ৫৫,২১৯.২২ টাকা। হ্যাঁ, সরকারী পরিসংখ্যান ঠিক এমনটাই বলছে।
প্রতি মাসে মাথাপিছু ৩৮,৪১৯.৬৭ টাকার হিসেব নেই। অঙ্কের হিসেবে প্রতি দিনে মাথাপিছু ১২৮০.৬৬ টাকার হিসেব নেই, প্রতি ঘন্টায় মাথাপিছু ৫৩.৩৬ টাকার হিসেব নেই। প্রতিদিন ১৩৮ কোটি মানুষ x ১২৮০.৬৬ টাকা গুণ করলে যতো টাকা হয়, তার হিসেব নেই। এত টাকা তাহলে যাচ্ছে কোথায়?
নাহ্, এগুলো সাধারণত জিজ্ঞেস করা হয় না, এর হিসেব অনেকেই চান না। কখনো তা ভক্তিতে, কখনো তা ভয়ে। তাই তো আজ দেশ জুড়ে দেখা যাচ্ছে ধর্মপ্রিয়দের উল্লাসমঞ্চে আস্ফালন। দেদার বিকচ্ছে ঘৃণা, ভাঙ্গছে সেতু – উঠছে প্রাচীর। একে সামনে রেখে দৈনিক ১২ ঘন্টা করে শ্রমদান করার আইন চলে এলেও, আমরা মেতে রয়েছি নূপুর-মহুয়া-জাকির নিয়ে। আমরা একবারও জিজ্ঞেস করিনি সরকারকে, দেশের মাথাপিছু আয় আর ব্যয়ের মধ্যে এত পার্থক্য কেন? কোনো দেশের দশের নেতা-নেত্রী, ভুলেও তোলেন না এই প্রসঙ্গ। এত টাকা তাহলে যাচ্ছে কোথায়? কার পকেটে?
নাহ্, জানা যাবে না। জানলেও বলা যাবে না। কারণ এদেশে কোথাও কোথাও সংবিধানস্বীকৃত আইন মেনে প্রশ্ন করলে সরকারী প্যাডে চিঠি লিখে টাকা চাওয়া হয়, কোথাও আবার খুন হয়েও যেতে হয়। কেন বলছি একথা, জানতে চোখ রাখুন আমাদের আগামী প্রতিবেদনে!
আর সবশেষে শুধু এটুকুই জানাতে চাই এই আয়-ব্যয়ের বিপুল পার্থক্যটা আসলে দেশের ধনী আর দারিদ্রের মধ্যেকার বিপুল ফারাকটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। দেখায়, কি বিপুল সংখ্যক মানুষ আমাদের দেশে দারিদ্রের সাথে লড়ছেন। আমাদের চোখে তা পড়ে কি?
Comments are closed.