সব চরিত্র ধার্মিক / Is this Politics!

এখনকার চারপাশের রাজনৈতিক ধারাভাষ্যে আমার মূলতঃ দুটি পরিচয়। কারোর চোখে আমি সনাতন হিন্দু ব্রাক্ষণ। আর কারোর চোখে, আমি ভোটার কিন্তু “দুধেল গাই” নই। যদিও কিছুদিন আগেও পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে আমার ধারণা হয়েছিল, আমি ভারতবর্ষের একজন সাধারণ নাগরিক। কিন্তু ইদানীং আর তেমনটা মনে হচ্ছে না।

এখন আপনাদের মনে হতে পারে আমি হঠাৎ এমন বেয়ারা ট্যারাবাঁকা কথা দিয়ে গৌরচন্দ্রিকা করছি কেন!

কারণ আপনাদের একটা ছোট্ট ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০২২। আজ থেকে মাত্র ৬৬ দিন আগে একটা তরতাজা প্রতিবাদী ছেলে তার নিজের বাড়িতে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেল। তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। কারণ তারাই ধরতে যাওয়ার নাম করে রাত বারোটার পর ছেলেটির বাড়িতে চড়াও হয়। তার বাড়ির লোককে বন্ধুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে তাকে তাড়িয়ে ছাদ পর্যন্ত নিয়ে যায়। আর তারপর ছেলেটি ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। পুলিশের বক্তব্য এটি একটি নিছকই দুর্ঘটনা। আর পরিবারের অভিযোগ তাদের বাড়ির তরতাজা ছেলেটিকে পুলিশই ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। এখন আমরা এই দুই তত্ত্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সত্য খুঁজছি।
ইতিমধ্যেই ধৃত পুলিশকর্মীরা সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেছে, সেদিন রাতে যুবকটির বাড়িতে ওপরওলাদের নির্দেশে তারাই গিয়েছিলেন। তারমানে সেদিন অকুস্থলে পুলিশ উপস্থিত ছিল এনিয়ে সন্দেহের আর কোন জায়গা নেই। তাহলে পুলিশের কথামত যদি এটি নিছক দুর্ঘটনাই হবে, তবে পুলিশকর্মীরা ঘটনার পরপরই এমন দুদ্দার করে ঘটনাস্থল ছেড়ে পালালেন কেন! আর থানা থেকেও প্রথম দিকে পুলিশ যায়নি বলে বলা হল কেন? কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশই তো আসে বলে আমরা চিরকাল দেখে এসেছি! কিন্তু এক্ষেত্রে এমন উলট পুরাণ হল কেন! খুনী ছাড়া অকুস্থল থেকে কেউ পালিয়ে যায় বলে আমরা শুনিনি কোনদিন! এমনকি ছেলেটির মৃতদেহের প্রথম ময়নাতদন্তও দায়সারা ভাবে পরিবারের লোকের অনুপস্থিতিতেই পুলিশ সেরে ফেলে এবং তারপর তা কবরও দিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে হইচই হওয়ায় মৃতদেহ ফের কবর থেকে তোলা হয় এবং আবার নিয়ম মেনে ময়নাতদন্ত করলে দেখা যায় প্রথম আর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টের মধ্যে বিস্তর ফারাক! যদি নিছক দুর্ঘটনাই হবে তাহলে কি ধামাচাপা দিতে পুলিশের এত তৎপরতা!

এমন আরও অজস্র প্রশ্ন আছে যার উত্তর এখনও অধরা। আমরা সেসব বিস্তারে যাচ্ছি না, কারণ বিষয়টি বিচারাধীন। আর এই মামলার মাননীয় বিচারপতি তার ওপরে আদালত অবমাননার অভিযোগে মুচলেকা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। যদিও ইতিপূর্বেই সেইসব বহুপ্রশ্নের অবতারণা আমরা আগেই করে ফেলেছি যা আপনারা রাইজ অফ ভয়েসেসের ফেসবুক পেজে চোখ বোলালেই পেয়ে যাবেন। তাই পুরানো কাসুন্দি আর ঘাটলাম না।

“কবর” দেওয়ার খবর পড়ে আপনারা জেনে গেছেন ছেলেটি ধর্মে মুসলমান ছিল। কিন্তু আপনারা অনেকে যা জানেন না তাহল ছেলেটি সব ধর্মের মানুষের জন্যে রক্তদান শিবির আয়োজন করত। ছেলেটি রাষ্ট্রশক্তির ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব ছিল। ছেলেটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত পরিচালন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত সংখ্যালঘু নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সরব ছিল। মানে ছেলেটি ছিল একজন শিক্ষিত প্রতিবাদী সমাজকর্মী। কিন্তু তাকে আমরা চিহ্নিত করেছি নিছকই একজন মুসলমান হিসেবে।

কারণ ঘটনার পরপরই হইচই শুরু হতেই শাসকের পক্ষ থেকে সমাজমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমগুলিতে ক্রমাগত বলা হতে থাকলো মুসলমান বলেই এত হইচই হচ্ছে। খাতায় কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদলকে তো সেভাবে প্রতিবাদ প্রতিরোধে রাস্তায় পাওয়াই গেল না, কারণ তাঁরা আবার পাকেচক্রে নিজেদের সনাতনী হিন্দু বলে দাবী করেন। এমনকি এনাদের পেটোয়া প্রথম শ্রেণীর কয়েকটা টিভি চ্যানেল সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু না হলে সারাদিন কি দেখানো হবে তা নিয়ে রীতিমত চিন্তায় পড়ে যেত।

কিন্তু মুখে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আসল দোষীদের খুঁজে বার করা হবে বলা হলেও, গতকাল যখন ৬৬ দিনের মাথায় ছেলেটার মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলে আদালতে প্রমান করার চেষ্টা হল তখনও চলল সেই খবর চেপে দেওয়ার খেলা। ভেতরের পাতার চলে গেল সে খবর। এভিল কে লেসার বানিয়ে রেখে সংখ্যালঘু ভোট যতটা পারা যায় ধরে রাখবার চেষ্টা আর কি!

যাদের চোখে আমি সনাতন হিন্দু ব্রাক্ষণ, তারা যে মুসলমান যুবকের পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে সেভাবে মুখ খুলবে না সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আশপাশে ভোট না থাকলে যে “তিনি” নিজের পোষ্য দুধেল গাইদেরও খড়-বিচুলি বা বিচার কোনটা দিতেই বাধ্য থাকেন না, সে খবরটা আদৌ কোন দুধেল গাই পড়লেন কি! বা তেনার নামে অনুপ্রাণিত যারা সেদিন প্রতিবাদী নাগরিক মিছিলে পা না মিলিয়ে সিটের তদন্তে আস্থা রেখেছিলেন তাদের নজরেও কি আদৌ পড়েছে খবরটা!

আমার নাগরিক সত্ত্বাও খবরটা পড়লো। কিন্তু তারপর….

সেকি শুধুই ল্যাংচা খেয়ে ঢেঁকুড় তুলবে! নাকি গ্রেটার এভিলের ভয়ে চুপ থাকবে! নাকি দুএকটা প্রতিবাদী ফেসবুক পোষ্ট করে হাওয়া গরম করে আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে!

পরিশেষে জানাই, গতকাল শুনানির পর বিচারক যা জানিয়েছেন তার সারমর্ম হল এটি যে দুর্ঘটনা নয়, হত্যা সেটা আদালতের কাছে প্রমাণের দায়িত্ব নিহত যুবকটির পরিবারের। কারণ এক্ষেত্রে অভিযুক্ত পুলিশ স্বয়ং নিজে। মানে সোজাকথায় যুবকটির পরিবারকে এবং তার আইনজীবীকে পুলিশ হয়ে উঠতে হবে। না হতে পারলে যুবকটি বিচার পাবে না। আর এখানেই সিবিআই তদন্তের যৌক্তিকতা! পরবর্তী শুনানি ধার্য হয়েছে ১২ ই মে।

মাননীয় বিচারপতি আশাকরি শুনানি পর্বটি আর বেশি দীর্ঘায়িত না করে, সুবিচারের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।