জোটদার কথা / The Alliance

ঘটনাক্রমে দুর্ঘটনাও কিভাবে সাধারণ গা-সওয়া ঘটনা হয়ে যায়, তা নিয়ে একটা মোক্ষম গপ্পো লিখেছিলেন নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়। গপ্পের প্রধান তিন চরিত্রের বড় তরফের লোভ খুব, পরিণতিজ্ঞান পোক্ত নয়। তিনি ফুচুদা। ভারী বামুন ভোজন খাওয়ার লোভ। তার জন্য অতিবর্ষণসিক্ত দিনে গ্রাম বাংলার সুদূরে যাওয়ার খেসারত যা দিতে হয়েছিল – একেবারে ল্যাজেগোবরে দশা। পরিষ্কার পাটভাঙা ধুতি জামা পরে প্রবল বর্ষণে এক হাঁটু কাদা জল ভেঙে মাইল কয়েক হেঁটে নিমন্ত্রণ বাড়ি পৌঁছনোর চক্করে বারংবার পতন। আছড়ে পড়া। নালায় ভেসে যাওয়া। ফুচুদা আর সঙ্গী প্যালা ন্যালাদের প্রথমে সবটা বিরক্তিকর পন্ডশ্রম মনে হলেও ক্রমে তারা এতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। মনে হতে থাকে এটাই স্বাভাবিক চলা। চলা মানে মোটেই দু পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাওয়া নয়; বরং হাঁটতে গিয়ে বারবার ডিগবাজি ও গড়িয়ে পড়া, উঠেই আবার আছাড় খাওয়া। তাই ধুতি খুলে নালায় ভেসে গেলেই কি, তারা নির্বিকার মুখে আছড়াতে পিছড়াতে বামুনভোজনের পাত পানে এগিয়ে চলতে থাকে – পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা ……।

বাইরন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণদলে যাওয়ার পরেও তাই ক’মাস আগে উদ্বেলবাহু বিজয়মিছিল বের করা সিপিআইএম নেতৃত্বরা বিমর্ষ হলেন না। শোকসভা বা আলোচনাসভাও আহ্বান করলেন না পার্টির কোনো স্তরে। বিশেষত নিচুস্তরে, যেখানে প্রশ্ন অবিরত, উত্তর নেই। বাইরন ভরা কংগ্রেসটারে মশলা দিয়ে রেঁধে সুখাদ্য করে নেওয়ার তাগিদ নেই। রয়েছে কেবল পার্টির ফুচুদাদের হুমকি সুলভ সাজেশন – সামনে পঞ্চায়েত ভোট, এসব আলোচনা এখন নয়, আর নয়। জোট নির্বিকল্প।

মুজাফ্ফর আহমেদ, বঙ্কিম মুখার্জী, পিসি যোশী , সোমনাথ লাহিড়ী (১৯৩৭)

স্ট্র্যাটেজিক এলায়েন্স, নির্বাচনী কৌশল এই শব্দগুলো সহজলভ্য, পেটেন্টপ্রাপ্ত, বাম রাজনীতিতে। এর বেশি বেশি ব্যবহার হয় তখন যখন বাম রাজনীতি নিজস্ব চলার পথ ছেড়ে অনেক দূরের বিপথে (ও বিপদে) পা চালাতে শুরু করে। মূল রাজনীতি অর্থাৎ শ্রেণী রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতা কে জায়েজ করতে, রণকৌশলহীন গোলে হরিবোল দেওয়াকে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিতে পরিণত করতে ব্যবহার হয় শব্দগুলো। শুনে মনে হয় যেন ওই নির্বাচনী কৌশল, স্ট্র্যাটেজিক এলায়েন্সই বাম রাজনীতির সারবস্তু। তাত্ত্বিক ও নৈতিক বামপন্থা বাস্তব চলার পথে কেটে রাখা খাল। (তাতে এমন সব কুমির আছে, যাদের মুখে না পড়াই ভালো।) এখন এড়িয়ে গেলেও একদিন কিন্তু আমরা ওই খালেই ডিঙা ভাসাবো – অনেক প্রশ্ন উঠলে এ আশ্বাসটুকু ওই খালপাড় থেকে অশরীরী কণ্ঠসম ভেসে আসে। কেমন গা শিউরে ওঠে। ও এরা পার্লামেন্টিয় মোড়কে ঢাকা বিপ্লবী তাহলে!

একাদিক্রমে চৌত্রিশ বছর রাজ্যপাট চালিয়ে প্রাথমিক নিষ্কৃতি মেলার পর বিভ্রান্তি হতাশা ইত্যাদির জন্য পার্টিটি বছর চারেক সময় নিয়েছিল। এরপর আবার সংগঠনদেহে নড়নচড়ন স্পন্দন দেখা যায়। এন্ড অফ হাইবারনেশন পিরিয়ড। (সত্যিই কি?)

সচল হয়ে উঠে একটি বামপন্থী পার্টি কোনদিকে ও কি চাইল? কি চাওয়ার কথা? অবশ্যই নিজের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো যেগুলো তাকে ক্ষমতাহারা নয় বস্তুত পথহারা করেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা। সেই অনুযায়ী নিজের রাজনীতির পথে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা। এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে ভবিষ্যৎ পার্টি আজও তার গঠনতন্ত্র থেকে বিলোপ করেনি, সেদিকে এগোনো। সব দিক দিয়ে বামপন্থী রাজনীতিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। কিন্তু এসব কোনো পথেই হাঁটতে চাইলো না সিপিআইএম, তার নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় স্তরে তদ্দিনে ভাবা হয়ে গেছে যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া ঠেকাতে… কংগ্রেসের হাত শক্ত করতে হবে। যে হাত ধরাধরি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ এ যথেষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই একই ভাবে তা ধরার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল। জনগণকে বোঝানোর জন্য ছিল ফ্যাসিস্ট ভার্সেস ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির তত্ত্ব। জনমনে প্রশ্ন ছড়ানো হচ্ছিল কংগ্রেস ছাড়া কেই বা আছে বিজেপি কে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করবার। দেশভাগের দায়ভার দাঙ্গার রক্ত ধুয়ে একের পর এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপে দেশকে সচেতনভাবে পুঁজিপতি শাসিত নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রে পরিণত করা, জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকে নিয়মবদ্ধ করা কংগ্রেসের প্রবাদপ্রতিম নেতারা পূজ্য সোস্যালিস্ট হয়ে সিপিআইএমের ওয়েবপেজে জায়গা করে নিতে শুরু করল। পড়াশুনার সাথে সম্পর্কহীন ক্যাডারদের কাছে উপরতলার প্রচারে গান্ধী-মার্ক্স প্রায় একই পথের পথিক হয়ে পড়ছিল এ সময় থেকে।

এরই সঙ্গে বাম রাজনীতির, বামেদের নিজস্ব শক্তির কি হবে, এ প্রশ্ন একেবারে অপাংক্তেয় করে দেওয়া হলো দলের ভেতরে বাইরে। এছাড়াও যেসব প্রশ্ন মুলতুবি রাখা হল, সেগুলি এরকম –

  • কংগ্রেস বুর্জোয়া নিঃসন্দেহে, প্রগতিশীল কোন অর্থে?
  • বিজেপি ও কংগ্রেসের অর্থনৈতিক পলিসিতে কি একচুলেরও পার্থক্য আছে?
  • সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে তো হবে। কিন্তু ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, প্রাইভেটাইজেশন, শ্রমিকের অধিকার ও পাওনা হরণ, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া, চিকিৎসার ঢালাও বেসরকারিকরণ, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল অকেজো করে দেওয়া, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোয় বছর বছর বরাদ্দ হ্রাস – এগুলো কি একটুও ন্যূন সমস্যা? বরঞ্চ এগুলোই কি সবচেয়ে বড়ো সমস্যা নয়? সে নিরিখে বিজেপি কংগ্রেসের মধ্যে প্রভেদ কোথায়? আর নরম হিন্দুত্ব শব্দবন্ধ যে পার্টির রাজনীতির সমার্থক, রাজনীতির প্রয়োজনে সেই পার্টিটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন করার কাজটা কি কখনো করেনি?

এসব প্রশ্ন শিকেয় তুলে, সবরকম যুক্তি ভুলে সংযুক্তি পথের পথিক হওয়া সত্ত্বেও সিপিআইএম-এর পলিটব্যুরো কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির নিরিখে রাজ্যে জোটের বিরোধিতা করেছিল। রাজ্য কমিটি তাতে কর্ণপাত করেনা। ২০১৫ সালে শিলিগুড়ি পৌর নির্বাচনে জোট তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করেন অশোক ভট্টাচার্য। ব্যাস। মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের বাম আকাশে চিত্রিত বেলুন উড়ল; যার প্রতিটিতে লেখা : জোট অবশ্যম্ভাবী ও একমাত্র বিকল্প – ইতি বামপন্থা এবং শ্রেণী রাজনীতি।

তাই বোধয় আজ বিড়ি কারখানার মালিক বললে কম বলা হয় – বিড়ি সাম্রাজ্যের মালিক বাইরনের জয়ে উদ্বাহু নৃত্য করতে গিয়ে এ প্রশ্ন জাগে না, বিড়ি শ্রমিকদের অনন্ত শোষণকারীটির জয়ে আসলে কোন শ্রেণী জেতে? আর সে বামেদের জোটমিত্র হলে বিড়ি শ্রমিকদের অধিকারের লড়াই লড়বার নৈতিক অধিকার ও আন্তরিকতা বামেদের কি অবশিষ্ট থাকে?

তো শিলিগুড়ি পুরসভা জয়ের নিরিখে ধরে নেওয়া হলো কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তৃণমূল বিরোধী ভোটগুলো আঙ্কিক ভাবে একজায়গায় এনে দ্রুত জয় করায়ত্ত করা যাবে। আত্মসমালোচনা, যুক্তিপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নতুন পথ নির্বাচন ও গণআন্দোলনের জটিল কিন্তু প্রয়োজনীয় আবর্ত ছেড়ে সহজে লক্ষ্য জয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। নিচের তলার ক্রমাগত শোরগোল, আপত্তি, মানুষের সাথে তাদের দৈনন্দিন সম্পর্ক থেকে উঠে আসা মতামতগুলো স্রেফ কানে তোলা হলো না। অচিরেই, ২০১৬ র বিধানসভা ভোট ফলাফলে মানুষ স্পষ্ট মতামত জানালো। ২০১৪ র লোকসভা ভোট, যখন জোট ছিলোনা, তখনকার ফলাফল ছিল : সিপিআইএম ৩০% এর কিছু বেশি, কংগ্রেস ৯% এর কিছু বেশি, উভয়ের মিলিত আসন ৯৫। এই ভোটগুলোই যোগ হবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যোগে বিয়োগ হল। সিপিআইএম এর মূলত। যুগ্মভাবে লড়ে ৯৫ টা সিট নামল ৭৬এ। সিপিআইএম এর ৩০% জনসমর্থন নামল ১৯%এ। একক চল্লিশটা সিট নামল ২৬এ। কংগ্রেসের ভোট কিন্তু ৯% থেকে বেড়ে হলো ১২% । সিটও দুটো বেড়ে হলো ৪৪। এ ফলাফল একটা দিকেই ইঙ্গিত দেয়। জোট রীতি মেনে বামেরা যেভাবে কংগ্রেসের দিকে ভোট ঘোরাতে পেরেছে, সেভাবে সচেষ্ট হয়নি কংগ্রেস। আর অনেক বাম সমর্থক স্পষ্টতই জোটে কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খুঁজতে চায়নি।

ভোটের পরে তাই দলের ভেতরেও প্রশ্ন ওঠে। একের পর এক এরিয়া কমিটি সম্মেলন, জেলা সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সাথে জোট পরিকল্পনার রাজনৈতিক অসারতার কথা উঠে আসে। উঠে আসে জনগণের স্পষ্ট রায়ের প্রসঙ্গ। উত্তরে দুটো অনচ্ছ বার্তা ভাসিয়ে দেয়া হয় মাত্র। একটা পাবলিক ফ্রিকোয়েন্সি ব্রডকাস্ট। বলা হয় তৃণমূলের স্বৈরাচার ও দুর্নীতি এবং বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সমস্ত প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলকে একজোট করতে হবে। বিজেপি কিন্তু ওই ভোটেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে নিজের ছাপ রাখল। ২০১৪ সালের ৫% ভোট দ্বিগুন হলো শুধু না, তারা তিনটে সিটও দখল করেছিল। যার পিছনে একটা কারণ সিপিআইএম এর সর্বজনদূর্বোধ্য জোটতত্ত্বকে একমাত্র এজেন্ডা করে ভোট চাওয়ায় এক অংশ ভোট শিফট করে যাওয়া।

দ্বিতীয় ব্রডকাস্টটি পার্টি ফ্রিকোয়েন্সি তে করা। জোটের মূল কারণ কংগ্রেসকে তৃণমূলের সাথে ভিড়তে না দেওয়া এবং মুসলিম ভোট, যার একটা অংশ কংগ্রেসের সাথে লেগে থাকে। বাইরন পদ্ধতি , রাজ্য কংগ্রেস বা হাইকমান্ডের একটি সিদ্ধান্তই প্রথম কারণটিকে হাপিস করে দিতে পারে। তাই এই অর্থহীন বক্তব্য নিয়ে বেশি বাগবিস্তার না করে দ্বিতীয় কারণে আসি বা সরাসরি ফলাফলে। পশ্চিমবাংলার ৬ টি জেলার ১০২ টি সিট্ মুসলিম ভোটার অধ্যুষিত। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সেখানে বামেরা হারিয়েছে ২২% ভোট। কংগ্রেস হারিয়েছে ১৩%। স্রেফ সমর্থক সাধারণ কর্মীদের তথ্যজ্ঞানের অভাবের ওপর ভরসা করেই কি এই দ্বিতীয় অচল যুক্তিটি চালানোর চেষ্টা হলো? ভোটের পর বলা হলো বাম-কংগ্রেস নির্বাচনী জোট থাকবে। ভেঙে বেরিয়ে আসার ‘কোনো কারণ ঘটেনি’ ।

একটা কথা এখানে মনে করে নেওয়া দরকার। ২০১৬ তে মমতা ও তৃণমূল কিন্তু তাদের পরিবর্তন কান্ডারি ইমেজ ধরে রাখতে পারেনি। সততার প্রতীকে যথেষ্ট কালি লেগেছিল সারদা নারদা দুর্নীতি অভিযোগে, ফুটেজে। নির্বাচনের কিছু আগেই ভেঙে পড়েছিল গিরিশ পার্কের উড়ালপুল। এতদসত্ত্বেও মানুষ কেন বিরোধী রাজনৈতিক জোটটিকে প্রত্যাখ্যান করল, তার কারণ বিশ্লেষণ করার কোনো চেষ্টা আজও হয়েছে কি?

বরং প্রতি নির্বাচনী ভরাডুবির ওপর ভর করে সিদ্ধান্তে অটল থাকার অর্থহীন অবিমৃষ্যকারিতা দেখিয়ে গেছে রাজ্য কমিটি। তাল মিলিয়েছে জেলা কমিটিগুলোও। প্যালা আর ন্যালা ফুচুদার চিরাচরিত জোটসঙ্গী, ফুচুদার অবিমৃষ্যকারিতার টানে কাদায় গড়াগড়ি খেয়েছে। চোট আঘাত কিছু বেশিই খেয়েছে বড় তরফের নিরিখে। মূল গল্পে এতকিছুর পরেও ফুচুদাদের ভাগ্যে ব্রাহ্মণ ভোজন জোটেনি। উপোসি ফেরে তিনভাই। বাস্তবেও জোটের কোনো সুফল তুলতে পারেনি বাম শরিকরা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস ছাড়া।

এই সিদ্ধান্তগত দুর্বলতার সুযোগে সিপিআইএম কে ভোট রাজনীতিতে হীনবল করে ক্রমউত্থান ঘটেছে বিজেপির। তৃণমূলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সহায়তা তো ছিলই। এছাড়াও, সিপিআইএম এর পদ্ধতি মানা নিয়মতান্ত্রিক মিটিং মিছিল এবং নির্বাচন এলেই ভিন্নমতের দলের সঙ্গ করে উঠে দাঁড়াতে চাওয়ার হীনমন্য দুর্বল আচরণের বিপ্রতীপে বিজেপির একক ঝাঁজের রাজনীতি মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে তৃণমূল বিরোধিতার বাজারে। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে বিজেপি পূর্বতন ৫% ও ১০% ছাপিয়ে অক্লেশে ৪০% ভোট ও ১৮ টা সিট্ দখল করে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটার রা সশব্দে দ্বিতীয়বার আরো স্পষ্টভাবে সিপিআইএম কংগ্রেস সুবিধাবাদী অর্থহীন জোটকে প্রত্যাখ্যান করল। সিপিআইএম লোকসভার দুটিমাত্র সিট্ হারিয়ে শূন্য। ভোট পার্সেন্টেজ নেমে ৬.৩৪। কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। মানে মানে দুখানা সিট্ আর ৪% মতো ভোট।

এর পরেই আসে বহুচর্চিত বিধানসভা নির্বাচন ২০২১। কাদা ভরা পথে আছাড় খেতে খেতে একটি ভুত ঘাড়ে বসিয়ে নারান গাঙ্গুলি কে ছাপিয়ে গিয়েছিল বাস্তবের ফুচুদা। এবার দ্বিতীয় ভুতের সন্ধান পেল সে ও পত্রপাঠ কাঁধে চাপালো। প্রগতিশীল বুর্জোয়ার সাথে এবার জুটল ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রদায় নির্ভর দল আইএসএফ। যার মাথায় বসে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। যাকে ও যার দলকে কোনো নিরিখে অসাম্প্রদায়িক বলাই যায় না, বরং সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বার্তা দিয়েই জনপ্রিয় এই পীরজাদা। এ নির্বাচনে বঙ্গের আকাশ বাতাস ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতিময়। এমন সময় কেন এই সেকুলার আইএসএফ আবিষ্কার? স্পষ্ট উত্তর নেই। সিপিআইএম সংখ্যালঘু পক্ষীয় ধর্মঘেঁষা রাজনীতি করছে, সমালোচকদের এই তীরের মুখে বুক পেতে দেয়া হলো। দুর্জনে বলে একটি ক্রাচে এগোতে পারছিল না সিপিআইএম, তাই দুটি ক্রাচ নিয়ে নির্বাচনী দৌড়ে নামল। নেমে একটি ক্রাচ আরেকটিকে ভরকেন্দ্র ছাড়তে নারাজ। ফলত নিজের ভর তথা কিছু সিট্ ছেড়ে দিয়ে অপর ক্রাচটিকে তুষ্ট করল পার্টি। হ্যাঁ, আরেকটা কাজও করেছিল। আগের ভোট গুলোতে ব্যাপক ঝাড় খেয়ে নিজেদের গণ অপ্রিয়তা প্রমান করে ফেলা পোড় খাওয়া ঘাগু নেতাদের সরিয়ে নির্বাচনী ময়দানে জায়গা করে দিয়েছিল এসএফআই ডিওয়াইএফআই-এর নেতৃত্বদের। মীনাক্ষী, প্রতিকুর, ঐশী, সায়নদীপদের। আরো একটি ইউনিক ঘটনার সাক্ষী ২০২১ এর নির্বাচন। সেই ২০১১ তে ‘কিষেন বেটা ও তার মমতা মা’ নাটকের করুণ পরিণতির পর ক্রম আবছা হয়ে পড়া আল্ট্রালেফট রা আবার নিজেদের প্রকাশিত করল। পোস্টারে। বক্তব্য – নো ভোট টু বিজেপি। এতেই নাকি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরাস্ত হবে।

ভোটের রেসাল্ট দেখে সর্বাগ্রে উল্লসিত হলো তদ্দিনে বঙ্গ রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা না পেলেও নতুন পরিচিতি পাওয়া আল্ট্রালেফটরা। জনচক্ষে তারা তখন থেকেই নো ভোট্টু বাবু। তো নো ভোট্টু বাবুরা উল্লাসে বললেন আর কিছু না হোক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরাস্ত হয়েছে। এই প্রথম মিডিয়ার ভাবনা অতিবামদের ভাবনা একজায়গায় এসে দাঁড়াল, তারাও বলল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরাস্ত হয়েছে। এবং, সর্বোপরি, সর্ব অন্তসার হারিয়ে ফেলা, বিধানসভায় শূন্য সিটের হকদার প্রাক্তন শাসক বামেরা নির্লজ্জ মুখ খুলতে সেখান থেকেও বেরোলো একই শব্দ। সঙ্গে যোগ হল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করার সুতীব্র তাগিদেই মানুষ বামেদের দিকে আর তাকাতে পারেনি।

ভোটের আগে তৃণমূল বিজেপি দুই পক্ষই প্রতিযোগিতা করে রামনবমীর মিছিল বের করা, নানা সাম্প্রদায়িক উস্কানি, পাল্টা বিবৃতি তে আকাশ বাতাস মথিত করে রেখেছিল। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি উন্নয়ন দুর্নীতি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। ভোট হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি গায়ে মেখে। ভোটের শেষে দেখা গেল হালকা সাম্প্রদায়িক শয়তান (লেসার ইভিল) তৃণমূল তার এখন অব্দি পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট শতাংশ ৪৭.৯৪% নিয়ে নিরঙ্কুশ। ঘাড়ের বেশ কাছাকাছি একটা শতাংশ নিয়ে সটান সাম্প্রদায়িক শয়তান (গ্রেটার ইভিল) বিজেপি দ্বিতীয়। প্রাপ্ত ভোট ২০১৯ এর থেকে ২% মাত্র কম, ৩৭.৯৭%। উভয়ে সাম্প্রদায়িক তাস খেলে বাংলার ৮৭% ভোট দখল করার পরেও বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরাজয় দেখেন যারা তারা রাজনীতি ছেড়ে হিমালয়ের নির্জনে গেলেই পারেন। এত চক্ষুহীন হয়ে সমাজে বাস করা কেন?

নাকি গা ও মান বাঁচাতে দেখেও না দেখা! এদিকে নিজেদের রেসাল্টের দিকে তাকানো যায়না। সিপিআইএম সব খুইয়ে ৪.৭৩% । কংগ্রেস ১২% এর উত্থান থেকে সটান নেমে ২.৯৩%। হ্যাঁ, মার্ক্সবাদী ধৌত সদ্য অসাম্প্রদায়িক আইএসএফ তার পাওয়া ১.৩৬% ভোটের কেন্দ্রীকরণের সুবিধায় জিতে নিয়েছে জোটের একটিমাত্র সিট্, ভাঙড়। জনতা ক্লান্ত হয়নি বোঝাতে বোঝাতে, ভোটের অঙ্কে এবারও সপাটে চড় জোটের গালে।

এ লেখা যখন লিখছি, তখন পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩ এর নির্বাচন শেষ। কেবলমাত্র বীরভূম জেলা বাদ দিলে জেলা পরিষদের নির্বাচনে জোটের মৃত্যু ঘটেছে। বাম-কংগ্রেস মুখোমুখি প্রার্থী দিয়ে বসে আছে। নিচে রইল ২০টি জেলার পরিসংখ্যান চার্ট।

যা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়, দুটি পার্টিই স্বীকার করে নিল যে নিচুতলা, যেখান থেকে ভোট আসবে ও একত্র হবে, সেখানে এখনো, জোটের অষ্টম বর্ষপূর্তিতেও দুটি পার্টির তালমেল, ভালোবাসা বা সহযোগিতা জন্মায়নি।

জেলাজোট হয়নি
পুরুলিয়া৯৬%
উত্তর দিনাজপুর৮৬%
পূর্ব মেদিনীপুর৮০%
পশ্চিম মেদিনীপুর৮০%
আলিপুরদুয়ার৭৮%
মালদহ৭৮%
হুগলি৭৫%
জলপাইগুড়ি৭৪%
দক্ষিণ দিনাজপুর৭১%
পূর্ব বর্ধমান৬৮%
বাঁকুড়া৬৮%
মুর্শিদাবাদ৬৭%
কোচবিহার৬২%
নদীয়া৬২%
হাওড়া৬২%
উত্তর ২৪ পরগনা৫৭%
পশ্চিম বর্ধমান৫৬%
দক্ষিণ ২৪ পরগণা৫৫%
ঝাড়গ্রাম৫৩%
বীরভূম৯%

তবু, এত মৃত্যুর পরও যখন দেখি জোট অবিনশ্বর, বেঁচে আছে, তখন এ প্রশ্ন নাছোড় চেপে ধরে, স্বস্তি দেয়না, যে পশ্চিমবঙ্গে এখনো বৃহৎ একটি সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে কেন বামেরা নিজেদের রাস্তা না বানিয়ে নিরুদ্যমী অপ্রাসঙ্গিক অনাগ্রহী কংগ্রেসকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বারান্দায় নিয়ে এসে জনতার সামনে একযোগে হাত নাড়ছে! গোটা সংগঠনটাকেই কেন কংগ্রেসের তল্পিবহনের কাজে লাগাচ্ছে ভোট এলেই? যখন ২০২১ পরবর্তী বিধানসভা উপনির্বাচনেও একাধিক সিটে প্রমান হয়ে গেছে জোট ছাড়া একক বাম মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য, তখনো! তারপরেও একি লেজুড়বৃত্তি? কেন? কেন এত অনীহা নিজস্ব ঘরানার রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে?

উত্তর স্পষ্ট নয়। আত্মবিশ্বাসের অভাব? পুরোনো স্বভাব? যা ফুটে উঠেছিল স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সিপিআই এর আচরণে? কেন এরকম? দলের নেতৃস্থানীয় উপরতলা মেজতলার অনেক নেতৃত্বই শ্রেণীগত ভাবে বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া বলে? তাই কি তারা শ্রেণী রাজনীতির চেয়ে কংগ্রেসে আস্থা রাখছে বেশি? নিশ্চিত নই। আজকে ভারতের সর্ববৃহৎ মার্কসবাদী বামদলের আচরণ দেখে মার্কসের করা একটি ক্ষেদোক্তি মনে পড়ে। ১৮৪৮ এর ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তীতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় সভার ভেতরে বাইরে আচরণ দেখে হতাশ মার্ক্স্ তার লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমেয়ারে লিখেছিলেন – সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি কে দেখে মনে হলো যেন তারা নিজেদের জয়লাভ সম্পর্কে আবার সন্দেহসৃষ্টি করে তার তাৎপর্য ভোঁতা করে ফেলার উপযুক্ত অছিলার সন্ধান করছে।

এটা ছিল স্রেফ ক্ষেদোক্তি। সিপিআইএমের আচরণ দেখে মনে হয় তারা ওই উক্তিটিকেই মার্ক্সবাদ মনে করে প্রানপন তার অনুসরণ করাকেই একমাত্র ধর্ম হিসাবে ধারণ করেছে।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস