মেরুদন্ড / Spinal Cord Theory

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস। কোন রাজনৈতিক দল নয়, আমরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ।

তাই সম্প্রতি হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজনৈতিক কচকচানির বাইরে বেরিয়ে দু-একটা কথা না বললেই নয়।

আমরা যে যত বড় গলায় চিৎকার করি না কেন, দিনের শেষে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চিন্তাভাবনা দৃষ্টিভঙ্গি সবই শহরকেন্দ্রিক। ফলে গ্রাম বাংলা বা সমাজের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, তাদের জীবন যন্ত্রনা-লড়াই নিয়ে আমরা যে দারুণ কিছু চিন্তাভাবনা করি এমনটা নয়। বরং বড় বড় রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র বা নেতাদের ট্যুইটার হ্যান্ডেল আমাদের যথেষ্ট আলোড়িত করে। হতে পারে সে মুখপাত্র জেলখাটা। হতে পারে সে নেতা ঘুষখোর তোলাবাজ বা কাটমানিখোর। প্রায় প্রতি মাসেই চুরি-চিটিংবাজির কেসে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হয়তো তাদের ডাক পড়ে। কিন্তু তাতে কি! তাদের ট্যুইট বা অ-কথা কু-কথাই আপাতত আমাদের রাজনৈতিক আলোচনার উপজীব্য। চ্যানেলে চ্যানেলে সন্ধ্যে হতে না হতেই প্রাইম টাইমে শুরু হয়ে যায় সেসব লঘু রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা। যদিও আমরা আম জনতা সাতে পাঁচে না থেকে গ্যাঁট হয়ে ‘ছয়’তে বসে এসব দেখেই যে মজা পাই, এটা অস্বীকার করবার জায়গা নেই। কাজেই একতরফা বাজারি মিডিয়াকে গাল দিয়ে লাভ নেই।

শহরের বুকে কোন প্রতিবাদী মিছিল-মিটিং হলে আমাদের বেশিরভাগ মানুষ হাঁটি তো নাই, কারণ পাছে কেউ পার্টি-পলিটিক্স করা মিটিংবাজ বলে দাগিয়ে দেয়! কিন্তু টিভিতে মিছিলের বহর দেখে মাথা গুনে কেমন ভিড় হয়েছিল বোঝবার চেষ্টা অবশ্যই করি! আর যেটা করি সেটা হলো কিছু পরিচিত বিশিষ্ট ‘মুখ’ খুঁজি। অমুক বুদ্ধিজীবী কেন মিছিলে এলো না, তমুক শিল্পী কেন প্রতিবাদী গান লিখছে না, কার কার শিরদাঁড়া নেই ইত্যাদি আলোচনায় মত্ত হয়ে পড়ি। যদিও আমি বা আমরা কেন গেলাম না সেইসব মিটিং মিছিলে ভাবি না। আমাদের শিরদাঁড়াটা ঠিকঠাক আছে কি না বা থাকলেও তা কতখানি পোক্ত ভেবে দেখবার চেষ্টা করি না।

কিন্তু এভাবে কি আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায়! পঞ্চায়েত ভোট ও তার ফলাফল সেই ‘সারসত্য’টাই তুলে এনেছে। কিন্তু কিভাবে?

একটু চোখ তুলে তাকালেই দেখতে পাবেন।

২০২১ এর বিধানসভা ভোটের পরবর্তী সময় যতগুলি শহরকেন্দ্রিক বা শহরতলী এলাকায় বিধানসভা উপনির্বাচন হয়েছে অথবা রাজ্য জুড়ে যে একশোর বেশি পুর এলাকায় যে মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচন হয়েছে তার সবকটিতে রাজ্যের শাসক দল কমবেশি ৭০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। সে সব ভোটগুলোতে যে শাসকদলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা দেদার ছাপ্পা ভোট দিয়েছে, ভোট লুঠ করেছে তা আমরা সবাই জানি। আমরা ঘরে বসে সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখা তথাকথিত শহুরে শিক্ষিত লোকগুলো যে এসব আটকাতে পারি নি, সেভাবে রাস্তায় নেমে শিরদাঁড়া সোজা করে ভোট লুটেরাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারিনি তাও কারো অস্বীকার করবার জায়গা নেই। আর তারই ফলশ্রুতি শাসকের এক তরফা ৭০% ভোট প্রাপ্তি!

এবার আসা যাক সম্প্রতি হয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার পঞ্চায়েত ভোটে। এখানেও এক তরফা ভোট লুঠ, ছাপ্পাভোট, এমনকি ভোট গণনায় ব্যাপক কারচুপি, মরিয়া শাসক কিছুই বাদ রাখেনি। কিন্তু এতকিছু করেও তারা ভোট পেয়েছে ৫২%। গত দুবছরে শহরাঞ্চলের নির্বাচনগুলোতে শাসকের প্রাপ্ত ভোটের থেকে যা প্রায় ১৮% কম।

অর্থ্যাৎ ইঙ্গিতটা স্পষ্ট! গ্রাম বাংলার তথাকথিত ‘অল্পশিক্ষিত’ প্রান্তিক মানুষগুলো লক্ষীর ভাণ্ডারের জন্য লাইন যেমন দেয় তেমনই সীমিত ক্ষমতা নিয়েই শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তেও জানে। এদের শিরদাঁড়াটা আদৌ ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়নি। কাজেই এইধরনের সবজান্তা মন্তব্য যখন সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়, চালাচালি হয় তখন আমাদের খারাপ লাগে। বরঞ্চ আমরা শহুরে শিক্ষিত লোকজন অনেকেই ভোটের দিন বুথে বুথে শাসকমদতপুষ্ট সমাজবিরোধীদের দাপট দেখে আর ঝুট-ঝামেলায় জড়াতে চাই না। চুপচাপ যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়ে দরজায় খিল দিয়ে দি। আমাদের ভোট, আমাদের পরলোকগত মা-বাবার ভোট ভূতে দিয়ে যায়, মুখবুজে মেনেনি। নিজেদের মেরুদন্ড বেঁকিয়ে ফেলতে আমাদের ৫০০ টাকাও লাগে না!
কাজেই শিক্ষিত শহুরে মানুষদের কে আমাদের অনুরোধ শিরদাঁড়ার খোঁজে বাছাই করা শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে না থেকে নিজের নিজের পিঠে হাত দিয়ে দেখুন! সবকিছু আছে তো ঠিকঠাক!

আমাদের রাজ্যের আগামী যে কোন শহুরে নির্বাচন ও তার ফলাফল কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত শহরবাসীর মেরুদন্ড আছে না নেই, তারই লিটমাস টেস্ট।

কাজেই…. ভাবুন। ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস