সিভিক পুলিশ মানেই সিটি অফ ‘ভয়’ / Civic Sena

কলকাতা, একসময় যার পরিচিতি ছিল ‘সিটি অফ জয়’ নামে, বিগত এক দশকে পরিবর্তনের জমানায় ধীরে ধীরে সেই শহরের অন্য এক চেহারা সামনে এসেছে। এক সময় নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে কলকাতা ছিল দেশের মধ্যে সেরা। আজকের কলকাতায় সেই পুরানো কলকাতার ছায়া মাত্র অবশিষ্ট নেই। কোথায় গেল সেই ‘নিরাপদ’ কলকাতা, যে শহরকে শিক্ষা ও শিল্প-সংস্কৃতির রাজধানী বলা হতো! সেই শহরটা কি ক্রমশ ‘সিটি অফ ভয়’-এ পরিণত হচ্ছে! ক্রমবর্ধমান অপরাধ, দুর্নীতি, এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে শহরের মানুষ আজ আতঙ্কিত। কিছুদিন আগেও, যেখানে কলকাতায় মানুষ রাতে বিনা ভয়ে চলাচল করত, এখন সেখানে রাত বাড়ার সাথে সাথে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। নারী নির্যাতন, দুর্বৃত্তদের উৎপাত, এবং প্রশাসনের উদাসীনতা শহরের মানুষকে এক ভয়ের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য করেছে।

আর গত পরশু আর জি কর হাসপাতালের মধ্যে কর্মরত জনৈক চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা শহরবাসীর ফের একবার সেই আতঙ্ক বা ভয়টাকেই উস্কে দিয়েছে।

যারা সিপিএম করেন তারা বলবেন শহরের এ অবস্থা একদিনে হয়নি। শুরুটা করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই! ক্ষমতায় বসবার পর ছয় মাস পেরোতে না পেরোতেই যেদিন তিনি ভবানীপুর থানায় ঢুকে গ্রেপ্তার হওয়া দুষ্কৃতীকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন সেদিনই রাজ্যের দুষ্কৃতীরা বুঝতে পেরেছিলেন, এটা তাদের সরকার, বাংলার মানুষের না। পরবর্তীতে সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেকথা প্রকাশ্যে বলেও ছিলেন। কেউ কেউ আবার বলবেন শুরুটা হয়েছিল পার্কস্ট্রীটে সুজেট জর্ডান ধর্ষণ কাণ্ড দিয়ে…. ধামাচাপা দিতে ঘটনার ন্যয়নিষ্ঠ তদন্ত করছিলেন বলে তদন্তকারী উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার দময়ন্তী সেনকে সে সময় স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ‘পানিশমেন্ট পোস্টিং’এ পর্যন্ত যেতে হয়! আর যাঁর ‘বয়ফ্রেন্ড’ ধর্ষণ করেছিল সেই টলিঊড সুন্দরীকে তিনি লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাট থেকে টিকিট দিয়ে জিতিয়ে পাঠিয়েছিলেন সংসদে।

কিন্তু আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করি এর শুরুটা হয়েছিল ২০১১-তে বাম জমানার অন্তিম লগ্নে যখন তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে ‘আমিও অনেক গুণ্ডা কন্ট্রোল করি’ বলে সাধারণ মানুষের হাততালি কুড়িয়েছিলেন, আর তৎকালীন ‘ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পাওয়া’ সমগ্র বাঙালী জাতিকে খবরের কাগিজ পড়িয়ে ‘এগিয়ে রাখা’ প্রথমসারির সংবাদ মাধ্যমগুলো একযোগে সোচ্চারে ঘোষণা করেছিল ‘প্রশাসক মমতা বার্তা দিলেন’! কিন্তু সত্যিটা হলো সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে নয়, গুন্ডাবাহিনীর রিং মাস্টার খুন-রাহাজানি চালিয়ে লুটেপুটে খেতেই গুণ্ডা কন্ট্রোল করে। আর তাই কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতানেত্রীর পক্ষেই গুণ্ডা কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় না এবং সেটা সমীচীনও নয়। বাঘের পিঠে চাপলে এত সহজে নামা যায় না। বাম-ডান কোন দলই অতীতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।

যাইহোক পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটলে লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই আর জি কর কান্ডে ফেরা যাক। সেখানে হাসপাতালের মধ্যেই নিজের কর্মস্থলে একজন মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করবার পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে, যা খুব স্বাভাবিক কারণেই সর্বস্তরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, ওই মহিলা চিকিৎসক একটানা ৩৬ ঘন্টা ডিউটি করে রাতের খাবার খেয়ে সেমিনার হলে পড়াশোনা করছিলেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি উনি চিকিৎসা শাস্ত্রের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রীও। তাঁর বসবার জন্য কোনো আলাদা ঘর না থাকায়, তিনি ওই হলেই পড়তে বসেছিলেন। আর ঠিক সেই সময়েই এই জঘন্য ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট যেখানে তিনি প্রতিদিন কাজ করতেন, যেটা তার বাড়ির পর সবথেকে বেশি সুরক্ষিত জায়গা হওয়ার কথা ছিল, সেই ‘সেফ’ স্পেসেই ঘটল এই নারকীয় ঘটনা। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ধর্ষণকারী তার পেলভিক বোন ভেঙে ফেলে এবং যোনি থেকে চোখ পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। অভিযোগ প্রথমে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু ছাত্রদের প্রবল চাপে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে সত্য উদ্ঘাটিত হয়। আর শুধু কেবলমাত্র ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টাই নয়, হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতাও আমাদের অবাক করেছে। কারণ যিনি ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন সেই মূর্তিমান সঞ্জয় রায় একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থার সাথে কোন রকম পেশাগত যোগ না থাকা সত্বেও হাসাপাতালের মধ্যে তার ছিল অবাধ যাতায়াত! কার প্রশ্রয় বা মদতে ঐ ব্যক্তির হাসপাতাল চত্বরে অবাধ আনাগোনা জানাটা জরুরি। আজ যা একজন কর্মরত চিকিৎসকের সাথে হচ্ছে, কাল তা একজন মহিলা রোগীর সাথে হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়! এদিকে আর জি কর থেকে অসমর্থিত সূত্রে জানা যাচ্ছে, পোস্টমর্টেমে ৫ জনের সিমেন পাওয়া গেছে। কিন্তু রিপোর্টে নাকি সেটা লুকোন হয়েছে। মানে ধর্ষণ নয়, গণ ধর্ষণ!

এখন যে দক্ষিণপন্থীরা মশা থেকে হাতি সবেতেই হিন্দু-মুসলিম করে বেড়ায়, তারা আশাকরি এক্ষেত্রে সঞ্জয় রায়-এর (ধর্ষক ও খুনি) জাত ধর্ম দেখবেন না। ভাগ্যিস ছেলেটা মুসলিম নয়। তাই হিন্দু আপাতত “খতরে মে” নেই। মুসলিম হলে ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে হতো। তার ওপর আবার শুনছি ছেলেটার চার-পাঁচটা বিয়ে।

কিন্তু আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস (কু)কীর্তিমানের একটা অন্য পরিচয় দেখবো। তিনি একজন সিভিক পুলিশ। মানে যে পুলিশ বাহিনী আমাদের সুরক্ষা দেয় সেই পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই আশ্রয় নিচ্ছে দাগী অপরাধীরা। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা তদন্তে জানতে পেরেছেন এই জনৈক ব্যক্তির নাকি অপরাধ মনস্কতা ছিল। তারপরেও সে কিভাবে কাজে বহাল রইলো প্রশ্নটা কিন্তু উঠবে। কারণ সিভিক পুলিশদের বেয়াদপি কোন নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও বহুবার এমন ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। আপনাদের মনে থাকবে হাওড়ার আনিস খান কে তার বাড়িতে ঢুকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিয়ে খুন করেছিল একদল সিভিক পুলিশই, যা নিয়ে শহর উত্তাল হয়েছিল। এছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আরও বহু অবাঞ্ছিত ঘটনা এই সিভিক পুলিশ বাহিনী ঘটিয়েছে এবং ঘটিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই বর্ধমানের ভাতারে জনৈক সিভিক ভলেন্টিয়ার মহিলা চিকিৎসক কে ‘আর জি কর করে দেবো’ হুমকি দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে বলে সামনে এসেছে।

এখন এই সিভিক ভলেন্টিয়ার কারা! এরা হলো আমাদের এই ‘ঈশ্বর পরিত্যক্ত’ বাংলায় যথাযথ কাজ না পাওয়া শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত যুবক যুবতী যারা শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের বদান্যতায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়ে কাজ পাওয়া অস্থায়ী চুক্তি ভিত্তিক পুলিশ। এদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোন স্বচ্ছতা নেই। স্থানীয় নেতাদের চামচাগিরি করলেই এই কাজ সহজে পাওয়া যায়। এরা বহু ক্ষেত্রেই লোকাল থানায় খাঁকি উর্দি পরিহিত পুলিশের ওপর শাসকের হয়ে খবরদারি চালায় বলে অভিযোগ। নির্বাচনের সময় বুথে বুথে শাসকের হয়ে ভোট লুঠ করতেও এদের ভূমিকা থাকে বলে রাজ্যবাসীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমনকি পুলিশের হয়ে বহুক্ষেত্রে তোলাবাজির কাজটাও এদের দিয়ে করানো হয় বলে দেখা ও শোনা যায়।

আনিস খানের খুনের ঘটনায় সিভিক পুলিশের জড়িত থাকবার ঘটনা সামনে আসতেই রাইজ অফ ভয়েসেস সোচ্চারে এই সিভিক পুলিশ ব্যবস্থা বন্ধ করবার দাবী করেছিল। তা নিয়ে আমাদের একাধিক প্রতিবেদন রয়েছে। আর জি কর ধর্ষণ কাণ্ডে ফের একবার সিভিক পুলিশের বেয়াদপি সামনে আশায় আমরা ফের একবার সেই দাবী জানাচ্ছি। এই মুহুর্তে রাজ্য পুলিশে শূন্যপদ কয়েক লক্ষ। সরকারের কোষাগারে টাকা নেই বলে সে সব পদে নিয়োগ আপাতত শিকেয় উঠেছে। আর তার পরিবর্তে মাসিক মাত্র দশ-বারো হাজার টাকা দিয়ে দেদার চুক্তি ভিত্তিক অস্থায়ী সিভিক পুলিশ নিয়োগ করে সেই অভাব পূরণের চেষ্টা চলছে। এতে একদিকে যেমন তারা শাসকের ডান হাতে পরিণত হচ্ছে তেমনই শাসকও রাজ্য জুড়ে চলা কর্ম সংস্থানের সংকটে কিছুটা মলম লাগাতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি হচ্ছে আমাদের।

পুলিশ বা সেনাবাহিনীর মতো রেজিমেন্টারি ফোর্স যারা দেশ ও দশের নিরাপত্তার জন্য নিবেদিত সেখানে এরকম বল্গাহীন অস্থায়ী চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের বিরোধী আমরা। তাই আমরা যেমন অগ্নিপথ/অগ্নিবীর প্রকল্পের বিরোধী তেমনই বিরোধী সিভিক পুলিশের। এখুনি সিভিক পুলিশের নামে আমাদের করের টাকায় শাসক দলের লুম্পেন পোষবার সরকারী ব্যবস্থা বন্ধ হোক। চুক্তি ভিত্তিক নীল পুলিশ নয়, স্থায়ী খাঁকি পুলিশ নিয়োগ চালু হোক। কিন্তু ভোট ব্যাঙ্ক ‘বড় বালাই’। মীনাক্ষী বা শুভেন্দুরা কি পারবে সেই দাবী জানাতে! আমরা দেখবো কার শিরদাঁড়ায় কত দম!

আপনরা রাইজ অফ ভয়েসেস পড়ুন এবং সঙ্গে থাকুন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস