মূল সমস্যা / Reply To ABP

প্রিয় সম্পাদক সমীপেষু
আনন্দবাজার পত্রিকা,

গত ২১ শে জানুয়ারী “মূল সমস্যা” শিরোনামে আপনাদের সম্পাদকীয় কলামটি অভিনব এবং মনোজ্ঞ ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। সম্প্রতি অক্সফ্যাম নামক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নূতন সমীক্ষা রিপোর্ট যেভাবে দেশের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যের উদ্দেশ্যে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছে তাহাই ছিল সম্পাদকীয় কলামটির মূল বিষয়বস্তু। আপনাদিগের ন্যায় অগ্রগণ্য সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদকীয় কলামে চলমান আর্থিক বৈষম্যের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হইবে ইহাই নিদেনপক্ষে কাম্য ছিল। কিন্তু তাহা হইল না! কেন হইল না বা কি হইল ইহা অবগত করিতেই আপনাদিগের চরণকমলে এই পত্র নিবেদন।

সম্পাদকীয় কলামটিতে স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের শাসনভার যে সকল দক্ষিণপন্থী শাসকের বলিষ্ঠ স্কন্ধে ন্যস্ত রহিয়া আসিয়াছে তাঁহাদের উল্লেখ না পাইয়া আমরা বিস্মিত হইলাম । এমনকি উহাদিগের হস্তে নির্মিত ভারতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাও হইল না। কলামে নেহেরু আসিল না! ইন্দিরা গান্ধী আসিল না! পাইলাম না বাজপেয়ী, নরসিংহ রাও অথবা মনমোহন সিংহর ন্যায় সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রীদের উল্লেখ। এমনকি চলমান এবং ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যে মোদী -মমতার ন্যায় বিগত এক দশকের দেশ ও রাজ্যের দিকদর্শী শাসককূলের ভূমিকা বা অবদানের কথাও খুঁজিয়া পাইলাম না।
কিন্তু কোন অনিবার্য কারণবশতঃ আসিল রাশিয়া! আসিলেন স্তালিন! এমনকি আসিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও! যদিও কবিগুরু রাশিয়ায় পদার্পন না করিলে ওনার আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য লইয়া দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ আদৌ পাইতাম বলিয়া কলামটি পঠন করিয়া মনে হয় নাই। “রাশিয়ার চিঠি” না হইয়া আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের চিঠি হইলে পিলসুজের নীচের অন্ধকারেই উহা রহিয়া যাইত কি না সন্দেহ জাগে। কলামটি কেবলই পিলসুজ-পিদিমের আলোর কারসাজি নাকি ইহাদের তৈল দিয়া দক্ষিণপন্থী শাসকদিগের তৈল মর্দন ইহা আমাদের ন্যায় সামান্য পাঠক পাঠিকাদের নিকট অজ্ঞাত থাকিয়া যায়।
কলামটির মূল বক্তব্য বা নির্যাস হইল যদিও বা দক্ষিণপন্থী ব্যবস্থায় বিগত সাত দশক ধরিয়া দেশ চালাইবার পরও দেশজুড়ে আর্থিক বৈষম্য বাড়িয়া চলিয়াছে তৎসত্ত্বেও এমন সন্ধিক্ষণে কবিগুরুর ন্যায় বামপন্থার সমালোচনায় স্পষ্টবাক হইতে হইবে এবং বামপন্থার ধ্বজা ধারণ হইতে বিরত থাকিতে হইবে। কারণ উহাদিগের বিপ্লব “বৈষম্য -অলক্ষ্মী” অথবা “লক্ষ্মী বনাম কুবের” ইত্যাদি উপমা টানিয়া পবিত্র সাম্যবাদী ক্রোধ প্রকাশেই নাকি সীমাবদ্ধ!

ইহার সহিত সম্পাদকীয় কলামটিতে আর্থিক বৈষম্যের সমস্যাটিকে “ন্যায় অন্যায়ের” মানদণ্ডে বিচার না করিয়া ইহার ব্যবহারিক সমাধান খুঁজিবার স্বপক্ষে মতামত প্রকাশ পাইয়াছে। আর উক্ত প্রসঙ্গে বামপন্থীদের উল্লেখ পুনরায় ফিরিয়া আসিতেই পারিত অথবা আসিবার বিস্তর সুযোগ রহিয়াছিল কিন্তু আসে নাই। কেন আসিতে পারিত তাহার দু একটি নিদর্শন তুলিয়া ধরিতে চাই। যেমন চতুর্ত্রিংশ বৎসরের বামপন্থী শাসনকালে আমাদিগের রাজ্যে দারিদ্রসীমার নিম্নে বসবাসকারী ব্রাত্যজনের সংখ্যা কমবেশি দুই তৃতীয়াংশ হ্রাস পাইয়াছিল বলিয়া খবর রহিয়াছে যাহা তদপরবর্তী এক দশকের দক্ষিণপন্থী শাসণকালে হ্রাস তো পাইতেছেই না উপরন্তু জনান্তিকে প্রচার ইহা ক্রমবর্ধমান! বাম মনোভাবাপন্ন অঙ্গরাজ্য কেরালাও মানব সম্পদ উন্নয়নের নিরিখে দারিদ্র দূরীকরণ, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি মানদণ্ডে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরিয়া দেশের অগ্রণীরাজ্যগুলির মধ্যে একটি বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। বাম সমর্থনের উপর নির্ভরশীল দক্ষিণপন্থী কেন্দ্রীয় সরকারের সময়কালেই দেশের মানুষের শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার অথবা প্রান্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়ের জল জঙ্গল জমির অধিকার স্বীকৃত হইয়াছে। অদ্য দেশ জুড়িয়া যে কটি জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পের দ্বারা প্রদীপের নীচের অন্ধকারে বসবাসকারী ব্রাত্যজনেরা কিয়দ সুরাহা পাইয়া থাকেন তাহার অনেকগুলিই বাম মস্তিষ্কপ্রসূত।

অতএব কোন বাধ্যবাধকতা বা অনুপ্রেরণা হইতে এমন সম্পাদকীয়র অবতারণা তাহার নান্দীমুখটি প্রদীপের আলোয় দেখিতে চাই! পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা উত্তর দক্ষিণপন্থী শাসন ব্যবস্থার অন্ধকার দিকগুলির নৈবর্তিক পর্যালোচনার দাবি জানাই। আর আপনাদিগের ন্যায় চতুর্থস্তম্ভের অগ্রনী প্রতিষ্ঠানগুলির এবং উহাদিগের কর্মীবৃন্দ ও কর্তৃপক্ষের ভুলিলে চলিবে না “বর্ষাকাল” রচনা আসিয়াছে। অতএব গরুর দিকে ধাবিত হইবার সুযোগ সীমিত। মনে রাখিবেন কিছু সভ্য পাঠক-পাঠিকা সভ্যতায় সর্বদা রহিয়া যায় যাহারা প্রদীপের আলোয় বড় হইবার সময় নীচের অন্ধকারের মানুষদিগকেও দেখিতে চান এবং পান। যদিও ইহাদিগকে বামপন্থী বলা যায় কি না জানা যায় না তবে ইহারা সত্য জানিতে ও মানিতে দ্বিধাহীন।

স্পষ্টবাক হইলাম বলিয়া যদি কষ্ট পাইয়া থাকেন তাহা হইলে ক্ষমাপ্রার্থী। জানিবেন আমরা নিতান্তই আপানাদিগের সংবাদপত্রের সামান্য একদল পাঠক -পাঠিকা। আমাদিগের ছবি সহ বিজ্ঞাপন প্রদানের ক্ষমতা নাই। নাই নাম কিনিবার বা ভোট কুড়াইবার সামর্থ বা ইচ্ছা। অতএব চিঠিটি দেখিয়া বিরূপ মনোভাব জাগিলে নিজগুণে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়া পিলসুজ-পিদিমের নীচের অন্ধকারে ব্রাত্যজনদের ভিড়ে নিক্ষেপ করিয়া দিলে বাধিত হইব। কারণ আমরা উহাদেরই একজন হইয়া বাঁচিতে চাই।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ : https://www.anandabazar.com/editorial/our-opinion/our-opinion-on-increasing-poverty-during-pandemic/cid/1324694