কি বলেছ দক্ষিণবঙ্গ? / South Bengal Files

বছর গড়ালেই লোকসভা নির্বাচন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বচনের পরে উপনির্বাচন, পৌর নির্বাচন আর দিনকয়েক আগে হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর অনেক “খেলা”ই বদলেছে। আর এই কয়দিনে বাঙলার চার প্রধানের খেলা ঠিক কতখানি বদলালো, সেটা নিয়েই আজকের বিশ্লেষণ।

গত এক বছরে নানান দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে ধরেছে রাজ্যের শাসক দলকে, তাদের বেশ কিছু ছোট বড় নেতা “শ্রী”ঘরে। কিন্তূ তারপরেও একের পর এক নির্বাচনে তাগড়া পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। এতগুলো নির্বাচনের মধ্যে মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘি একমাত্র ব্যতিক্রম হলেও, নবজোয়ারের জলে সাঁতার কেটে মুর্শিদাবাদের সীমানা অতিক্রম করে কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস ঘাটালে গা ভাসিয়েছেন উন্নয়নের জোয়ারে। এটাকেই পথচলতি মানুষ আবার ঠাট্টা করে বলছেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান

অন্যদিকে দেশের শাসক দল এবং খাতায় কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল নানারকমের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও, না পারছে তৃণমূল কংগ্রেসকে বাগে আনতে, না পড়ছে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে।

আর বাম-কংগ্রেস! তাহাদের কথা থাক।

এই মুহুর্তে আমাদের হাতে এসে পৌছেছে, রাজ্যের ২০টি জেলা পরিষদের নির্বাচনের পুঙ্খানপুঙ্খ রিপোর্ট। আজ সেগুলোই আলোচ্য।

যদি ধরে নেওয়া হয়, গ্রামে জেলা পরিষদ এবং শহরের পৌরসভা নির্বাচনে যে দল যত ভোট পেয়েছে, সেটাই যদি লোকসভায় রিপিট হয়, তাহলে সেই ফল নিয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কোন দল কোথায় এগিয়ে থাকবে অথবা পিছিয়ে থাকবে। তাই আজ আমরা বেছে নিচ্ছি দক্ষিণবঙ্গের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্রকে। যদিও গত পৌরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন পর্ব থেকে গণনা পর্যন্ত ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ সামনে এসেছে, তারপরেও যা ফল এসেছে, তার ওপর ভিত্তি করেই আজকের বিশ্লেষণ।

১. বোলপুর লোকসভা, বীরভূম

শাসক দলের অত্যন্ত শক্তিশালী কেন্দ্র এই লোকসভা। অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুকে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অন্যবারের মত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় না এলেও, বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯-এও এই আসন ছিল তাদের, এবারেও এই আসনের দাবিদার রাজ্যের শাসক দল। অঙ্কের সহজ হিসেব সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

পঞ্চায়েত + পৌরসভা২০১৯ লোকসভা
তৃণমূল৮,৪২,৫৭৫ ৬,৯৯,১৭২
বিজেপি১,৫৬,৬৪১ ৫,৯২,৭৬৯
বামফ্রন্ট১,৩৩,০৬৯ ৯১,৯৬৪
কংগ্রেস১৪,৮৬৩ ৩০,১১২

গত পৌরসভা নির্বাচনে বোলপুর এলাকায় শূন্য বাম কংগ্রেস প্রার্থী দিলেও, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল পৌরসভায় প্রার্থী দিতে পারেনি। যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে এবারের নির্বাচনে, প্রায় দেড় লক্ষ ভোট বাড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। সাথে ভোট বাড়িয়েছে বামেরাও। চল্লিশ হাজার ভোট বাড়িয়ে বিজেপির ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে বামেরা। উল্টোদিকে বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় চার লক্ষ ত্রিশ হাজারের বেশি। তাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই আসন অতি সহজেই যেতে পারে তৃণমূলের দখলে। তবে এই ট্রেন্ড দেখে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা সত্বেও বিজেপির ওপর অতি দ্রুত আস্থা হারাচ্ছেন বোলপুরবাসী, আর খুব অল্প হলেও তাদের আস্থা নতুন করে ফিরছে তাদের বামেদের ওপর।

২. কাঁথি লোকসভা, পূর্ব মেদিনীপুর

এবারে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পারিবারিক গড় কাঁথি লোকসভা। ২০১৯-শে এই কেন্দ্র থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে জয়ী হয়েছিলেন তার পিতা শিশির অধিকারী। তখন শুভেন্দুবাবুও ছিলেন তৃণমূলের ডাকাবুকো মন্ত্রী। দেখে সেবারের রেজাল্ট আর এবারের রেজাল্ট।

পঞ্চায়েত + পৌরসভা২০১৯ লোকসভা
তৃণমূল৭,৩৯,৮০৩ ৭,১১,৮৭২
বিজেপি৫,৯৮,৮৮১ ৬,০০,২০৪
বামফ্রন্ট৮৮,১৩১ ৭৬,১৮৫
কংগ্রেস৮,৪৪৮ ১৬,৮৫১

এই ফলাফল দেখে যে প্রশ্ন প্রথমেই মাথায় আসবে, তা হল, শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি যাওয়ার পরে কি কাঁথিতে অধিকারী পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা কি নিম্নগামী? শুনলে আশ্চর্য হবেন গত পৌরসভা নির্বাচনে কাঁথির ৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি চতুর্থ। বিজেপি প্রার্থী কৌশিক দাস পেয়েছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনে মুছে যাওয়া বাম প্রার্থীর চেয়েও ৯ ভোট কম পেয়েছিলেন। এবারেও যা ফল দেখা যাচ্ছে বামেরা টেনেটুনে হাজার বারো ভোট বাড়াতে পারলেও, বিজেপির মোট ভোট কমেছে হাজারখানেক। অন্যদিকে তৃণমূল ভোট বাড়িয়েছে প্রায় ২৭ হাজার। তবে যা ফলাফল এই কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে তাতে রাজ্যের ও কেন্দ্রের শাসক দলের কড়া টক্কর হতে চলেছে, যদি না আবার শেষ মুহূর্তে দলবদলা-বদলি না হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও এই কেন্দ্রে খুব সামান্য হলেও অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল।

৩. বসিরহাট লোকসভা, উত্তর ২৪ পরগনা

বসিরহাট, একসময়ের বামদুর্গ এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি। কয়েক বছর আগেও এই অঞ্চলে বামেদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়েছিল। অবস্থা এতটাই খারাপ পর্যায়ে গিয়েছিল যে, গত লোকসভা নির্বাচনে বামেরা এই আসনে পেয়েছিল চতুর্থ স্থান। আর বামেদের সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে দ্রুত উঠে এসেছিল বিজেপি।

পঞ্চায়েত + পৌরসভা২০১৯ লোকসভা
তৃণমূল৮,৪২,৪২৮ ৭,৮২,০৭৮
বামফ্রন্ট ১,৪৯,৯৭৬ ৬৮,৩১৬
বিজেপি১,০৯,৬২২ ৪,৩১,৭০৯
কংগ্রেস৫৫,৯৪৭ ১,০৪,১৮৩

গত পৌরসভা নির্বাচনে বামেরা বসিরহাট, বাদুরিয়া আর টাকি পৌরসভায় মোট ভোট প্রাপ্তিতে চতুর্থ স্থান থেকে এক ধাপ এগিয়ে তৃতীয় হয়েছিল। আর এক বছর কাটতে না কাটতেই তারা এই মুহূর্তে ভোট প্রাপ্তির নিরিখে তৃণমূলের পরেই দ্বিতীয়। গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে প্রায় আশি হাজার বাড়িয়েছে বাম, আর তৃণমূল বাড়িয়েছে ৬০,০০০। যদিও সংবাদমাধ্যমে জানা যাচ্ছে এই কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চলেছে শাসক দলের সন্ত্রাস। মিনাখাঁ, সন্দেশখালি ব্লকে ভোট যে হয়নি তা ফলাফল দেখলেই পরিষ্কার। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী সন্দেশখালি ব্লকে মোট ভোট পড়েছে ১,৩৬,৮৭৬ টি, যার মধ্যে তৃণমূল একাই ১,৩৩,২০৬। তবে বসিরহাট লোকসভায় যেভাবে বামেরা প্রত্যেক দিন যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে চলছে, এই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় খুব সহজ না হলে অবাক হওয়ার অবকাশ নেই। তবে বিজেপি কংগ্রেস এই আসনে সম্ভবত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে না, কারণ তাদের কেবল এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট কমেছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। এই আসনেও অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল কংগ্রেস।

দক্ষিণবঙ্গে তিন লোকসভা আসনের এই মুহূর্তের ফল পর্যালোচনা করে যা দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেস দক্ষিণবঙ্গে এখনও প্রবল শক্তিশালী। খাতায় কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি কেবল দুই মেদিনীপুর বাদ দিলে, গোটা দক্ষিণবঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। এবারে বামেরা, তারা কিন্তু আবার নব প্রজন্মের কাঁধে ভর করে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছে তাদের দুই রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি, তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে। আর রইল কংগ্রেস, দক্ষিণবঙ্গে তাদের অস্তিত্ব একেবারেই নেই।

আজ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গের তিন দিকে কোন দল কতটা প্রস্তুত তার পোস্টমর্টেম হল, এর পরে আমরা আলোচনা করব মধ্যবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের লোকসভা আসনগুলি নিয়ে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস