শিক্ষা : মধ্যবিত্তের পকেটখালিকরণ ও মুচলেকা লেখন / Education Now!
আজকাল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা ভাবলেই মনে আসে স্কুলে ভর্তি আর লেখাপড়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ফিস, তার সাথে আলাদা করে স্টাডি সেন্টারে হাজার হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে, গৃহশিক্ষকদের বদলে নতুন পড়াশোনার দোকান। হ্যাঁ, আপনি আপনার সন্তানকে তথাকথিত “নামী” স্কুলের এল.কে.জি’তে ভর্তি করতে গেলেও গড়পড়তা বছরে ১ লক্ষ টাকা করে দিতে হয়। হাই স্কুলে সেই টাকার পরিমানটা ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা। আর বোর্ড শেষ করে উচ্চ শিক্ষার কোনো হিসেব করা সম্ভব নয়। অথচ আজ থেকে দশ-বারো বছর আগেও শিক্ষা ব্যাবস্থাটা এরকম ছিলোনা।
যারা কথায় কথায় বলেন, ৩৪ বছরে বামেরা কি করেছে তাদেরকে জানিয়ে দিই, বামেরা দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যজুড়ে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। আজকের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বাপ-মায়েরা যারা ইংরেজি মাধ্যমে বিশ্বমানের শিক্ষাব্যাবস্থার জন্য গলা ফাটাচ্ছেন, তাদেরমধ্যে বেশিরভাগই বাম আমলের সেই অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারী ও সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল গুলোতে বিনা পয়সায় বা দেড়শো-দুশো টাকা বাৎসরিক মাইনে দিয়ে লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মোটা মাইনেওয়ালা বড় উচ্চপদস্থ চাকুরে হয়েছেন। তাই আজ তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকে লক্ষ লক্ষ টাকা ফিস দিয়ে বেসরকারী কর্পোরেট স্কুলগুলোতে ভর্তি করতে পারছেন। সেদিক থেকে বিচার করলে, বাম আমলের অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল কি?
এপ্রসঙ্গে আমাদের ভুললে চলবে না শিক্ষা হল একটি সার্বজনীন বিষয়। সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারও বটে। আর এজন্যই এর খরচাপাতি সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, গরীব মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকা উচিৎ। আর এটা তো কোন কর্পোরেট করতে পারে না। এজন্যই সরকার বলে একটা বস্তু এখনও আছে। বাম আমলের রাজ্যজুড়ে চালু অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থাটির ক্রমাগত মানোন্নয়ন ঘটিয়ে পরিকাঠামো বৃদ্ধি করে সেটিকে আরও কার্যকরী করে তোলা উচিৎ ছিল বর্তমান সরকারের। কিন্তু বিগত এক দশকে রাজ্য বা কেন্দ্র কোন সরকারই সে পথে হাঁটল না। উল্টে রাজ্য সরকার শিক্ষক নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণে জড়িয়ে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিতেই অচলাবস্থা তৈরি করল। স্কুলছুটের সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে যে মিড ডে মিলের ভাবনা, তার চাল-ডাল ডিম চুরির ভুরি ভুরি অভিযোগ জমা হল। মিড ডে মিলের টাকা আত্মসাৎ করবার অভিযোগও সামনে এল। ফলে মানুষের আস্থা এবং নির্ভরতা কমতে থাকলো সরকার পরিচালিত স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায়। একবেলা পেটভরে খেতে পাবে এই আশায় যে সমস্ত প্রান্তিক পরিবারের বাবা-মা রা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতেন, মিড-ডে মিল অনিয়মিত ও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বা তার গুনগত মান খারাপ হতে থাকায় তারাও আর বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবার তাগিদ অনুভব করলেন না। ফলে ছাত্র সংখ্যা কমতে শুরু করল সরকার পরিচালিত স্কুলগুলোতে। শিক্ষক নিয়োগেও অস্বচ্ছতা ও অচলাবস্থা জারি রইল। আর তারপর সবশেষে হাজির হল করোনা মহামারী। আর এই ত্রিফলা আক্রমণে সরকার পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা এক ঝটকায় বেশ খানিকটা কমে গেল। এমন তথ্যই উঠে এল মহামারী পরবর্তী সমীক্ষাগুলোতে।
আর এমন সরকারী অব্যবস্থারই অপেক্ষায় ছিল বেসরকারী কর্পোরেট সংস্থাগুলো। দিকে দিকে খুলে ফেলা হল ফ্রাঞ্চাইজি মডেলে বেসরকারি ঝাঁ চকচকে স্কুল। বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় সিবিএসসি বা আইসিএসসি বোর্ডের অধীনে। রাজ্য শিক্ষাপর্ষদ কার্যত কোণঠাসা। আর প্রায় সবকটাই ইংলিশ মিডিয়াম যদিও এখনও বেশিরভাগ দেশ বিদেশের শিক্ষাবিদ মনে করেন মাতৃভাষায় শিক্ষাদান সবথেকে আদর্শ। আসলে আমাদের বাঙ্গালীদের ইংরাজী ভাষার প্রতি দুর্বলতাটা সর্বজনবিদিত। আর সেটাকেই বুদ্ধি করে কাজে লাগালো কর্পোরেট সংস্থাগুলো। চালু হল লাখ লাখ টাকার বাৎসরিক স্কুল ফি। তারপরও ইচ্ছেমত টাকা আদায়ের ফন্দি ফিকির। এমনকি এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না, এমন দেদার মুচলেকা আদায়ও চলছে অভিভাবকদের কাছ থেকে। আর অভিভাবকরা দিচ্ছেনও !
অথচ বর্তমান রাজ্য সরকার এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে রাজি নয়। আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস অবশ্য ডিজিটাল ডিভাইড বা প্রযুক্তিগত বিভেদ নিয়ে “সরকার খেলে ও খেলায়, আপনাকে ও আমায়” শীর্ষক শেষ পর্বের প্রতিবেদনটিতে এমন বেসরকারিকরণের ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছিলাম।
বেশ কয়েক মাস আগে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতির একটি অনলাইন প্রাইভেট টিউশন সংস্থার হয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচারে কোমর বেঁধে নেমে পরবার খবর সামনে এসেছিল। আমাদের সরকারের পেটোয়া প্রথমশ্রেণীর সংবাদ মাধ্যমগুলো সেখবর চেপে দেওয়ায়, আপনারা অনেকেই তা জানতে পারেননি।
মাস দুয়েক আগে একবার আমাদের রাজ্যের শিক্ষাদপ্তরেও সরকারি ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে যে “পিপিপি” (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) নামক বাঁশিটা আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রীরা বাজিয়ে থাকেন সেটা বেজে উঠেছিল। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তা তখনকার মত ধামাচাপা দেওয়া হয়।
কিন্তু এবার আর কোন ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। স্পষ্ট বার্তা এল কলকাতা সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের অঙ্গ হিসেবে “অতিমারীতে শিক্ষার হাল” শীর্ষক আলোচনায় খোদ বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে। তিনি জানিয়েছেন “মুখ্যমন্ত্রী সকলের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দিতে চান। সেই লক্ষে বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে রাজ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর জন্য গত এক দশক ধরে রাজ্য সরকার একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে যার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী হয়েছে।” এমনকি রীতিমত পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন সার্বজনীন শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে কিভাবে শিক্ষাক্ষেত্রকে বর্তমান রাজ্যসরকার বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। শিল্প সম্মেলনের আবহে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, গত এক দশকে রাজ্যে ৫০০ টিরও বেশি বেসরকারি স্কুল তৈরী হয়েছে। ১১ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা; স্কুল শিক্ষায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর সাথে এই দুই খাতে আরও যথাক্রমে ২ হাজার ৫০০ কোটি এবং ১ হাজার ২০০ কোটির বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। অবশ্য উনি এছাড়া কি বা করতে পারতেন! কারণ আলোচনা সভার চেয়ারম্যান ছিলেন শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া!
কিন্তু বার্তাটা স্পষ্ট। রাজ্য সরকার পরিচালিত স্কুল শিক্ষাব্যবস্থায় অদূর বা সুদূর কোন ভবিষ্যতেই আর সেই দশ-বারো বছর আগেকার সুদিন ফেরবার আশা নেই। সরকারের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং নিজেই সরকারের তরফে এখন শিক্ষার বেসরকারীকরণের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ।
যারা টিচারের চাকরির জন্য ফুটপাথে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন তারা ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়ুন। তৈরি হয়ে যান “সিভিক টিচার” হয়ে অর্ধেক মাইনেতে বেসরকারি স্কুল কলেজগুলোতে গাধার খাটুনি খাটতে।
আর আমাদের মত অভিভাবকদের বুঝতে হবে, “পরিবর্তন চাই”-এর সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আজ আমার আপনার দুয়ারে। মুচলেকা লিখুন। লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিন। ছেলেমেয়েদেরকে স্কুল পাঠান।
“খেলা হবে” না, খেলা শুরু হয়ে গেছে।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্র
a) https://www.facebook.com/RiseOfVoices/posts/238851921757206
b) https://www.anandabazar.com/west-bengal/education-minister-bratya-basu-said-education-sector-is-getting-better-after-covid-19/cid/1339841
c) https://epaper.anandabazar.com/imageview_62832_43313521_4_71_21-04-2022_3_i_1_sf.html
d) https://www.anandabazar.com/west-bengal/students-should-be-allowed-to-go-to-school-even-if-fees-is-not-cleared-dgtl/cid/1339606
e) https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/guardians-reaction-on-dps-newtown-undertaking-policy-dgtl/cid/1339452
f) https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/dps-newtown-stricks-to-their-undertaking-policy-dgtl/cid/1339433
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-02-16/202202152349547.jpg&category=0&date=2022-02-16&button=
h) https://www.telegraphindia.com/west-bengal/bengal-education-department-mulls-public-private-partnership-in-schools/cid/1852086
Comments are closed.