দুয়ারে গরম / A “Man-Made” Project

যখন আপনার আমার পাড়ায় পুকুর ডোবা বুজিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ মদতে বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছিল, তখন আমরা চুপ থেকেছি। কেউ কেউ আবার একটু এগিয়ে বলেছি এগুলোর থেকে পাড়ায় যতদিন যাচ্ছে মশা-মাছি, সাপখোপ পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়ছে। তার থেকে বাবা বুজিয়ে দিয়ে ভালই করছে।

যখন পাড়ায় খেলার মাঠ চুরি করে সেখানে মল-মাল্টিপ্লেক্স বানাবার তোড়জোড় চলছে তখনও আমরা চুপ থেকেছি। ভেবেছি বাড়ির পাশে একটা মল-মাল্টিপ্লেক্স থাকলে তো বেশ ভালই হয়। সবাইমিলে বেশ দিব্যি একটা বেড়াতে যাওয়ার সিনেমা দেখবার জায়গা হবে। তাছাড়া আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা আজকাল মাঠেঘাটে খেলে কই! তারা তো ভিডিও গেম খেলে। কাজেই মাঠটা শুধুশুধু খালি পড়ে আছে। বরং একটা কাজে আসুক।

যখন এলাকায় রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের প্রশ্রয়ে দেদার গাছ কাটা চলছে, তখন নিজের ছাদে বা বারান্দার এক চিলতে বাগানে ফোটা গোলাপ-ডালিয়া-সূর্যমুখির পাপড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে ভেবেছি আমার গাছ তো নয়! যাদের গাছ তারা বুঝুক গে! আমি আমার বাগানেই খুশি!

আর আমাদের এই আত্মকেন্দ্রিকতা ঔদাসীন্যর কারণেই গত এক দশকে শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই হারিয়ে গেছে ৩৫০০ এর বেশি জলাশয়! তাহলে বাকি রাজ্যের অবস্থাটা ভাবুন। বাংলার প্রথমশ্রেণীর কোন সংবাদমাধ্যমেই এই পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা হয়নি। আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস খোঁজাখুঁজি করে এই তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম, গত বছরের অক্টোবর নভেম্বর মাসে বাংলার খুঁটিনাটির প্রথম কিস্তিতে

এরপর ২০২২ এর শুরুতেই মানে জানুয়ারী মাসে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব ২০২১-২২ সালের বন সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেন। প্রতি দুই বছর অন্তর এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। সেই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে গত একদশকে মানে ২০১১ থেকে ২০২১ এর মধ্যেকার দশ বছর সময় যেখানে দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই বা হায়দ্রাবাদের মত শহরগুলিতে সবুজায়ন বেড়েছে যথাক্রমে ১১%, ৯%, ২৬% এবং ১৫% সেখানে আমাদের কলকাতাতে কমেছে ৩০%। মানে আমাদের কলকাতা শহরে গত এক দশকে দেদার গাছ কাটা হয়েছে যার ফলে ১% বা ২% নয়, এক্কেবারে ৩০% সবুজাবৃত এলাকা কমে গেছে। সেসময় বাংলার এক-দুটি ইংরেজী সংবাদপত্র ছাড়া কোন প্রথমশ্রেণীর সংবাদপত্রেই এই খবর ছাপা হয় নি। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্যি যে, কোন বাংলা সংবাদপত্রেই এই নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করা হয়নি। আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস কিন্তু এই খবরটাও আপনাদের সামনে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছিলাম বাংলার খুঁটিনাটিতে “গাছ পালাচ্ছে” শিরনামে

খবরের তো অভাব ছিল না। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম এই খবরগুলো সামনে আসুক। আজও খবরের অভাব নেই। তবুও ফের একবার পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটলাম। কারণ এই যে আজ আমরা গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে জ্বলে পুড়ে মরছি, হা-পিত্যেশ করে বসে আছি কালবৈশাখীর অপেক্ষায়, অথচ পাচ্ছি না ঝড়-বৃষ্টির হদিস, তার জন্য আমাদের এই নির্বিচারে গাছ-পালা কেটে পুকুর ডোবা বুজিয়ে কংক্রিটের জঙ্গল বানানো অনেকাংশে দায়ী। মানে এটি প্রকৃতপক্ষে একটি “ম্যানমেড” ক্রাইসিস। একথা আমরা বলছি না। বলছেন মান্যগণ্য পরিবেশবিদ আবহাওয়াবিদরা। শুধুমাত্র বাংলায় নয়, ইংরেজি ভাষাতেও বলছেন। তাই সম্প্রতি আইপিসিসি’র ৩৬৭৬ পাতার রিপোর্টে বারে বারে উঠে এসেছে কল্লোলীনী কলকাতার নাম

কাজেই আসুন এবার অন্তত আমরা সতর্ক হই। গাছ লাগাই। জলাশয় বাঁচাই।

একটি গাছ আর একটি প্রাণ নয়, অনেক প্রাণ ভেবে এগোতে হবে আমাদের।

IPCC রিপোর্ট ডাউনলোড করুন

ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) মানব-প্ররোচিত জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত তথ্যানুসন্ধান এবং সমাধানের জন্যে গঠিত জাতিসংঘের একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা। এটি ১৯৮৮ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা অনুমোদিত হয়। জেনেভা, সুইজারল্যান্ডে এদের সদর দফতর, এটি 195টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত।