প্ল্যান-চিট / Ghatal Master Plan

বর্ষা ঢুকছে বঙ্গে। তবে একা নয়, প্রতিবারের মত নির্দিষ্ট কিছু ইস্যু নিয়ে ইনি আসছেন। কয়দিন বাদে পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশন মিডিয়ায় এগুলো নিয়ে তুমুল চর্চা চলবে, নেতা-নেত্রীরা গোড়ালি জলে নামবেন, দুর্দান্ত প্রতিশ্রুতি দেবেন, লম্বা লম্বা ভাষণ দেবেন, চলবে নারদ-নারদ পালা। তারপর বর্ষা চলে গেলে, এক বছরের জন্যে সেই ইস্যু বিদায় নেবে। কারণ সামনের বছর আবার তাদের ফিরতে হবে।

এরকম বহু ইস্যুর মধ্যে অন্যতম একটি ইস্যু হল ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান, যেটা প্রতি বছর নতুন নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে হাতিয়ার করে প্রতিটি রাজনৈতিক দল একের পর এক নির্বাচনী বৈতরণী পার করলেও, প্রতি বর্ষায় নিয়ম করে অথৈ জলেই থেকেছে ঘাটাল মহকুমার মানুষ। রাইজ অফ ভয়েসেস আজ সবিস্তারে আপনাদের জানাবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ইতিকথা।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কি?

ভৌগলিক অবস্থান ও বিশেষ আকৃতির জন্য ঘাটাল মহকুমার বাসিন্দাদের প্রায় প্রতি বছর জল যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বানভাসি হয় ঘাটাল, চন্দ্রকোনা ১ ও ২-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। সহায়, সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হন বহু মানুষ। প্রতিবছর।

বর্ষার সময় শিলাবতী, ঝুমি ও কংসাবতী নদীর জল বাড়লে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে থাকে এবং রূপনারায়ণ দিয়ে সেই জল বেরিয়ে গেলে জল নামে। প্রতি বছর বর্ষায় হয় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

পাঁচের দশকে প্রথমবার সংসদে ঘাটালের বন্যার সমস্যার কথা তোলেন বাম সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী। এর পরই ঘাটালের বন্যা সমস্যা খতিয়ে দেখতে মানসিংহ কমিশন গঠিত হয়। বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনও করেন তাঁরা। মানসিংহ কমিটিই প্রস্তাব করে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের, সালটা ১৯৫৯, আজ থেকে ৬৩ বছর আগে। অবশেষে ১৯৭৮ সালে বিধ্বংসী বন্যার পর টনক নড়ে তৎকালীন রাজ্য সরকারের, অতঃপর মানসিংহ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৮২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেই সময় প্রকল্পটির আর্থিক ব্যয় ঠিক হয়েছিল, ৫০ কোটি টাকা। তারপরে নানান কারণে প্রকল্পের কাজ এগায়নি।

মাস্টার প্ল্যানে কী কী কাজ হওয়ার কথা?
  • কংসাবতী ও শিলাবতীর বিস্তীর্ণ নদীপথ সংস্কার
  • কেঠে ও কাটান খাল সংস্কার করে দুই পাড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ
  • ঘাটালের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলির সংযোগস্থলের বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রচালিত লক গেট স্থাপন
  • কাঁসাই, পলাশপাই, দুর্বাচটি সহ বিভিন্ন নদী ও খাল সংস্কার
  • ঘাটাল মহকুমাজুড়ে বিভিন্ন নদীবাঁধের মেরামতকরণ
  • জল নিকাশির জন্য চন্দ্রকোনা-ঘাটাল-দাসপুরের বহু জায়গায় পাম্প হাউস নির্মাণ
মাস্টার প্ল্যানে এতদিনে হল কি?

কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি, তা ছাড়া কিছুই আর হয়নি ঘাটালে। ১৯৮২ সালে শিলান্যাসের পর আচমকাই থমকে গিয়েছিল মাস্টার প্ল্যানের কাজ। ফি বছর বছর বন্যায় ভেসে যেত ঘাটাল মহকুমা। এরপর ১৯৯৩ সালে “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি” গঠন করেন ঘাটালের বাসিন্দারা। তাতেও অবশ্য কাজ হয়নি। সেই রাজ্য ও কেন্দ্রের টানাপোড়েন এখনও জারি।

দীর্ঘকাল কাজ থমকে থাকায়, ২০০১ সালে মাস্টার প্ল্যান রুপায়নের দাবিতে ঘাটালে শুরু হয় গণআন্দোলন। ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কমিটি ঘাটাল পরিদর্শনে আসেন, কাজের জন্য ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি হয় এবং প্রথম দফায় ৩৫০ কোটি টাকা দিয়ে কাজ শুরু করার কর্মসূচী নেওয়া হয়।

২০০৮ সালে রাজ্য সরকার, পূর্বতন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে এলাকার সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ও এই এলাকা নদী প্রণালীর উপর সরাসরিভাবে নির্ভরশীল মানুষের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে, একটি সার্বিক পরিকল্পনা তৈরির কাজে হাত দেয়। একটি কেন্দ্রীয় সরকারি পরামর্শদাতা সংস্থাকে এই প্রকল্পটি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংস্থাটি প্রায় এক বছর সরেজমিনে সার্ভে করে একটি রিপোর্ট তৈরি করে রাজ্য সরকারের কাছে জমা দেন। রাজ্য সরকারও ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পাঠায়। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১৪৬০ কোটি টাকা।

প্রজেক্টটি রাজ্য সরকার অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ২০১০ সালে প্রেরণ করে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্প অনুমোদনের প্রশ্নে কয়েকটি টেকনিক্যাল প্রশ্ন তুলে রাজ্য সরকারের কাছে প্রশ্নের উত্তর চায়। এই সময়ের মধ্যেই ২০১১ সালে তৎকালীন সরকারের পতন হয়। আসে নতুন সরকার।

২০১১ সালে সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হন মানস ভুইঞা। কেন্দ্রীয় সরকারের গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটিও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পের বাজেট তখন ঠিক হয়েছিল ২,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটির হস্তক্ষেপের পর সেই বাজেট কমে দাঁড়ায় ১,২১৪ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী এই প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের বহন করার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশ অর্থ দিতে হত রাজ্যকে। কিন্তু পরবর্তী সময় সেই নিয়ম বদলে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের উপরই প্রকল্পের পঞ্চাশ শতাংশ করে খরচের দায়ভার চাপে। তারপরে অনেক জল বয়ে গেছে ঘাটাল মহকুমার ওপর দিয়ে।

গত বছর বন্যায় অভিনেতা এবং সাংসদ দেব সংবাদমাধ্যমের সামনে জানিয়েছিলেন, “দিদি প্রধানমন্ত্রী হলেই কাটবে জল যন্ত্রণা”। উত্তরে খাতায় কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতা, শুভেন্দু অধিকারীর বলেন, তিনি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের ইচ্ছার অভাব রয়েছে। প্রসঙ্গত বিগত ৮ বছর ধরে ঘাটাল লোকসভার সাংসদ আছেন অভিনেতা দেব। আর শুভেন্দু অধিকারী একসময় ছিলেন বর্তমান রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী। এর থেকেই বোঝা যায়, কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি ছাড়া বিশেষ কিছুই হয়নি ঘাটালে।

নতুন কিছু কি শোনা যাচ্ছে?

ঘাটালের মানুষের কাছে আজও অধরা ৬৩ বছর ধরে বহু চর্চিত ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। বন্যার সময় জলবন্দীদশা, সাপ-পোকা-মাঁকড়ের সাথে পানীয় জলের অপ্রতুলতাকে সঙ্গী করে নৌকা, ডিঙি, ছাদে বাস করা, অন্যের বাড়িতে রাত কাটানো ঘাটালের মানুষের সেই চেনা ছবিগুলো আজও প্রতি বছর খবরের কাগজ থেকে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের পর্দায় ভেসে ওঠে বারবার।

তবে এই মুহূর্তে প্রশাসনিক সূত্রের খবর যা জানা যাচ্ছে, তাতে সম্প্রতি অংশীদারি নিয়ে একটি প্রস্তাব রাজ্যের কাছে পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। রাজ্য তাতে সায়ও দিয়েছে। তাই নতুন করে প্রকল্পের রূপরেখা পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রের কাছে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র অনুমোদন করলে কাজ শুরু হতে পারে। প্রস্তাবিত মাস্টার প্ল্যান অনুমোদিত হলে প্রকল্পের খরচ হতে পারে কমবেশি ১৩০০ কোটি টাকা। তাতে ৬০:৪০ অংশীদারি থাকবে কেন্দ্র-রাজ্যের।

যদিও কেন্দ্রকে পাঠানো প্রস্তাবে রাজ্য জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যে প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। যদিও কাজ কতটা হয়েছে, তা অবশ্য সামনের বর্ষাতেই ভালোভাবে জানতে পারবেন, ঘাটালের জনগণ এবং রাজ্যবাসী।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস