এ কোন রাজনীতি… এ কোন ভাষা! / Foul

তিনি বিরোধী নেত্রী। লোকে বলে ক্যাপ্টেন। কাজেই তিনি আসবেন…. মঞ্চে উঠবেন …. আগুনে ভাষণে শাসককে বিঁধবেন…. এসব তো স্বাভাবিক।

এগুলো তো হওয়ারই ছিল।

কিন্তু তারপর…. যে কু’কথা শুনলাম তাকে বঙ্গ রাজনীতির অবনমন বলবো না মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলবো, নাকি গোটা ব্যাপারটাকে বঙ্গ রাজনীতির সাব -অলটার্ন টার্ন হিসেবে দেখবো তা আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস ঠিক বুঝতে পারছি না।

আর তাই ঐ নেত্রীর ভাষণ ধার করেই আজ আপনাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করতে চাইছি ‘এ কোন রাজনীতি’ যেখানে বিরোধী দলের এক নেত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে শাসকদলের ‘জেলখাটা’ মুখপাত্রকে কু’কথা বললে বা আরও সোজা ভাষায় বললে ‘খিস্তি’ দিলে মানুষের ভিড় থেকে হাততালির ঝড় ওঠে!

এমনকি সেদিন যারা কালীগঞ্জে নেত্রীর জনসভায় উপস্থিত ছিলেন শুধু তারা নয়, শাসকদলের একদম কট্টর সমর্থক বাদে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে চোখ রেখে এবং ব্যক্তিগত পরিসরে বিভিন্ন মানুষের সাথে এবিষয়ে কথাবার্তা চালিয়ে আমাদের সামনে আপামর জনতার যে বক্তব্য উঠে এসেছে তার সারমর্ম করলে দাঁড়াচ্ছে ‘মিনাক্ষী যা বলেছে ঠিক বলেছে। এরা এই ভাষাটাই বোঝে।’ এমনকি শাসক সমর্থকদের মধ্যে থেকেও অনেকে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানাচ্ছেন তাদের দলের নেতারা দিনের পর দিন যে ধরণের কু-কর্ম অবাধে চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। মুখের আগল খুলে যাচ্ছে। কাজেই….

আমরা অবাক। এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের চেনা রাজ্যটা, রাজ্যের মানুষগুলো তো এক দশক আগেও এমনটা ছিল না। আমাদের এখনও বেশ মনে আছে ‘পরিবর্তন-পূর্ব’ বাংলায় অনিল বসু- বিনয় কোঙ্গারদের কুরুচিকর মন্তব্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল বঙ্গ সমাজ জীবনে। অথচ সেই ঝড় এবার কেনো উঠলো না! উলটে কেন উঠে আসছে খুল্লম খুল্লা সমর্থন! তবে কি রাজ্যের হাল এতটাই খারাপ যে শাসকের প্রতি মানুষের অবদমিত ক্ষোভ ‘বরাহ শাবক’ বা ‘সারমেয় সন্তান’ শব্দবন্ধগুলোতে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে! এই প্রশ্নগুলোই সব থেকে বেশি অভিঘাত তৈরি করেছে আমাদের মনে। কারণ কালের নিয়মে নেতা-নেত্রীরা আসবে যাবে, কেউ হবেন রূপকার, কেউ হবেন জননেতা, কেউবা হবেন ব্র্যান্ড, কেউ হবেন অগ্নিকন্যা আবার কেউ বা ক্যাপ্টেন। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়টা থেকে যাবে।

তাই আমাদের মনে হয়েছে এটা নিয়ে একটা লেখা জরুরি। কিন্তু তারজন্য আগে জরুরি বাংলার তথাকথিত ‘মা-মাটি-মানুষ’ এর কাছে পৌঁছানোটা। তাদের সাথে কথা বলা, এব্যাপারে খোঁজ খবর করা। আর সেটা করতে গিয়েই উঠে এলো এক ভয়াবহ বাস্তবতার ছবি।

মানুষের বক্তব্যটা সোজাসাপ্টা। তারা ক্লান্ত, কারণ বর্তমান শাসকের এই লাগাতার অবিচার-অত্যাচার-লুঠ-ধর্ষণ- চুরি-চিটিংবাজি-খুনখারাপি এসব আজকের নতুন নয়, চলছে ক্ষমতায় আসবার অব্যবহিত পর থেকেই একদম নিরবিচ্ছিন্নভাবে। কারণ সবাই পার পেয়ে যায়। কেউ সাজা পায় না। অথবা সাজা পেলেও তা নাম কা ওয়াস্তে কয়েকদিনের। ফলে আম জনতার ওপর ধারবাহিক আক্রমণটা চলতেই থাকে। হয়তো সময় বা ক্ষেত্র বিশেষে বাড়ে -কমে, এইটুকুই। আর তাই মানুষ কখনও ভুলতে পারে না। আর সেই ভুলতে না পারার ফলেই ইদানীং ঘটছে ধৈর্য্যচ্যুতি।

সালটা ২০১২-১৩। সারদা-রোজভ্যালি চিটফান্ড কেলেকাঙ্কারি দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন শাসকের লুঠের শুরু। মাননীয়ার দাবী মতই ‘মদন-মুকুল-কুণাল-টুম্পাই-কানন-আমি অর্থ্যাৎ মমতা বন্দ্যোপাধায় নিজে’- এদের কাউকেই আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা যায় নি। এদের মধ্যে মুকুল রায় নিজেকে বাঁচাতে পরবর্তীতে দল বদলে বিজেপিতে চলে যান। লকেট- শুভেন্দু- কানন (ওরফে জল শোভন)-শংকুদেবের মত বর্তমান বিজেপি নেতারাও যারা চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন, তারা মুকুল রায়ের দেখানো পথেই দল বদলে আজও বঙ্গ রাজনীতিতে দিব্যি ভেসে আছেন। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তাদের ছুঁয়েও দেখে নি। শতাব্দী রায়-তাপস পাল-মিঠুন চক্রবর্ত্তীর মত কিছু সেলিব্রিটি কাম পলিটিসিয়ান তো ছিলেন এই চিটফান্ড গুলোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। এঁরাও আছেন স্ব-মহিমায়। সারা বাংলা জানে এই যে নামগুলো এতক্ষণ বলা হলো এরা প্রত্যেকে ‘চিটফান্ড কেলেঙ্কারি’র সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এরা সবাই ‘বেনিফিশিয়ারি’। এদের থাকবার কথা জেলে। কিন্তু তেমনটা হয় নি। মাঝখান থেকে লুঠ হয়েছে সাধারণ মানুষের জমানো টাকা। সুবিচার আসে নি। রাজ্য সরকারের বানানো ‘সীট’ বা কেন্দ্রের তদন্তকারী সংস্থা ইডি-সিবিআই এবং সর্বোপরি আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা, চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে বিশাল একটি ‘অশ্বডিম্ব’ প্রসব করেছে। এরপর মানুষ কার অপর আস্থা রাখবে ? কাকে বিশ্বাস করবে ?
একই হাল হয়েছে নারদ ঘুষ কান্ডের। এখানে তো দেশের আইনসভা মানে লোকসভাও ডাহা ফেল মেরেছে। ঘুষ কান্ডে অভিযুক্ত মুকুল রায়–সুলতান আহমেদ-কাকলী ঘোষ দস্তিদাররা ছিলেন সাংসদ, অথচ অধুনা ‘সনাতনী’ হিন্দু জাগাও পার্টির একদা লৌহমানব এল কে আদবানী নিজে চেয়ারম্যান হয়েও এথিক্স কমিটির মিটিংটা পর্যন্ত ডেকে উঠতে পারেন নি। কারণ মুকুল রায় তদ্দিনে দল পালটে বিজেপিতে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার মুকুল-মদন-ববি-কানন-শুভেন্দু-শঙ্কুদেবদের মত কিছু বিরল কুশীলব চিটফান্ড কেলেঙ্কারি ও নারদ ঘুষকাণ্ড দুইক্ষেত্রেই যুক্ত ছিলেন। মানে এনারা ‘ভুল’ করে কিছু করেন নি। এদের দুর্নীতিপ্রবণতা ও অপরাধমনস্কতা সর্বজনবিদিত এবং স্বীকৃত। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা এবং আদালত-বিচারব্যবস্থা এদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু খুঁজে না পাওয়ায় এদের কে সমাজে ছেড়ে রেখেছে। দু বেলা টিভিতে সমাজমাধ্যমে এদের মুখ দেখতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এদের থেকে জ্ঞানগর্ভ ভাষণও শুনতে হচ্ছে এবং হবে। মানুষ এসব কেন সহ্য করবে ? পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ছে জনতা।

একই অবস্থা শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি চুরির কেসের। তথাকথিত মা-মাটি-মানুষের সরকার ক্ষমতায় আসবার দু-তিন বছরের মধ্যে ২০১৩-১৪ থেকেই সরকারি স্কুলের চাকরি দেদার বিক্রি হয়েছে। আদালত বলে দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। রীতিমত জেলায় জেলায় শাসক দলের বড়-মেজো-ছোট নেতাদের দিয়ে দুর্নীতির জাল বিছিয়ে যোগ্যদের বাদ দিয়ে পয়সার বিনিময়ে অযোগ্যদের সরকারী স্কুল টিচারের চাকরি বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু নিয়োগে দুর্নীতির প্রাবল্য ছিল এতটাই যে চালে কাঁকড় মেশানো হয়েছে নাকি কাঁকড়ে চাল তা আদালত বুঝতে পারে নি। সরকার নিজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চাল আর কাঁকড় আলাদা করবার জন্য যে প্রামাণ্য নথি দরকার ছিল তা নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে ২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেল পুরো বাতিল হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ‘টেট’ এর প্যানেলও বাতিল হওয়ায় মুখে। অথচ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও শিক্ষাদপ্তরে তার কিছু ঘনিষ্ঠ স্যাঙাৎ ছাড়া জড়িত প্রায় প্রত্যেকেই আপাতত জামিনে বাইরে। তদন্তকারী সংস্থা ও আদালত এদেরকে দোষী প্রমাণ করতে পারছে না। যে লিপ্স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার দপ্তরে অযোগ্যদের তালিকা তৈরি হলো, যাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দুর্নীতির টাকা ঢুকলো বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আদালতে জানালো তার ডিরেক্টর ও কর্ণধারদের ঐ তদন্তকারী সংস্থা গ্রেপ্তারও করলো না, কারণ এঁরা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়। প্রভাবটা বুঝুন একবার। পাশাপাশি অযোগ্যদের বাঁচাতে গিয়ে যোগ্য টিচারদের ‘বলি’ দেওয়া হল কারণ শুধু অযোগ্যদের চাকরি গেলে তারা ঘুসের টাকা আদায় করতে জেলায় জেলায় শাসকদলের নেতাদের বাড়িতে হানা দেবে, তাই। মাঝখান থেকে সরকারি অবৈতনিক স্কুল শিক্ষাব্যবস্থাটা লাটে উঠে গেলো। ভুক্তভোগী কে ? আম জনতা। হয় আজ তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েকে লাখ লাখ টাকা গাঁটগচ্চা দিয়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়াতে হচ্ছে অথবা সন্তানের ভবিষ্যৎ লাটে উঠে যাওয়া সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মতই লাটে তুলে দিতে হচ্ছে! কেন তাদের মুখের আগল খুলবে না, শাসককে অশ্রাব্য গালিগালাজে কেন তারা তালি বাজাবে না! মানুষ জানতে চাইছে আমাদের কাছে।

তাঁরা উদাহরণ টেনে টেনে দেখিয়ে দিচ্ছেন, বলছে দেখুন রেশন কেলেঙ্কারির তদন্তের কি হাল। রেশন মন্ত্রী তার সাঙ্গপাঙ্গ সমেত জামিন পেয়ে গিয়েছেন। ইডি-সিবিআই এর তদন্ত আপাতত হিমঘরে। গরু পাচার কান্ডের মূল কাণ্ডারি বীরভূমের কেষ্ট মন্ডল কন্যা সমেত তিহারে জেল খেটে আপাতত তারাও দুজনেই জামিনে বাইরে। আর জামিনের কারণটাও ভারি অদ্ভুত। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা নাকি কেষ্ট মন্ডলের বাংলা বয়ানের হিন্দী বা ইংরাজি তর্জমার জন্যে প্রয়োজনীয় ট্রান্সলেটর খুঁজে পায় নি। মানুষ বোঝে না এটা মিথ্যে অজুহাত! কয়লা পাচার কান্ডের পাণ্ডা বিদেশে ফেরার। আর তিনি যাঁর ডানহাত ছিলেন সেই লিপ্স অ্যান্ড বাউন্ডসের ‘জনৈক’ কর্ণধার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার। কাজেই ভোট এলে যতই জিজ্ঞাসাবাদের ‘নাটক’ চলুক, এনার গ্রেপ্তার হওয়ার যে কোন সম্ভাবনাই নেই, তা মানুষ জেনে গেছে। বগটুই কান্ডে তো মূল সাক্ষীর সিবিআই হেফাজতের মধ্যে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। মানুষ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না, মানুষ জানে আসল মাথাদের আড়াল করতে যে রাজসাক্ষী হতে পারতো তাকে হেফাজতে নিয়ে ওপর তলার নির্দেশে খতম করে দেওয়া হয়েছে। এরপর আম জনতা কাকে ভরসা করবে ? কেন মুখ খুলবে না শাসকের বিরুদ্ধে !

আর শাসক মদতপুষ্ট নারী নির্যাতন-ধর্ষণ বা ধর্ষণ করে খুনের তালিকাটা আরও লজ্জাজনক। মানুষ দেখেছে পার্কস্ট্রীট ধর্ষণকান্ডে আসল অপরাধীদের আড়াল করতে ওপরমহল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তদন্তকারী আইপিএস দময়ন্তী সেনকে শাসকের রোষে পড়ে শাস্তিমূলক বদলিও হতে হয়েছিল। আর মূল অপরাধীর গার্লফ্রেন্ড কাম টলিঊড নায়িকা পেয়েছিলেন লোকসভা নির্বাচনে লড়বার টিকিট। তিনি জিতে সাংসদও হন। একইভাবে কামদুনির খুন হয়ে যাওয়া নির্যাতিতাও বিচার পায় নি। এবং যথাযথ কেস ফাইল না বানিয়ে দুষ্কৃতীদের জামিন পাইয়ে দিতে যে উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনিই পরবর্তীতে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদে প্রাইজ পোস্টিং পেয়ে আর জি কর -তিলোত্তমা কাণ্ডের যাবতীয় তথ্য প্রমান দায়িত্ব নিয়ে লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ। এমনকি নাম কা ওয়াস্তে ময়না তদন্ত সেরে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের সুযোগ না দিয়ে পুলিশ ফোর্স দিয়ে তড়িঘড়ি খুন হওয়া মহিলা চিকিৎসকের দেহ বলপূর্বক সৎকার করে দেওয়ার মত অভিযোগও উঠেছিল সেই কমিশনারের বিরুদ্ধে। আসল দোষীদের আড়াল করে এক সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রাই’কে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ করেছেন তিলোত্তমার বাবা-মা, এবং গোটাটাই ঐ তৎকালীন পুলিশ কমিশনারেরই মস্তিষ্ক প্রসূত বলে অভিযোগ করে আসছেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইও ওপরমহলের অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে তিলোত্তমা হত্যাকাণ্ডে রাজ্য পুলিশের বানানো ঐ প্রহসনের তদন্ত রিপোর্টেই কার্যত সিলমোহর দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে আর জি করের খুন হওয়া তরুণী চিকিৎসকের বিচার ঘটনার পর প্রায় এক বছর ঘুরতে চললেও আজও অধরা। হ্যাঁ, গোটা রাজ্যের মানুষ এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসবার পরেও। শাসক তার রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রাখতে এবং যাবতীয় অপরাধ করবার পরেও ‘সেটিং’ করে কোন শাস্তি না পেতে পেতে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে ইদানিং সে কোন নীতি-নৈতিকতা বা নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করছে না। অথচ মানুষের মুখের ভাষা একটু বেপরোয়া হয়ে উঠলেই নীতিপুলিশগিরি! জনসাধারণ আর বিরোধী দলের নেতানেত্রীরা কি একা সৌজন্যের ঠেকা নিয়েছে? এই প্রশ্নই এই মুহুর্তে সর্বত্র ঘোরাফেরা করছে।

এবার আসা যাক কালীগঞ্জে, যে ঘটনার প্রতিবাদে আয়োজিত জনসভায় বিরোধী নেত্রীর এই ‘অশ্রাব্য’ ভাষণ।

এক্ষেত্রে প্রথমে রটানো হয় কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে শাসকের বিজয় মিছিল থেকে বোমা ছুঁড়ে খুন করা হয় সিপিআই(এম) পরিবারের ছোট্ট শিশু ক্লাস ফোরের ছাত্রী তমান্না খাতুনকে। কিন্তু পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় তমান্নাদের বাড়ি মোটেই কোন রাস্তার ওপর নয়। ফলে রাস্তার বিজয় মিছিল থেকে অজ্ঞাত দুষ্কৃতীদের বোমা ছুড়ে মারবার গপ্পোটা নিছকই মনগড়া। এটা পুলিসের তরফে রটানো হয়েছিল আসল কালপ্রিটদের আড়াল করতে। আসল ঘটনা অন্য। শাসকদলের প্রার্থী উপনির্বাচনে জিততে চলেছে খবর আসায় দুপুরের পর থেকেই মোলান্দী গ্রামে শাসকদলের লুম্পেনরা তমান্নাদের পরিবারের মত সিপিআই(এম) সমর্থকদের বাড়ি গুলোকে টার্গেট করে সকেট বোম ছুঁড়তে থাকে। এমনকি ‘হুসেনের মেয়েটাকে ঝেড়ে দে’ বলে রীতিমত টার্গেট করে আট বছরের তমান্নাকে তার বাড়ির উঠোনে তার মায়ের চোখের সামনে বোমা মেরে খুন করা হয় । বোমার আঘাতে তমান্নার গলা থেকে বুকের সামনের অংশটা মাংসপিন্ডর মত খুবলে উঠে আসে। বাড়ির উঠোন ভেসে যায় ছোট্ট তমান্নার রক্তে। হ্যাঁ যা লিখছি তাতে এতটুকু অতিরঞ্জন নেই। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ডের পর স্বয়ং জেলার পুলিশ সুপার তদন্তে এসে অপরাধীদের আড়াল করতে ঐ উঠোনে দাঁড়িয়ে দূর্ঘটনার তত্ত্ব খাড়া করবার চেষ্টা করেন। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে বলবার চেষ্টা করেন ওটা একটা বিস্ফোরণের ঘটনা। প্রাক্তন আইপিএস তথা বর্তমান শাসকদলের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর তমান্নার বাবা-মায়ের মুখ বন্ধ করতে হাজির হয়ে যান বিশ লাখ টাকার অফার নিয়ে।
মানে মদ্দা কথাটা হলো শাসকদল-পুলিশ প্রশাসন -ইডি-সিবিআই -আদালত-আইনসভা সবাই মিলে হাতেহাত মিলিয়ে আসল অপরাধীদের আড়াল করে দাঁড়াচ্ছে, তারা মানুষ ‘সুবিচার’ পাক চাইছে না । এরা সবাই মানুষের বুকের ওপর বসে আম জনতার গলা টিপে ধরতে চাইছে। আর এটা চলছে লাগাতার বিগত দশটা বছর ধরে।

এরপরও আমরা চুপ থাকবো? এমন লাগামহীন প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে আম জনতার মুখের আগল কিছুটা খুলে গেলে কি সেটা আদৌ অপসংস্কৃতি?

মানুষের পাল্টা প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা। এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া প্রয়োজন ওপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর মত আরও অজস্র অনুরূপ ঘটনা আছে যার এখানে উল্লেখ করা হলো না যাতে প্রতিবেদনটাকে ছোট রাখা যায়।

এখন আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস! শাসক বা বিরোধী পোষ্য কোন প্ল্যাটফর্ম নয়। আমাদের অতি সামান্য হলেও কিছু পাঠক আছেন। কাজেই তাদের কাছে আমাদের উদ্দেশ্যে মানুষের পালটা ছুড়ে দেওয়া এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার একটা দায় আমাদের থেকেই যায়।

আমাদের স্পষ্ট কথা । শাসকের বিরুদ্ধে চিৎকার করুন। আওয়াজ তুলুন। ভিড় জোটান। কিন্তু তারপরেও সভ্য সমাজে ‘খিস্তি’ বা ‘অপশব্দ’র কোন জায়গা নেই। সিংহাসনে বসা রাজা বা রাণীর চরিত্রের ওপর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজনীতি ও প্রশাসনের রাজধর্ম পালন নির্ভর করে ঠিকই, কিন্তু সেই অনুযায়ী

রাজনীতির ভাষা বদলে গেলে সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। কারণ কালের নিয়মেই স্বৈরাচারী রাজা-রাণী পালটে যায়, সংসদীয় গণতন্ত্রে কিছুটা প্রজাবৎসল কিছুটা কঠোর নতুন শাসক ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু মুখের ভাষাতে একবার আগলখোলা অপশব্দ ঢুকে গেলে তা বদলানো কঠিন এবং এটা সংক্রামকও বটে। তখন আর সমাজবিরোধী-লুম্পেনদের থেকে নিজেকে আলাদা করে চেনা যায় না। বরং একটা সময় পর নিজেকে ওদেরই লোক বলে মনে হতে শুরু করে। ‘আমিও অনেক গুন্ডা কন্ট্রোল করি’ বলে যিনি ক্ষমতাসীন হন তিনি যে নিজেও একজন গুন্ডা হবেন এবং লুম্পেনতন্ত্রই কায়েম করবেন সেটা বুঝতে ভুল হয়ে যায়, কারণ ঐ একটাই….তার সাথে ঐ মুখের ভাষাটা মিলে যায় বলে।

আর তাই আজকের গুন্ডারাজ–লুম্পেনতন্ত্র উৎখাতের লড়াইতে যিনি ক্যাপ্টেন হবেন তার মুখে অপশব্দ আমরা শুনতে চাই না। আমরা চাই না কোন কু’কথার ক্যাপ্টেনকে। মিনাক্ষী সাবধান হোন। আমরা চাই কালীগঞ্জের জনসভার কু’ভাষ্য একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে থাকুক। আর আম জনতা মিনাক্ষীর কু’ভাষ্য নয়, মিনাক্ষীর লড়াইয়ের পাশে থাকুক।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস