প্রযুক্তিগত বিভাজন / Digital Divide

ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল/আর যাব না ইস্কুল!

করোনা মহামারী চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ পেরিয়ে এবার তৃতীয় ঢেউয়ের দোরগোড়ায় আমরা।
স্কুল কলেজ বন্ধ। ইউনিভার্সিটিও তাই। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বলে নয়, সারা দেশেই এখন প্রায় এই অবস্থা। এটা চলছে সেই ২০২০ র মার্চ মাস থেকে, মানে সেই যবে থেকে প্রথম লকডাউন বা নাকাবন্দি ঘোষণা করা হয়েছিল তবে থেকে। মাঝে কোন কোন রাজ্যে অবিন্যস্ত ভাবে মাস দুয়েক স্কুল চালু হলেও ফের তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে অযথা রাস্তাঘাটে ভিড় করবেন না । খুব দরকার ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোবেন না। নাহলে করোনা ছড়িয়ে পড়বে। মহামারী এড়াতে রাস্তাঘাটে, হাটে বাজারে, গণপরিবহনে বা অফিস কাছারিতে সামাজিক দূরত্ববিধি এবং কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

কিন্তু এরপর যেটা চলছে তা হল স্কুল কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি, মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে বাকি সব কিছুই মহামারীর মধ্যে মোটামুটি খোলা রয়েছে। এছাড়া আর যা বন্ধ রয়েছে তা হল তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবসায় যুক্ত সংস্থাগুলি। তাদের কর্মচারীদের বলা হয়েছে বাড়ি থেকে কাজ করতে, যার গালভরা নাম “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” । সরকারী বা বেসরকারী অফিস থেকে শুরু করে বাজার, দোকান, মল-মাল্টিপ্লেক্স, হোটেল, রেস্তোরাঁ, মদের দোকান, সেলুন সবই খোলা রয়েছে। চলছে সিনেমা সিরিয়ালের শুটিংও। কোথাও কোথাও যেমন সিনেমা হল, রেস্তোঁরা বা জিমের ক্ষেত্রে অথবা গণপরিবহণের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ববিধি বজায় রাখবার জন্য ৫০% বা তার কম সংখ্যক জনসমাগম ঘটিয়ে কাজ চালানোর কথা বলা হয়েছে। কিছু সরকারী বা বেসরকারী অফিসেও এমন দূরত্ববিধি মেনে চলবার নির্দেশ জারি রয়েছে। কিন্তু সেসব কতটা মানা হচ্ছে তাও যে আমরা দেখতে পাচ্ছি না তা নয়। যেমন মানুষ যাতে রাস্তায় কম বেরোয় তার জন্য গণপরিবহণের সংখ্যায় হ্রাস টেনে কার্যত একটা বিরাট অংশের চাকুরীজীবী, শ্রমজীবী মানুষ যাদের বাড়ি বসে চাকরি করবার সুবিধে নেই, তাদেরকে এক প্রকার সরকারের তরফে মহামারীর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, কারণ গণপরিবহণের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ায় ভিড় হচ্ছে। মহামারীপূর্ব সময়ের মতই যেখানে দূরত্ববিধির বালাই নেই। একই অবস্থা রাস্তাঘাটে হাটে বাজারে। কারণ ঠিক কতজন লোক হলে ৫০% জনসমাগমের উর্দ্ধসীমা ছাড়িয়ে যাবে সেটা কোন আধিকারিকের পক্ষে অকুস্থলে দাঁড়িয়ে গুনে গুনে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়। এমনকি মেলাও হচ্ছে ! চলছে ধর্মীয় উৎসবও! ভোটও হয়ে যাচ্ছে শাসকের মন-মর্জি মাফিক। কলকাতা এবং তার শহরতলির কোথাও কোথাও শীতের ছুটিতে ছোট বড় জলসা বা পিকনিকও হয়েছে। বড়দিন উপলক্ষে কাতারে কাতারে পার্কস্ট্রীট বেড়ানো বা নিউইয়ারের দিনে চিঁড়িয়াখানা বা ইকোপার্কে ঢুঁ মারাও হয়েছে। কোন বাপের ব্যাটা বলতে পারবে না যে, এই সব ক্ষেত্রে কোভিড প্রোটোকল মেনে সবকিছু হয়েছে। এমনকি কোর্টের বিচারপতিদেরও এব্যাপারে রায় শুনলে বোঝা যাচ্ছে তারাও “শ্যাম রাখি, না কূল রাখি” বুঝতে পারছেন না। এরই মধ্যে মানুষের দেশ-বিদেশে বেড়াতে যাওয়াও যে চলছে, তা তাদের ফেসবুক পেজ বা ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট দেখলেই টের পাওয়া যাচ্ছে। সিনেমা সিরিয়ালের শুটিংও চালু আছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে মেগা সিরিয়ালের প্রযোজকদের তরফে সব্বাইকে বলে দেওয়া হয়েছে কেউ কোভিড আক্রান্ত হলে পাঁচ-কান করে আতঙ্ক ছড়াবার দরকার নেই। যার যখন হবে নিয়ম মত কোয়ারান্টিনে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরে আসুন। মানে নর্মাল ব্যাপার। সিক লিভ নেওয়ার মত। এর পাশাপাশি উল্টোদিকে আবার কোন সেলিব্রিটি কোভিডে আক্রান্ত হলেন আর কোনজন সুস্থ হয়ে উঠছেন তারও নিয়মিত আপডেট আসছে সমাজমাধ্যম গুলিতে! মানে সব চলছে যে যার নিয়মে!

ব্যতিক্রম হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান! এর দরজা সপাটে বন্ধ। পাছে স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের কোভিড হয়!

আমরা যে বাবা- মায়েরা মহামারীর মধ্যেই বাচ্চাকে নিয়ে মল-মাল্টিপ্লেক্সে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ফুচকা খাচ্ছি, ঠাকুর দেখছি, চিড়িয়াখানা যাচ্ছি অথবা তেমন সুযোগ পেলে কাছে বা দূরে বেড়িয়েও আসছি তারাও বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে নারাজ! সত্যি কি তাই!

নাকি একদিকে খুব দরকার ছাড়া রাস্তায় বেরোবেন না সতর্কবার্তা ছড়িয়ে এবং অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করে দিয়ে সরকারের তরফে একপ্রকার আমাদের বাবা-মায়েদের মগজ ধোলাই করা হল যে লেখাপড়াটা এমন কিছু দরকারি নয় যার জন্যে রাস্তায় বেরোতে হবে, স্কুল-কলেজ -ইউনিভার্সিটি যেতে হবে আর আমরা বাবা-মায়েরাও তাতে সায় দিয়ে বসলাম!

এটা কি সেই মানিকবাবুর হীরক রাজার দেশের গ্যাদ্গ্যাদে তত্ত্বকথা “যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে” অনুসারে একটা আস্ত সমাজকে শাসক কর্তৃক বশ করবার চক্রান্ত, নাকি সেই চক্রান্তের বৃত্তটা বা মাঠটা আরো বড় যা আমাদের তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট যাঁরা এই ধরণের বস্তাপচা ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে উদয়ন পণ্ডিত নিয়ে মিম বানিয়ে হাততালি কুড়োচ্ছেন তাদের উপলব্ধির বাইরে! জানবো একটু পরে।

গরীব মাঠেঘাটে / আমরা বাঁচি ঠাটে

মানব সভ্যতার সঙ্কটের শুরু সেদিন থেকে যেদিন থেকে সে শহর আর গ্রামে ভাগ হয়ে গেল, আর আমরা শহুরেরা গ্রামে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে নাগরিক পরিষেবা ও সুযোগ সুবিধাগুলিকে বংশ পরম্পরায় বগলদাবা করে ভোগ করতে শুরু করলাম। ভাবতে শুরু করলাম এ হল আমাদের জন্মগত অধিকার। ভুলে গেলাম যারা শহর থেকে দূরে গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে জন্মায়, তাদেরও কিছু জন্মগত অধিকার আছে। তারমধ্যে যেমন একটি হল শিক্ষার অধিকার। শিক্ষা হল একটি সার্বজনীন বিষয়। এটা পূজোর জামা কাপড় নয়, যে যার পছন্দ মত সামর্থ অনুযায়ী কিনল বা কিনল না। এটা পাতের ভাত মাথার ছাদ আর গায়ের কাপড়ের মতই ভীষণই একটি প্রাথমিক বা মৌলিক চাহিদা। সংবিধান স্বীকৃতও বটে।

কিন্তু শিক্ষাদানের পীঠস্থান স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলি গত প্রায় দুবছর হতে চলল বন্ধ রয়েছে। অথচ তাই নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা বা আলোচনা নেই। সংবাদমাধ্যম গুলিও নীরব! রাজ্যের শাসক দল এবং প্রধান বিরোধী দল কারোর মুখেই এব্যাপারে টুঁ শব্দটি নেই। শহরাঞ্চলে বা তার আশপাশের জনপদগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগের তেমন কোন সমস্যা নেই। আর এখানকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর প্রায় অধিকাংশই আর্থিকভাবে কম্প্যুটার/স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট সংযোগের খরচ যোগাতে মোটামুটি সক্ষম। ফলে মহামারীর মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে চালু হয়েছে অনলাইন স্কুলিং ব্যবস্থা। এখন এই বিকল্প অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা সত্যি স্কুল কলেজের বিকল্প কি না তা আলোচনা করবো একটু পরে। কিন্তু ঐ যে বলছিলাম আমাদের বাপ-মায়েদের মগজ ধোলাইয়ের কথা, আমরা ধরে নিয়েছি বাড়িতে বসে বাইরে না বেরিয়ে এই চালু হওয়া অনলাইন স্কুল বেশ ভালোই। যাতায়াতের ঝামেলা নেই। বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসার ঝক্কি নেই। কাজেই সব্বাই চুপ।

কিন্তু সমাজের পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুগুলো যাদের বাপ-মায়েদের উপার্জন সীমিত, অত খরচাপাতি করে ল্যাপটপ/স্মার্টফোন কেনবার ক্ষমতা নেই, নেই ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ, কোনরকমে এক চিলতে ঘরে যাদের বাস। তাদের পক্ষে ঘরে বসে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ নেওয়া একরকম অসম্ভব। ফলে তারা জাস্ট ছিটকে যাচ্ছে শিক্ষার আঙ্গিনা থেকে। এমনকি আমাদের রাজ্যে এমন বহু জেলা আছে যার একটু ভেতরের দিকে গেলেই দেখা যাবে ইন্টারনেট ব্যবস্থা সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে। মোবাইলের সিগনাল পেতে ছাদে উঠতে হয়। এমন সব জায়গায় যাদের বাস তাদের এমনকি আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও তারা এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারবে না। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৯ সালের সমীক্ষার তথ্য বলছে দেশের কমবেশি ২৫% মানুষের কাছে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছাতে পেরেছে। আর শুধুমাত্র গ্রামের হিসেব কষলে এই সংখ্যাটা মাত্র ৪%। তাছাড়া গাঁ-গঞ্জের স্কুলগুলিতে স্কুলছুটের হার কমাবার লক্ষ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের মিড-ডে মিল বা একবেলার পুষ্টিকর খাবার বিতরণের ব্যবস্থা আছে, যা স্কুল-বন্ধ থাকবার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। বাচ্চাদের থালা থেকে ডিম পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে একটা বিরাট অংশের শিশু এবং ছাত্রছাত্রী এই মহামারীর কারণে এভাবে স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে চলে যাবে। কেউ বনে যাবে বা গেছে শিশু শ্রমিক। মাঠেঘাটে বা পরিযায়ী হয়ে দূরদূরান্তে পাড়ি দেবে কাজের সন্ধানে। কারোর বিয়ে হয়ে যাবে এবং ব্যস্ত হয়ে যাবে ঘর সংসারের কাজে। অনেক ছাত্রী এরমধ্যে গর্ভবতীও হয়ে পড়েছে। মহামারীতে পারিবারিক বিয়োগ বা আর্থিক ধাক্কা সময়ের সাথে হয়তো সামলানো সম্ভব, কিন্তু শিক্ষাহীনতার ধাক্কার ফল সামজিক ও আর্থিক দুদিক থেকেই সুদূরপ্রসারী হয়ে থেকে যাবে আগামী কয়েক প্রজন্ম ধরে ।

অথচ আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তের ভাবখানা এমন যেন “যেসব শিশুরা অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না এটা একান্তই তাদের বাপ-মা বা অভিভাবকদের চিন্তা। তারজন্য আমি শুধুশুধু চিৎকার করতে যাব কেন! আমার বাড়ির বাচ্চা যখন অনলাইন ক্লাস করতে পারছে ল্যাঠা চুকে গেল! এই মহামারীর মধ্যে নিজের বাচ্চাকে স্কুল পাঠিয়ে তাকে খামোখা মহামারীর মুখে ঠেলে দেব কেন!”

আর আমাদের মহামহিম সংবাদমাধ্যমও মূলতঃ শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় ঠিক যেমন গাঁ-গঞ্জের খবর চট করে হেডলাইন বা ব্রেকিং নিউজ হয় না, ঠিক তেমনই এই স্কুল-কলেজ -ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকায় গাঁ-গঞ্জের গরীবগুরবো শিশুদের শিক্ষাঙ্গন থেকে ছিটকে যাওয়া নিয়ে তেমন কোন তাপ-উত্তাপ দেখায় না। চ্যানেল বা কাগজের অতিথি মনস্তত্ত্ববিদেরা লকডাউনে গৃহবন্দী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে যতটা আলোচনা করছেন, শিক্ষাঙ্গন বন্ধ করে অনলাইন লেখাপড়া চালুর ফলে শিশু কিশোর-কিশোরীদের মানসিকতায় তার কুপ্রভাব নিয়ে বা যারা স্কুল-কলেজ থেকে ছিটকে পড়ছে, জড়িয়ে পড়ছে শিশুশ্রম বা বালিকা বিবাহের জালে তাদের মনস্তত্ব নিয়ে তার ছিটেফোঁটা আলোচনাও করছেন না।

তাই আমাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে এই বিভাজন কতটা প্রযুক্তিগত আর কতটা আর্থসামাজিক! এমনকি গরীব -বড়লোকের বিভাজন অথবা শহর-গ্রামের উন্নয়নের ফারাক ঢাকতেই এই “প্রযুক্তিগত বিভাজন” বা “ডিজিটাল ডিভাইড” শব্দমালাটি জন্মালো কি না তা নিয়েও আমাদের সন্দেহ রয়েছে! আর আমরা যারা আবেগবাস্প কন্ঠে দুটো ভারতের কথা বলে বাহবা কুড়োই তারা কি আদৌ নিজেদের মধ্যে বেঁচে থাকা “আমি” থেকে “আমরা” য় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি!

বাজাও স্কুলের ঘন্টা/কেমন করে মনটা

স্কুল মানে কি শুধুই বই-খাতা! পরীক্ষা-মার্কসিট!

স্কুল কি কেবলই একটা কেরিয়ার বা একটা চাকরি অথবা খানিকটা অর্থ উপার্জনের দিকে প্রথম কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার সোপান!

তাহলে ঝগড়া-আড়ির মধ্যে বেঁচে থাকা বন্ধুত্বের অনুভূতি, টিফিন ভাগ, খেলা-গান-নাটক-আবৃত্তি ইত্যাদি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি অথবা স্যার-দিদিমণিদের শাসন ও স্নেহের সেই ডুয়েলের মুহুর্তগুলোর কি কোন দাম নেই! ক্লাসঘর, ভাঙ্গা বেঞ্চ, স্কুলের মাঠ, লাইব্রেরির বই এগুলোও তো অনলাইন ক্লাসে গায়েব!

আমরা আসলে স্কুলে শুধু লেখা-পড়া করতে যাই না। ওটা হল আমাদের চেনা পরিচিত গন্ডির বাইরে সামাজিকতার প্রথম ধাপ! মানব সভ্যতা সমাজবদ্ধ একটি ব্যবস্থা। “বাড়িবদ্ধ” নয়! স্কুল তাই জন্মের পর প্রথম অচেনা অজানা পরিবেশ থেকে উঠে আসা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও মেধার একঝাঁক মানুষের একসাথে কয়েকঘন্টা থাকবার প্রথম চেষ্টা! এটা আমাদের সভ্যতার শিকড়! কাজেই শুধু পুঁথিগতবিদ্যা বা নম্বর বগলদাবা করা নয়, স্কুল আমাদের পরবর্তী জীবনে সমাজের আর পাঁচটা মানুষের সাথে মিলে মিশে সুখ দুঃখ ভাগ করে বাঁচতে শেখায়।
অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা এই সব থেকে আমাদের শৈশবকে দূরে সরিয়ে রেখে শিশুদের অসামাজিক জীবে পরিণত করবে।

এমনকি এরফলে শহরের শিশুরা যারা নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তাদের অনেকেই ল্যাপটপ এবং মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাড়ছে চোখের সমস্যা। চাপ পড়ছে মস্তিস্কে। প্রকৃতির সাথে আমাদের যে সম্পর্ক ও সহাবস্থান যা কিনা মানব সভ্যতার মূল ভিত্তি সেখানে আঘাত আসছে। বাড়ির বাচ্চারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দার মত বাঁচতে শিখছে যার ভবিষ্যৎ পরিণাম ভয়াবহ! শুধু তাই নয় এই মুহুর্তে যেসমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা এই অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করছেন তাদের বেশিরভাগেরই এব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নেওয়া নেই। নেই অনলাইন মূল্যায়নের অভিজ্ঞতাও। ফলে শিক্ষার মানও প্রশ্নের মুখে! কাজেই শহুরে বাপ-মায়েরা জানুন, কেন অনলাইন থেকে অফলাইনে ফেরা জরুরি!

আর যারা এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ নিতে পারছে না তারা শধু পিছিয়ে পড়ছে না হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গন থেকে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে লেগে পড়ছে দু-পয়সা রোজগারে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কম বয়সে। হয়ে পড়ছে গর্ভবতী! সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে গ্রামের ৩৭% শিশু এবং শহরের ১৯% বাচ্চা এই স্কুল বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার সাথে তাদের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আবার সমীক্ষায় এও দেখা যাচ্ছে শিশুদের বাড়িতে আটকে রেখে স্কুল কলেজে যেতে না দিয়ে পার্কে যেতে বারণ করেও তাদের ৯০% এর দেহে কোভিড এর অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে অর্থ্যাৎ করোনা ভাইরাস তাদের শরীরে কোন না কোনভাবে প্রবেশ করছেই! যদিও এরপরেও এই মহামারীতে শিশুমৃত্যুর হার এক প্রকার নগণ্য!

আর তাই সবদিক বিবেচনা করে দেশের স্বনামধন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসক অথবা শিক্ষাবিদেরা স্কুল খোলবার সমর্থনে মুখ খুলছেন।

তাহলে সরকার কেন এব্যাপারে চুপ! লক্ষ লক্ষ শিশু এই মহামারীতে অনাথ হওয়ার পরেও ভোট হচ্ছে! ভোটের মিটিং-মিছিল হচ্ছে! মেলা হচ্ছে! খেলা হচ্ছে! উৎসব হচ্ছে! কাজেই শিশুদের কথা ভেবে সরকার বা কর্তৃপক্ষের রাতে ঘুম হচ্ছে না এমনটা ঠিক নয়। তাহলে স্কুল-কলেজ খুলতে এত আপত্তি এত ভয় কেন সরকারের!

নাকি বাপ-মায়েদের ভয় পাইয়ে অন্য কোন ফায়দা লোটবার চেষ্টা!

সরকার-খেলে ও খেলায় / আপনাকে ও আমায়

আমাদের দেশে স্কুল আছে কমবেশি ১৫ লক্ষ। আর কলেজ আছে ৪২ হাজার। এরমধ্যে কমবেশি ১৩ লক্ষ স্কুল এবং ২৫ হাজার কলেজ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। এখন বিশেষজ্ঞদের মতে এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারী উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পর্যায়ক্রমে সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন ক্লাস চালু করা যেতেই পারে। কারণ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলির আশপাশে যথেষ্ট খোলা জায়গা/পরিসর রয়েছে। আর খোলা জায়গায় শারীরিক দূরত্ব মানলে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক কম। এমনকি একই ভাবে ক্লাসরুমের প্রতিটি জানালা দরজা খোলা রেখে ক্লাস করানো যেতেই পারে। এতে সংক্রামিত হওয়ার ভয় থাকে না। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতেও এই ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু সরকার, কি কেন্দ্র কি রাজ্য, কেউই তেমন সাহস বা সদিচ্ছা দেখাতে পারছে না।

আর এখানেই উঁকি মারছে অন্য সন্দেহগুলো!

প্রথমতঃ একটি ক্লাসকে দুটি বা তিনটি ভাগে ভাগ করে শারীরিক দূরত্ববিধি এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল চালু করতে সাধারণ অবস্থার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক ইউনেস্কোর সমীক্ষায় দেখা গেছে এই মুহুর্তে সারা দেশ জুড়ে ১১ লক্ষের বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকার পদ খালি পড়ে রয়েছে। আর এর ৬৯% রয়েছে গ্রামীণ অঞ্চল গুলিতে। আমাদের দেশে ১ লক্ষের মত স্কুল রয়েছে যেখানে শিক্ষক বা শিক্ষিকার সংখ্যা মাত্র ১ জন। আমাদের রাজ্যেই ১ লক্ষ ১০ হাজার শিক্ষক/শিক্ষিকার পদ খালি রয়েছে যার মধ্যে ৬৯% খালি পদ রয়েছে গ্রামাঞ্চল গুলিতে। আমরা খুব ভালো করেই অবহিত আছি যে গত দশ বছরে শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে এবং এই সংক্রান্ত মামলা-মকদ্দমাতে অভিযোগের সত্যতা এবং সারবত্তা বহুলাংশে প্রমাণিতও হয়েছে। বর্তমান শাসকদলের একটা বড় অংশ আগাপাশতলা এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে। আপাতত বহু পদের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। আর এমন নিতান্তই পরিকাঠামোগত অপ্রতুলতার কারণে মহামারীর মধ্যে কোভিড বিধি মেনে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যথাযথ পর্যবেক্ষণ বা সতর্ক প্রহরার মধ্যে স্কুল চালানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।

এমনকি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ব্রিকস (BRICS) এর দেশগুলির মধ্যে আমাদের দেশ স্টুডেন্ট -টিচার অনুপাতের নিরিখে বাকি দেশ গুলির থেকে পিছিয়ে। আর তাই সরকারী তরফে বলা হচ্ছে স্কুল কলেজের বাচ্চারা কোভিড বিধি মানবে না কাজেই স্কুল বন্ধ থাক।

দ্বিতীয়তঃ এই মুহুর্তে কলকাতা শহর বা অন্যান্য শহরতলিতে অলিগলিতে চলছে প্রাথমিক বা প্রাইমারি স্কুল। এর বেশিরভাগই ইংলিশ মিডিয়াম এবং এখানে ন্যুনতম পরিকাঠামোর বালাই নেই। ক্লাসরুম গুলি ঘুপচি ঘরের মত। আলো-বাতাস তেমন খেলে না। স্কুল সংলগ্ন খেলার মাঠ নেই। স্কুলের মধ্যে নেই তেমন হাঁটা-চলার পরিসরও। পাড়ারই একটি বাড়িতে কোন একটি তলা ভাড়া নিয়ে চলছে স্কুল। আর ব্যবসার মত স্কুলগুলি চালিয়ে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ! সরকারী/পুরসভার ছাড়পত্র কিভাবে পায় এই স্কুলগুলি তা বোধগম্য হয় না। এখন সব বাবা-মা তো আর নামী-দামী সরকারী কিম্বা বেসরকারী প্রাইমারি স্কুলে নিজের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করতে পারেন না। এদের বড় অংশই যায় এই ধরণের স্কুলগুলিতে। আর এই ধরণের স্কুল গুলিতে কোভিড বিধি মেনে ক্লাস করানো বেশ শক্ত। এমনকি এখানে যে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ান তাদের অনেকের পড়ানোর প্রশিক্ষণও থাকে না এবং এদের বেশিরভাগ নিয়োগই অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক। কাজেই সেইরকম দায়িত্ববোধ বা অ্যাকাউন্টেবিলিটি থাকে না। মানে ঘুরে ফিরে সেই পরিকাঠামোর অভাব।

তৃতীয়তঃ এই মুহুর্তে যে বিকল্প ব্যবস্থাটি উঠে এসেছে সেটি হল অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা। একটু নজর করলেই দেখবেন ভারত সরকারের তরফে যে নতুন শিক্ষানীতির কথা বলা হয়েছে তাতেও এই ডিজিটাল বা অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে শিক্ষাকে মহার্ঘ্য করে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার প্রথম ধাপ। ফলে এনারা চাইছেন এই মওকায় মহামারীকে হাতিয়ার করে বেসরকারী অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার একটা মহড়া হয়ে যাক।

অবশ্য রাজ্য সরকার বা তার আধিকারিকরাও এব্যাপারে পিছিয়ে নেই। সম্প্রতি একটি বেসরকারি অনলাইন টিচিং সংস্থার ওয়েবসাইটে স্বয়ং রাজ্য মাধ্যমিক বোর্ডের সভাপতি, রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং বর্তমান শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে সংস্থার হয়ে প্রচার করতে। সঙ্গে রয়েছেন শাসক দলের সেলিব্রিটি বিধায়ক, প্রাক্তন সাংসদ। এমনকি দেখা যাচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর মত লোকজনকেও।

সরকারী পদে থেকে সরকারের থেকে, মানে আপনার আমার ট্যাক্সের টাকায় মাইনে নিয়ে বেসরকারি টিচিং সংস্থার হয়ে চলছে দেদার প্রচার। এরাই নাকি একসময় বাম আমলের শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে দেখতে পাওয়া প্রাইভেট টিউশনের প্রবণতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন !

এভাবে চললে মহামারী চলে গেলেও শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করতে চাওয়া নেতারা শিক্ষাকে আর সার্বজনীন রাখতে দেবেন না। মহার্ঘ্য বানিয়ে বড়লোকদের ভোগ্য পণ্য বানিয়ে ফেলবেন।

তাই আজ আমাদের সব্বাইকে মুখ খুলতে হবে! আর নাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://timesofindia.indiatimes.com/india/1-lakh-schools-in-india-run-with-just-1-teacher-each-unesco-report/articleshow/86798798.cms
b) https://www.indiatoday.in/education-today/news/story/india-s-student-teacher-ratio-lowest-lags-behind-brazil-and-china-1568695-2019-07-14
c) https://www.edexlive.com/news/2021/jun/11/aishe-2019-20-rural-india-has-60%E2%84%85-of-our-colleges-but-how-robust-is-the-primary-education-there-21607.html
d) https://allschoolsinindia.in/how-many-government-and-private-schools-in-india/#:~:text=As%20per%20the%20latest%20record,14%2C94%2C052%20schools%20in%20India.
e) https://timesofindia.indiatimes.com/india/37-students-in-rural-areas-19-in-urban-not-studying-at-all-survey/articleshow/86005203.cms
f) https://www.indiatoday.in/magazine/news-makers/story/20210111-school-of-hard-knocks-1755078-2021-01-03
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-21/202201202351232.jpg&category=0&date=2022-01-21&button=
h) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-21/202201210000287.jpg&category=0&date=2022-01-21&button=