কালীগঞ্জ উপনির্বাচন: এক ‘বাংলার মেয়ে’র এপিটাফ / Tamanna

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস। আমাদের মাথায় বা পেছনে কোনও রাজনৈতিক দলের হাত নেই। যারা আমাদের জন্মলগ্ন থেকে পাশে আছেন তাঁরা জানেন আমাদের গর্ভযন্ত্রণার ইতিবৃত্ত।
আমরা চেয়েছি – পেইড নিউজ নয়, সত্যিকারের খবরগুলো আপনাদের সামনে থাক। আর তাই আপনাদের কাছে আমরা সেই খবরগুলোই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যা মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলো এড়িয়ে যায়। তা সে চাষিদের ফসলের দাম না পাওয়া হোক, ক্ষেতমজুরদের সমস্যা হোক, গ্রামবাংলা জুড়ে মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানির দাপাদাপি হোক, সারের কালোবাজারি হোক, পাড়ার খেলার মাঠ জবর-দখল করে বা পুকুর বুজিয়ে দেদার প্রমোটিং ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোক, পরিযায়ী কৃষক ও শ্রমিকদের সমস্যার কথাই হোক, সিভিক ভলেন্টিয়ার ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল হোক অথবা দেউচা-পচামী কয়লাখনি প্রকল্প, ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান, শিক্ষা দপ্তরের দুর্নীতি অথবা ওয়াকফ বা দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ হোক– সব পাবেন আমাদের পাতায়। একটু খেয়াল করলে এটাও আপনাদের নজরে পড়বে আমাদের প্রতিটি প্রতিবেদন এমন সব সময়ে লেখা, যখন এগুলো নিয়ে মুলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলো বা রাজনৈতিক দলগুলো মাথাই ঘামাতো না বা হয়তো বা এখনও ঘামায় না।
আর এই কাজটা করতে গিয়ে আমাদের এটাও মনে হয়েছে বিজেপি-তৃণমূল ও তাদের মুখ সর্বস্ব পরিচয় সত্তার চিরায়ত দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে একটা বিকল্প ভাষ্যের জন্যে একটা পরিসর থাক আমাদের পাতায়। আর সেইসূত্রেই বাম-কংগ্রেসের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির খবর নিয়ে কিছু প্রতিবেদন করি আমরা। এসব দেখে রাইজ অফ ভয়েসেস সম্পর্কে অনেকেরই মনে হয়েছে আমরা হলাম ‘সেকু’ ও ‘মাকু’! বা আরও সোজা কথায় আলিমুদ্দিনের গেটে শুয়ে থাকা ল্যাজ নাড়া প্রভুভক্ত সারমেয় (‘কুত্তা’ শব্দটা নিজেদের সম্পর্কে লিখতে একটু বাঁধল, তাই লিখলাম না, কারণ ওটা আমরা নই)। অনেকেই আমাদেরকে সিপিআই(এম) ধরে নিয়ে এসে গুছিয়ে গালমন্দ করে গেছেন বা ভবিষ্যতেও করে যাবেন কিন্তু তবুও আমাদেরকে ‘বাগে’ পাবেন না এটা নিশ্চিত করে বলে দিতে চাই। আবার এর উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। কেউ কেউ আমাদের প্রতিবেদন পড়ে ভেবেছেন আমরা হলাম গিয়ে সিপিআই(এম) এর ‘দলদাস’। দল যা বলবে তাই শুনবো আমরা। কিন্তু সেটাও যে সত্যি নয় তা আমাদের পাতা ঘাঁটলেই বোঝা যাবে। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো আমাদের ঠিক এর আগের ‘এটা এপিটাফ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটা। লেখাটা পড়ে তো কয়েকজন জানিয়েছেন আমার (প্রতিবেদন লেখকের) নাকি ‘জাগো বাংলা’ তে চাকরি পাকা! কেউ বলেছেন ‘আগে রাম পরে বাম’ তত্ত্বের স্বপক্ষে লিখে ফেললাম। আমরা হলাম ‘ছুপা’ বিজেপি। আমার যে রাইজ অফ ভয়েসেস সহকর্মীর মারফত এইসব কথা বলে পাঠানো হয়েছে, সে অযথা বাক যুদ্ধে জড়িয়ে উত্তেজনার বশে হয়তো বা কিছু অপ্রীতিকর কথা বলে ফেলেছে বা লিখে ফেলেছে, তারজন্য ক্ষমাপ্রার্থী! কিন্তু তাতে ‘এটা এপিটাফ’ এর বাস্তবতা বদলায় না। আর সেটা লিখবো বলেই আজকের এই প্রতিবেদনের প্রস্তাবনা।
কারণ ‘এটা এপিটাফ’ শীর্ষক বিগত প্রতিবেদনে ঠিক যা যা লেখা হয়েছিল কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনকে ঘিরে ঠিক সেগুলোই হয়েছে।
মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার বাইরে কংগ্রেস প্রার্থীকে আসন ছেড়ে দেওয়া মানে যে জনমানসে এই বার্তা দিয়ে দেওয়া যে আমরা ভাই লড়াইতে নেই, তৃণমূল-বিজেপি নিজেদের মধ্যে লড়ে নিক অথবা এই বাজারে গোটা পশ্চিমবঙ্গে কোন আসন বামফ্রন্টের শরিক দলগুলোকে ছেড়ে দেওয়া মানে যে প্রকারন্তরে ঐ আসনগুলোতে তৃণমূল -বিজেপিকে ময়দান ছেড়ে দেওয়া সে কথাই ‘এটা এপিটাফ’ প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল। এই বাস্তবতাটা আলিমুদ্দিন স্ট্রীট ও বিধান ভবন উভয়কেই যেমন বুঝতে হবে ঠিক তেমনই বুঝতে হবে বামফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মাতব্বরদের। ঐ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল এতে সিপিআই(এম) দলের কর্মী সমর্থকরা যারা কট্টর তৃণমূল বিরোধী তারা লাইন দিয়ে যেমন বিজেপিকে ভোট দেবে ঠিক তেমনই এদের মধ্যে যারা ‘নো ভোট টু বিজেপিপন্থী’ তারা ভোট দেবে তৃণমূলকে। কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলাফল সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ৫৫% ভোট পেয়ে তৃণমূল জয়ী। ২৮% ভোট পেয়ে বিজেপি দ্বিতীয়। আর মাত্র ১৫% ভোট পেয়ে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী তৃতীয়। রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে বুঝতে হবে মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার বাইরে এবং কিছুটা দিনাজপুর ছাড়া কংগ্রেস দলটা আর রাজ্যের কোথাওই অবশিষ্ট নেই। আর বাম শরিকদলগুলোকেও এটা মেনে নিতে হবে তাদের এই মুহুর্তে রাজ্যের কোথাওই কোন জনভিত্তি নেই। কাজেই ভোট এলেই বামফ্রন্টের মিটিং ডেকে আসন নিয়ে দড়ি টানাটানি করে লাভ নেই। যদ্দিন না এনারা এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন এবং অযথা আলিমুদ্দিন স্ট্রীটের সাথে আসন বন্টন নিয়ে বাক-বিতন্ডা করে জোট-ঘোঁট পাকানো বন্ধ করবেন, ততদিন মানুষ এভাবে মুখ ফিরিয়েই থাকবে।
আর এরপরে যে কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলা দরকার সেটা হলো অযথা বাংলার মানুষকে সাম্প্রদায়িক তকমা দেওয়ার কোন প্রয়োজন দেখি না। কোথাও ধর্মীয় মেরুকরণের ভোট হচ্ছে না। একটা বাইনারি হচ্ছে ঠিকই, তবে সেটা শাসক বনাম প্রধান বিরোধীর বাইনারি। ঘটনাচক্রে এই মুহুর্তে শাসকের আসনে তৃণমূল ও বিরোধী আসনে বিজেপি। এই শাসক বনাম বিরোধী বাইনারি পশ্চিমবঙ্গে চিরকালই ছিল। এর সাথে ধর্মের সম্পর্ক ঠিক ততটাই যতটা বিরিয়ানিতে ভূমিকা থাকে জাফরান-জয়িত্রী-জায়ফল ইত্যাদি মশলার যা বিরিয়ানীকে সুগন্ধী-সুস্বাদু বানায়। যে কোন লড়াইতে দুটো পক্ষই থাকে। আজকের সমাজমাধ্যম -সংবাদমাধ্যম অধ্যুষিত পৃথিবীতে নির্বাচনে কোন ‘তৃতীয় পক্ষ’কে লড়াইতে ঢুকে মূল প্রতিপক্ষ হতে গেলে অনেকবেশি কৌশলী হতে হয়। জনমানসে সাড়া ফেলে দেওয়ার মত একটা রাজনৈতিক ভাষ্য লাগে যেটাকে ইদানীং ন্যারেটিভ বলা হয়। সেটা গড়ে তুলতে বাম -কংগ্রেস জোট চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ। কারণ আসন বন্টন নিয়ে এনারা আকচা-আকচি করতে করতেই ভোট এসে চলে যায়। কোন ন্যারেটিভ তৈরি তো হয়ই না, উল্টে আসন ভাগাভাগি নিয়ে এনাদের মধ্যে চলা ‘টাগ অফ ওয়ার’টা বুথে বুথে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। আর এই ব্যর্থতা শুধু আজকের নয়, ২০১৬ র পর থেকে প্রতিটা নির্বাচনে এটাই হয়ে আসছে। আর প্রতিবার ফলাফল সামনে এলেই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মেরুকরণের ভোট হয়েছে বলে চিৎকার করে ধর্মীয় মেরুকরণকেই হাওয়া দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় বাম কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে। এতে এই দুই দলের লাভের লাভ তো কিছু হয়ই না, উল্টে তৃণমূল -বিজেপির চেষ্টা করে বানানো ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি মান্যতা পেয়ে যায় আর বাংলার মানুষকে ঘুরিয়ে সাম্প্রদায়িক বলে দেগে দিয়ে ছোট করা হয়। এটাকে গোদা বাংলায় রাজনৈতিক হঠকারিতা বলে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও ‘এটা এপিটাফ’ শীর্ষক বিগত প্রতিবেদন অনুযায়ী লালঝাণ্ডার ‘রেস্ট ইন পিস’ লেখার কথা থাকলেও লিখতে পারলাম না।
কারণ কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলাফল সামনে আসতে না আসতেই একটা মৃতদেহ হাজির।

এই শবদেহ কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে জয়ী শাসকের বিজয় মিছিল থেকে ছোঁড়া সকেট বোমার আঘাতে নিহত এক দশ বছরের কিশোরীর। নাম তমন্না খাতুন। সংখ্যালঘু বলবো, নাকি মুসলমান বলবো বুঝতে পারছি না। এমনকি জনৈক সিপিআই(এম) সমর্থকের ঘরে জন্মানো ‘বাংলার মেয়ে’ও তো বলা যেতে পারে তমান্নাকে।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনছেন। কালীগঞ্জে ভোটে জিতলো শাসক তৃণমূল। দলদাস মিডিয়াকে সাথে নিয়ে শাসকের বানানো ন্যারেটিভে এই ভোটে প্রধান বিরোধী ছিল বিজেপি। সেইমত ভোটে সেকেন্ডও হলো বিজেপি। কংগ্রেস একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে বাম তথা সিপিআই(এমে)-র সমর্থন আদায় করে কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে লড়লো এবং হলো ডিস্ট্যান্ট থার্ড। কিন্তু শাসক বোমা ছুঁড়লো গিয়ে ঠিক সিপিআই(এম) কর্মীর বাড়িতে। মরলো তার দশ বছরের ছোট্ট মেয়ে। তার বাবা-মা বা পরিবার বোধহয় সেভাবে ‘দুধেল গাই’ হতে পারেননি, লালঝাণ্ডা হাতে মাটি কাঁমড়ে লড়ছিলেন,তাই মেয়েটির আজ এই পরিণতি। এই নৃশংসভাবে বোম মেরে খুন করাকে শাসকদলের পক্ষ থেকে স্বয়ং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলছেন ‘বিস্ফোরণ ’বা ‘এক্সপ্লোশন’। এরপর জেলখাটা মুখপাত্র বলবেন বোম মারার পর ফেটে গেলে তাকে বিস্ফোরণই বলে! কিন্তু যাইহোক, ভোটে ফায়দা তুলতে বিজেপির ন্যারেটিভ মিডিয়াকে দিয়ে ভোট বাজারে মানুষকে খাওয়ালেও ভোট মিটতেই বোম মেরে সেই শাসকই চিনিয়ে দিল তাদের আসল বিরোধী কে! তমান্নার নিথর দেহের পাশে সিপিআই(এম) জেগে রইলো।

কিন্তু এরপরেও কি আলিমুদ্দিনের মাথা থেকে ‘হাত’ ভূত নামবে! অর্বাচীন বাম শরিকেরা কি বুঝবে এই মুহুর্তে জনমানসে তাদের জন্য সত্যিই কোন জায়গা নেই। একটা তমান্না খাতুন এর শবদেহ কি পারবে আলিমুদ্দিনের ‘চোখের মণি’তে দূরদৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে…. আলিমুদ্দিন নেতৃত্ব পারবে কি সত্যিকারের জান-কবুল লড়াই করতে, নাকি নেতা কর্মীদের ও তাদের পরিবারবর্গের ‘জান’ এভাবে যেতেই থাকবে…. আর পরপর সুদীপ্ত-মইদুল-আনিস-তমান্নাদের লাশ কুড়োতে কুড়োতে নিছকই লাশ কুড়ানোর অভ্যেসেই একদিন আলিমুদ্দিন স্ট্রীট নিজের অজান্তেই হয়তো বা সিপিআই(এম)র লাশটাও কুড়িয়ে কাঁধে নিয়ে নেবে….এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমরা।
সেদিন যদি দেখতে হয় তাহলে সত্যি সত্যি লিখতে হবে ‘রেস্ট ইন পিস’।
আপাতত বাংলার মেয়ে তমান্না খাতুন কবরে শান্তিতে শুয়ে থাকুক। আর আলিমুদ্দিন পড়ুক বাম পরিবারে জন্মানো ‘বাংলার মেয়ে’ তমান্নার ‘এপিটাফ’টা। এটা এক অন্য এপিটাফ। রক্ত দিয়ে লেখা। শপথ নেওয়ার। জ্বলে ওঠার।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.