সেইসব মৃতদেহগুলি / The sigh of the corpse

যে কোন মৃত্যুই দুঃখের। আর আত্মহত্যার খবর যখন এরকম বারবার চোখে পড়ে, তখন আমরা ভাবতে বসি, আমরা কি সত্যি ভালো নেই! আমরা মানে এই শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যাদের কথায় বার্তায় চালচলনে এই যে এত ঝাঁ চকচকে শহুরে আধুনিকতার ঝিলিক, সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারো-লাখে ফলোয়ার অথবা লাইক কুড়িয়ে নেওয়ার তৃপ্তি, এসবকি সত্যি আমাদের বেঁচে থাকবার ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রাখবার পক্ষে যথেষ্ঠ নয়!

কিন্তু আমাদের অবস্থা এতটাই এখন করুণ যে এসব ছানবিন করতে গিয়েও আমরা ছলনার আশ্রয় নিয়ে ফেলছি। কোন অজানা কারণে আত্মহত্যার চেয়ে, কে আত্মহত্যা করেছে সেটা আমাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না।

মানে মৃত/মৃতা যদি বিনোদন জগতের সাথে যুক্ত হন, তাহলে আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলির আত্মহত্যার সত্যি কারণটা জানতে ইদানীং সক্রিয়তাটা একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু সুশান্ত সিং রাজপুত এর মত মৃতদেহ আর কটা পাওয়া যায়! কাজেই তখন টেলিসোপের উঠতি অভিনেত্রী কিম্বা ফ্যাশন দুনিয়ার উঠতি মডেলদের মৃতদেহ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। আর তারপর ঠিক অনেকটা ওয়েব সিরিজের কায়দায় পরের চার-পাঁচদিন খবরের কাগজ, কিম্বা খবরের ওয়েবসাইটগুলোর স্ক্রিনে প্রায় প্রতি প্রহরে আসতে থাকে সেই আত্মহত্যার কারণ অন্বেষণের আপডেট। গরুখোঁজার মত খোঁজা শুরু হয় ত্রিকোণ সম্পর্ক বা পরকীয়া-বিবাহ বহির্ভূত কেচ্ছা। মাঝের কোনদিন কোন আপডেট না থাকলে, একাধিক মনোবিদদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয় আজকালকার জটিল জীবন ও বহুমাত্রিক সম্পর্কের ল্যাবিরিন্থে হারিয়ে গিয়ে মনের কোণে কোণে গজিয়ে ওঠা মনখারাপ পুঞ্জীভূত হওয়ার গল্প। সন্ধ্যায় প্রাইম টাইমে চ্যানেলে চ্যানেলে শুরু হয়ে যায় টক-শো। মানে ভাবখানা এমন যেন এই আত্মহত্যার সঠিক কারণ না জানলে ও বুঝলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে; এমনকি আমি-আপনি যখন তখন আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলতে পারি!

কিন্তু ফসলের ন্যায্য মুল্য না পেয়ে যখন গ্রামের একের পর এক চাষী আত্মহত্যা করছিল, কিম্বা বেসরকারী মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার ঋণের জালে জড়িয়ে গ্রামের কোন প্রান্তিক মানুষ যখন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ছিল, তখন আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলি সেইসব মৃতদেহ নিয়ে এতটা অনুসন্ধিৎসু ছিল কি! এমনকি সম্প্রতি খোদ বর্ধমান শহরে শাসকদলের টিকিটে নির্বাচিত পুরপ্রতিনিধি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের লাগাতার অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়া তুহিনা খাতুনের খবরটিও কি সেভাবে সংবাদমাধ্যমগুলি বারবার তুলে ধরে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করবার চেষ্টা করেছিল! এঁরা কেউ বিনোদন জগতের সাথে যুক্ত নয় বলেই কি আমাদের কাছে এভাবে ব্রাত্য হয়ে রইলেন! নাকি এর পিছনে অন্য কারণ রয়েছে!

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করি কেউ কোন ব্যক্তিগত কারণে বা সম্পর্কের টানাপোড়েনে বা ত্রিকোণ/পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে আত্মহত্যা করলে, সে খবরটা যেমন সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছানো জরুরি, ঠিক তেমনই ফসলের দাম না পেয়ে অথবা মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে কিম্বা শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতিদের ক্রমাগত ধর্ষনের হুমকি সহ্য করতে না পেরে কেউ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লে সংবাদ মাধ্যম গুলির তরফে তার কারণ অনুসন্ধানও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা চাই না, শাসকের গলা ধাক্কা খেয়ে, ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে দেশ ও রাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলি একে একে এভাবে আত্মহত্যা করুক! আমরা চাইব তারা বাঁচুক এবং সাধারন মানুষদের বাঁচাক।

তুহিনা খাতুনরা উঠতি মডেল বা অভিনেত্রী না হলেও তাদের মৃত আত্মাগুলো সুবিচার পাক।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস