আমরা মণিপুর থেকে ৭৭ দিন দূরে / The Manipur Files

মে মাস থেকে মণিপুর জাতি দাঙ্গায় জ্বলছে। হিন্দু গরিষ্ঠ মৈতেই ও খ্রীষ্টান গরিষ্ঠ কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলছে এই জাতি দাঙ্গা। যে সমস্ত ছবি এদ্দিন ধরে সামনে এসেছে, দেখলে মনে হবে গৃহযুদ্ধ চলছে। এর মূলে যে জাতপাতের রাজনীতি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই মুহুর্তে মণিপুরে শাসন ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর নাম এন বীরেন সিং। ইনি হলেন মৈতেই গোষ্ঠীর নেতা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো কোন জাত বা গোষ্ঠীর হয় না। মুখ্যমন্ত্রী তিনি সমগ্র রাজ্যের। কিন্তু গতকাল ১৯ শে জুলাই যে নক্কারজনক নারী নিগ্রহের ছবি সমাজমাধ্যমে সামনে এসেছে তারপর তিনি গোষ্ঠীপতি থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে আদৌ পেরেছেন কি না, সেই প্রশ্নটাই সোচ্চারে তুলে দিয়েছে।

ঘটনাটি ৪ ঠা মে’র। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে কাংপোকপি জেলার ঘটনা এটি। ঘটনার সূত্রপাত যদিও ৩রা মে রাতে যখন এখানকার কুকি অধ্যুষিত বি ফাইনোম গ্রামে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হাজার খানেক মৈতেই যুবক হামলা চালায়। গ্রামে ঢুকে তারা এলোপাথারি গুলি চালাতে থাকে। বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্রামবাসীরা প্রাণ হাতে ভয়ে যে যে দিকে পারে পালাতে থাকে। এদেরই মধ্যে দুই পরিবারের ৫ জন ( তিন মহিলা সহ) নিকটবর্তী জঙ্গলে ঢুকে পড়েন। সেই দলে ৫২ বছরের প্রৌঢ় বাবা, ১৯ বছরের জোয়ান ভাই এবং তার ২১ বছরের যুবতী দিদি যেমন ছিল তেমনই ছিলেন, তাদেরই প্রতিবেশী আরেক পরিবারের ৫২ ও ৪২ বছর বয়সী দুই মহিলা। এরা প্রত্যেকেই কুকি জনগোষ্ঠীর। সারারাত তাদের জঙ্গলে কাটে। পরদিন, অর্থ্যাৎ ৪ঠা মে তাদেরকে পুলিশ উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু পথে সাইকুল থানার কাছে সশস্ত্র মৈতেই গোষ্ঠীর উন্মত্ত জনতা পুলিশের গাড়ি ঘিরে ধরে। ঐ উদ্ধার হওয়া কুকি জনগোষ্ঠীর পাঁচজনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে বলে দাবী জানাতে থাকে। এমতাবস্থায় পুলিশ নিজে সেই উন্মত্ত জনতার হাতে তিন মহিলা সহ ৫ কুকি’কে তুলে দিয়ে চলে আসে।

আর তারপরই শুরু হয় মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতন। বাধা দিতে গেলে প্রৌঢ় বাপ ও জোয়ান ভাইকে কুপিয়ে খুন করা হয়। এরপর তিন মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বি ফাইনোম গ্রামে। সেখানে ৫২ বছর বয়সী প্রৌঢ়া মহিলাটি কয়েকজনের হাতে পায়ে ধরে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পালিয়ে আসেন নিকটবর্তী সাইকুল থানায়। অভিযোগ জানাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ তাঁর অভিযোগে কোন কর্ণপাত করে না। এদিকে উন্মত্ত জনতা বাকি দুই মহিলাকে নগ্ন অবস্থায় হাঁটিয়ে নিয়ে আসে একটা ক্ষেতের মধ্যে। সেখানে তাদেরকে দলবেঁধে গণধর্ষণ করা হয়। এই বাকি দুই মহিলার নগ্ন হাঁটার ভিডিওটিই গতকাল ভাইরাল হয়েছে। উন্মত্ত মৈতেই জনতা এই দুই কুকি মহিলার নগ্ন শরীরের যত্রতত্র এমনকি গোপনাঙ্গে পর্যন্ত হাত চালাচ্ছে বলে ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে। এমন লজ্জাজনক ভিডিও দেখে তাজ্জব দেশবাসী। লজ্জায় ঘেন্নায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে সবার। শিউরে উঠেছি আমরা সবাই। এ কোন ভারতবর্ষ! এ কোন মানব সভ্যতা! ছিঃ!

এই সীমাহীন লজ্জার মধ্যে দাঁড়িয়েও আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস একটা প্রশ্ন করতে চাই। দেখুন তো আপনাদের মনেও খটকা লাগছে কি না!

৪ ঠা মে ঘটনা ঘটলো। অথচ দেশবাসীর তা জানতে আড়াই মাস লেগে গেলো! কেন?

তাও দেশবাসী জানলো সমাজমাধ্যম দেখে, কোন খবরের কাগজ পড়ে বা টিভির খবর দেখে নয়! কেন এই অবস্থা?

দেশের সংবাদমাধ্যম, নামজাদা সব সাংবাদিককূল এদ্দিন ধরে কি করছিল? কেন তারা জানাতে পারলেন না, দেশের মধ্যে ঘটা এমন একটি নক্কারজনক নারী নিগ্রহরে ঘটনার কথা? কি এমন বাধ্যবাধকতা!

এভাবে দেশের খবর জানবার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ মানুষ পিছিয়ে থাকতে চাই না।

আমরা দেশবাসী এবার সংবাদমাধ্যমের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে চাই, ৪ঠা মে থেকে ১৯ শে জুলাই, এই ৭৭ দিন ধরে আপনারা সংবাদমাধ্যম কোন ভ্যারান্ডা ভাজছিলেন!

খবরের নামে প্রতি সন্ধ্যেবেলা ঘন্টাখানেক ধরে চ্যানেলে চ্যানেলে ঝগড়াঝাঁটি নয়, খবর চাই আমরা। রাজ্যের খবর, দেশ-দুনিয়ার খবর।

জনমানসে অবশ্য একটা অন্য ভাবনার কথাও ঘুরপাক খাচ্ছে। সব জেনেশুনেও শাসকের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেই আপনারা মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘটা মণিপুরের নারী নির্যাতনের কথা ধামাচাপা দিয়েছিলেন। কারণ সামনে তখন কর্ণাটক বিধানসভার ভোট। আর আমরা রাইজ অফ ভয়েসেসও সেই ধারণার সাথে কিছুটা হলেও সহমত পোষণ করি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কভারেজ করতে যাঁরা বিদেশ পাড়ি দিতে পারেন, সেই তাঁরা মণিপুরের জাতিদাঙ্গা-গৃহযুদ্ধ পরিস্থতির খবর রাখেন না, বা পান না এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য! এমনি এমনি কি আর বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৬১ তে! এভাবে চললে কিন্তু ১৮০ পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না!

কাজেই, খবরের নামে শাসকের সুবিধে করে দিতে ‘গলাবাজি’ বা ‘প্রোপাগান্ডা’ অনেক হয়েছে, আর না। শাসকের সারমেয় বৃত্তি ছাড়ুন। সাংবাদিকতা শুরু করুন।

আপনাদের জন্য আমরা ভারতবাসী মণিপুর থেকে ৭৭ দিন দূরে চলে গেছি। এজন্য মণিপুরের প্রতিটি নারী পুরুষের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু সাংবাদিকের মুখোশ পরা শাসকের পোষ্য সারমেয়গুলোকে আমরা ক্ষমা করছি না। আপনারা ক্ষমার অযোগ্য।

আর সবশেষে শাসকের কান্ড কারখানা দেখে বলিহারি যাই!

যে সমাজমাধ্যম দেশবাসীকে মণিপুরের এমন ন্যক্করজনক নারী নিগ্রহের কথা জানালো, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীও সমাজমাধ্যমের দৌলতেই এই ঘটনার কথা জানতে পেরে মুখ খুললেন, সেই সমাজমাধ্যমটিকে আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়তে পারে এই ছুতোয় সরকার শাসাচ্ছে মণিপুরের নারী নিগ্রহের যাবতীয় ভিডিও সমস্ত ট্যুইটার হ্যান্ডেলের টাইম লাইন থেকে মুছে নেওয়ার জন্য! অথচ মে মাসে মণিপুর যখন জাতি দাঙ্গায় জ্বলছিল বলে সামান্য কিছু সংবাদমাধ্যমে বিক্ষিপ্তভাবে খবর আসছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন সেসব পাত্তা না দিয়েই কর্নাটকে ভোট কুড়োতে জাত-ধর্মের তাস খেলতে ব্যস্ত ছিলেন।

তাই এই শাসককেও ধিক্কার!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

সংবাদসূত্রঃ-
a) https://www.anandabazar.com/india/centre-may-act-against-twitter-over-a-controversial-video-of-manipur-dgtl/cid/1446222
b) https://www.anandabazar.com/india/sc-directs-centre-and-manipur-government-to-take-immediate-steps-and-apprise-it-on-what-action-has-been-taken-on-assault-of-two-women-dgtl/cid/1446229
c) https://www.thequint.com/news/india/accused-arrests-in-manipur-viral-video-of-parading-naked-kuki-women#read-more
d) https://www.thehindu.com/news/national/india-slips-in-world-press-freedom-index-ranks-161-out-of-180-countries/article66806608.ece
e) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-07-20/202307192359362.jpg&category=0&date=2023-07-20&button=
f) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-07-20/202307200002501.jpg&category=0&date=2023-07-20&button=