দায় কার? / The Singur Battle

হাজার হাজার ন্যায্য চাকরিপ্রার্থীদের রাজ্য সরকারের পুলিশের হাতে হেনস্থা হওয়া হয়ত অবশ্যম্ভাবী ছিল। এটা সেদিনই বোঝা গিয়েছিল যেদিন মুখ্যমন্ত্রী যেচে টেনে আনলেন সিঙ্গুর বিতর্ক। শিলিগুড়ি থেকে তিনি বলেছিলেন,

আমি নই, টাটাকে তাড়িয়েছে সিপিএম।

মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের পর রাজ্য রাজনীতিতে হটাৎ ঝড় উঠেছিল। স্বভাবতই প্রথম সারির মিডিয়া হাউসগুলি সংগ্রহ করছিল সাধারণ মানুষের মতামত। যার প্রতিক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ দায়ী করছেন বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে।

এবিপি আনন্দের ওপিনিয়ন পোলে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, “টাটাকে আমি তাড়াইনি, সিপিএম তাড়িয়েছে, বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সহমত?” এখনো অবধি পাওয়া ৩৩,০০০-এর বেশি মতামতের ৮৫% মানুষ জানিয়েছেন, তারা মুখ্যমন্ত্রীর
বক্তব্যের সাথে সহমত নন।

জি ২৪ ঘন্টার ইউটিউব চ্যানেলে প্রশ্ন রাখা হয়, “টাটাকে তাড়ানোর জন্যে দায়ী কারা?” এখনো অবধি ৮,৭০০ মতামত দেখে জানা যাচ্ছে, ৮৮% মানুষ এক্ষেত্রে দায়ী করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে।

ইউটিউব চ্যানেল দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট বেঙ্গল প্রশ্ন রেখেছিল, “আপনি কি মনে করেন সিঙ্গুর থেকে টাটা-কে সিপিএম-ই তাড়িয়েছিল?” প্রায় ৮,০০০ মতদাতার মধ্যে মাত্র ৭% মতদাতা এক্ষেত্রে মনে করেন টাটাদের সিঙ্গুর থেকে সিপিআইএম-ই তাড়িয়েছিল।

কিন্তু সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠীর চলে যাওয়ার কারণ কি শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস? সিঙ্গুর আন্দোলনে তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে থাকা প্রদেশ কংগ্রেস, বিজেপি, এসইউএসআই, নকশাল থেকে বামফ্রন্টের শরিক দলগুলো কি এর দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে? তাই ছোট বড় মিডিয়া হাউসগুলোর দেখাদেখি আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা অনলাইন পোল করব, কিন্তু বিশদে। আপনিও এখানে ভোট দিতে পারেন।

সিঙ্গুরের অনশন মঞ্চে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একা ছিলেন না, ছিলেন অনেকেই। সালটা ২০০৬। সিঙ্গুর আন্দোলন ঘিরে বঙ্গ রাজনীতি তখন উত্তাল। রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া ধীরে ধীরে বইতে শুরু করেছে। সিঙ্গুরে তৎকালীন বাম সরকারের শিল্পায়ন নীতির বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল নেত্রীর পাশে ছোট্ট একটা মঞ্চে ধরনায় বসতে দেখা যেত সোমেন মিত্রকেও। প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেসের নেতা তিনি। সেই ধর্নামঞ্চে তখন সারা বাংলার কংগ্রেস-তৃণমূল কর্মীরা আসতেন। অনেককেই দেখা যেত মমতার সঙ্গে দেখা করার পর সোমেন মিত্রর সঙ্গে কথা বলতে। মমতার সেই মঞ্চে এসে দেখা করে গিয়েছিলেন, কংগ্রেসের আরেক হেভিওয়েট নেতা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিও। সিঙ্গুর আন্দোলনের হাত ধরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০১১ সালে কংগ্রেস এবং তৃণমূল লড়েছিল বিধানসভা নির্বাচন। এমন কি ২০১২ সালে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান কংগ্রেসের সিঙ্গুর দিবস পালনে বাধা পাওয়ার পর প্রশাসনের ওপর বিষোদগার করেছিলেন। আজ প্রিয়বাবু, সোমেনবাবু আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস কি সিঙ্গুর থেকে শিল্প তাড়ানোর দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন?

Source : Getty Images

তৎকালীন বিজেপি প্রেসিডেন্ট এবং বিজেপির সর্বভারতীয় মুখ রাজনাথ সিংয়ের স্নেহের হাত পড়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায়, আজকের দেশের শাসক দল বিজেপি কি এই দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে? আজকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আর সেই সময়কার দাপুটে তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, যারা সেদিনের ধর্নামঞ্চ আলো করে রাখতেন, তারা কি এত সহজে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন? তৃণমূল থেকে বিজেপি হয়ে আবার তৃণমূলে ঘুরে আসা মুকুল রায়, অর্জুন সিংরা কি পারেন এই দায় ঝেড়ে ফেলতে? তারা সেই মঞ্চেই তো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন একটা ভারী শিল্পকে বিতাড়িত করতে, দল পাল্টালে কি সব দায় ঝেড়ে ফেলা যায়? হয়ত যায়, তাই হয়ত ওনারা বছরের পর বছর বহু মানুষের সমর্থন পেয়ে থাকেন। আর নির্বাচনের পর তাদেরই কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “মুড নেই“।

এসইউএসআই, নকশালদের কথা আলাদা করে আর বললাম না, কারণ যাদের সাথে ওনারা ঘর করেছিলেন, তারাই ওদের ঘর ভেঙেছেন। এটা ওনারাও হয়ত উপলব্ধি করেন।

কিন্তু হঠাৎ “টাটা” দিয়ে “টেট” ঢাকা গেল কি? মুখ্যমন্ত্রীর শিলিগুড়ির বক্তব্যের পর সাময়িক হইচই, সিপিআইএম-সহ বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া এবং বামমনস্ক জনতার খিল্লি, সাথে যুক্তি সাজিয়ে তৃণমূলের মরিয়া ডিফেন্সের সাথে চ্যানেলে চ্যানেলে বিতর্কসভা শুরু হলেও যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন আজও টাটকা! সিঙ্গুর চ্যাপ্টার শাসকের আশা জাগিয়ে আবার ব্যাকফুটে। তাই হয়ত শিক্ষক পেটানোর কয়েক ঘন্টা আগে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে নতুন করে সৌরভ প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছিল। মিডিয়া যথেষ্ট হাইপ তোলার চেষ্টা করলেও, জনগণ সায় দেয়নি।

দিলীপ ঘোষের ‘দুধে সোনা’ মন্তব্য মনে আছে নিশ্চয়ই? সেটাও একই কৌশল। মজা হোক, খিল্লি হোক, তর্ক-বিতর্কে জোয়ার আসুক আর আসল সমস্যা চুলোয় যাক। কিন্তু একবিংশ শতকে রাজনীতিতে এর এত এত প্রয়োগ হয়েছে যে, এখন এই সব অসময়ের বিতর্ক অনেকের কাছেই, রাখালের গরুর পালে বাঘ পড়ার মত হয়ে গেছে। তাই দেশের অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, “টাকার দাম পড়ছে না, ডলার শক্তিশালী হচ্ছে”, তখন মানুষ এসব নিয়ে বিশেষ আলোচনা করে না। স্ট্রেটকাট ইগনোর করে।

কিন্তু এত সহজে কি রাজনীতির করবারিদের সাধ মেটে! তারাও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। আর তখনই এই সব পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের যোগ্য সঙ্গত দেয় প্রথম সারির মিডিয়াকুল, ডলারের দাম যখন ৮৩ টাকা, তখন এদের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় প্রধানমন্ত্রীর কেদারনাথ যাত্রা, আবার দুর্নীতি ইস্যু থেকে ফোকাস ঘোরাতে কখনো মুখ্যমন্ত্রীর কাঁশ ফুল দিয়ে বালিশ বানানোর পরামর্শ। দেশের বা রাজ্যের প্রধান ইস্যুগুলো তাই অনেকক্ষেত্রেই তলিয়ে যায় অন্ধকারে। ডলারের নিরিখে টাকার পতন, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি ছাড়াও রাজ্য জুড়ে পাট চাষিদের বেহাল অবস্থা, সারের কালোবাজারি, ধান নিয়ে চালবাজি এই সব নিউজ এজেন্সির কাছে কোনো খবর না। কয়লা কেলেঙ্কারির কথা কি আর শোনা যাচ্ছে? ভাবুন। ঠিক এইভাবেই বারে বারে বাজিমাত করে যান নেতা-নেত্রীরা। তাই বাংলা থেকে শিল্প চলে যাওয়াতে কিঞ্চিৎ দায় হয়ত মিডিয়ার কারো কারো থাকতেই পারে।

আপনারা সবাই এখন জানেন গভীর রাতে করুণাময়ীতে প্রশাসন বলপূর্বক তুলে দিয়েছিল অনশনকারীদের। কি হয়েছে তা অনেকই সেদিন রাতের ডিনার সেরে লাইভ দেখেছেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন কেউ কেউ, যে কখন পেটানো শুরু হবে। যারা লাইভ দেখেননি সকালে ঘুম থেকে উঠে চা-ব্রেকফাস্ট সেরে অনশনরত চাকরিপ্রার্থীদের মার খাওয়ার ফুটেজ টিভিতে বা সামাজিক মাধ্যমে দেখেছেন। কেউ কেউ ধিক্কার জানিয়ে পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। কেউ কেউ বলেছেন, প্রশাসন শক্ত হাতে দমন করেছে চাকরিপ্রার্থীদের বিশৃঙ্খলা। তারপরে রাস্তায় নেমেছে বাম-বিজেপি-কংগ্রেস, ধিক্কার জানিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, জেলে গেছে। কিন্তু সেই চাকরিপ্রার্থীরা আজও হাতে পায়নি চাকরির চিঠি। আশা করব, যোগ্য প্রার্থীরা অতি শীঘ্রই চাকরির চিঠি পাবেন এবং যে প্রশাসন তাদের রাতের অন্ধকারে ঘাড়ধাক্কা দিয়েছিলেন, সেই প্রশাসনের সর্বোচ্চ নেত্রীর জয় জয়াকার করবেন। এটাই হয়, কারণ এ দেশে স্বাধীনতার মত ভয় পাওয়াটাও সাধারণ মানুষের জন্মগত অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এবার আসি পুলিশের কথায়। সব পুলিশ খারাপ নয়, এটা আপামর বঙ্গবাসী আজও বিশ্বাস করে। রাতের অন্ধকারে চাকরিপ্রার্থীদের পুলিশ পিটিয়েছে। কিন্তু পুলিশ কি করবে? চাকরিপ্রার্থীদের মতন অনেক পুলিশও নিরুপায়, তাদের ডিউটি করতে তো হবেই। নির্দেশ এলে, মানতেই হবে। যেভাবে জালিয়ানওয়ালা বাগে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ভারতীয় পুলিশবাহিনী ভারতীয়দের ওপরেই গুলি চালিয়েছিল, ওরা সেদিন ডিউটি করছিল বলে ওদের গুলির রেকর্ড লিপিবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু তাদের চোখের জল পড়েছিল কিনা তা কোনো ইতিহাস বইতে লিপিবদ্ধ হয়নি। এখন প্রশ্ন আসবে ওরা তো গুলি না চালাতেই পারত। হ্যাঁ, পারত। ওনারা গুলি না চালালে অন্য কেউ গুলি চালাত, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক দেশে এমন আচরণ বারে বারে হয়েছে। হ্যাঁ, সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক দেশে। সেই নিয়মেই সল্টলেকের করুণাময়ীতেও একই ঘটনা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিকে বলপূর্বক ছত্রভঙ্গ করেছে পুলিশ। ব্রিটিশ আমলে গুলি চলত, এখন চলে লাঠি বা লাথি। স্বাধীনতার পরে এইটুকুই যা উন্নতি হয়েছে।

কিন্তু আজ থেকে ১৬ বছর আগে সিঙ্গুরে জাতীয় সড়ক আটকে বসে থাকা আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কি মনে করতে পারছেন সেদিনের কথা, যেদিন তিনি এবং তার সহযোগীরা ২৬ দিন ধরে রাস্তা দখল করেছিলেন? তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেদিন ইচ্ছে করলেই পারতেন সেই মঞ্চ ভেঙে দিতে, কিন্তু তিনি তা করেননি। চাপ থাকলেও তিনি গনতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, বিরোধীদের সন্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, খোলা রেখেছিলেন আলোচনার রাস্তা। গনতন্ত্র এমনটাই তো দাবি করে। তাই কিনা! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ঠিক ছিলেন কি ভুল ছিলেন, অত্যাচারী ছিলেন না দুর্বল ছিলেন, তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য থাকলেও, সত্যিটা হল সিঙ্গুরে একটা প্রায় তৈরি কারখানা ডিনামাইট দিয়ে যখন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন উল্লাসে ফেটে পড়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি, প্রদেশ কংগ্রেসের বহু নেতৃত্বসহ লক্ষ লক্ষ বঙ্গবাসী, যাদের মধ্যে অন্যতম বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বর্তমান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রমুখ। শেষ পর্যন্ত সিঙ্গুরে না হয়েছে কারখানা, না হয় ঠিক মতন চাষাবাদ।

সেদিনের কারখানা গুড়িয়ে দেওয়ার দাবি ন্যায্য না অন্যায্য ছিল, তা নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠলেও, আজকের চাকরিপ্রার্থীদের দাবি কিন্তু অন্যায্য নয়। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে যে চাকরি দুর্নীতি হয়েছে, তা আদালতে বিচারাধীন, শিক্ষা দফতর থেকে মন্ত্রীরা জেলবন্দি। রাস্তায় চলছে যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি এবং জীবনের ক্ষতিপূরণের দাবিতে প্রতিবাদ। তারা অনশন করছেন, মার খাচ্ছেন। এখানে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, যারা মার খাচ্ছেন তারা যোগ্যতা প্রমাণ করা সত্বেও চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত, যারা মার দিচ্ছেন তারাও তাদের প্রাপ্য ডিএ থেকে বঞ্চিত। আর এখানে একমাত্র যারা বঞ্চিত নন, তারা মানুষের বিপুল সমর্থনে রাজ্যের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত।

ইচ্ছুক অনিচ্ছুক ভেদাভেদ নেই যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের এই আন্দোলনে। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা তাই আজ শাসকের চোখে চোখ রেখে বলছে অধিকারের লড়াই বুঝে নেওয়া হবে রাস্তাতেই। কারণ অধিকার উপহার হিসেবে কোনোদিনই আসে না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। সে চাকরি হোক বা না পাওয়া ডিএ।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস