“বুলডোজার জাস্টিস”- মন ভোলানো ঘুম পাড়ানো মহৌষধ / The Democritator

আমরা আম জনতা আইন-বিচারব্যবস্থায় ভরসা করতে ভালোবাসি। আইন আইনের পথে চলবে, কথাটা তো আর এমনি এমনি আসেনি।

কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক আইনের তো আর হাত-পা নেই যে হেঁটে চলে বেড়াবে। তাদেরকে চালাতে হয়। আর সেই চালাবার জন্য জনতা ভরসা করে নির্বাচিত সরকারকে। সেই সরকারের নেতা-মন্ত্রী-অফিসার-করণিকদের। আর সেখানেই গন্ডগোল। কেন বলছি এই কথা! কারণ ইদানীং খবরের কাগজ অথবা নিউজ চ্যানেলে আইন-আদালত সংক্রান্ত খবরের বাড়-বাড়ন্তটা চোখে লাগে, যা আগে ছিল না। জানবেন মানুষ যখন সরকারের থেকে স্বাভাবিক নিয়মে আইনের সুবিচার পায় না, তখনই উকিল ভাড়া করে আদালতে ছোটে। মানে খুব স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, এখন আমাদের দেশে বা রাজ্যে স্বাভাবিক নিয়মে আম জনতা আর সুবিচার পাচ্ছে না। সরকারের নেতা-মন্ত্রী-অফিসারেরা সমবেতভাবে পেতে দিচ্ছে না। ফলে মানুষকে বারবার আদালতের দরজায় কড়া নাড়তে হচ্ছে। আর তাই খবরের পাতা জুড়ে টিভির পর্দা জুড়ে খালি কোর্ট-কাছারির খবর।

আপনি কি ভেবেছিলেন, আপনার ভোটে নির্বাচিত সাংসদ-বিধায়করা, যারা সরকারের অংশ, তারা যে সমস্ত চিটফান্ড সংস্থার সাথে গা ঘষাঘষি করছে, সেগুলো আসলে ‘চিট’ বা প্রতারক! আপনি কি ভেবেছিলেন সরকারের নেতা-মন্ত্রী-অফিসারদের প্রত্যক্ষ মদতে বাজারের আলু-পটলের মত সরকারি চাকরি দেদার বিক্রি হবে! আপনি কি জানতেন বাংলা জুড়ে চলা কয়লা-গরু-বালি পাচারের এমন বিপুল সম্ভাবনাময় দিকটার কথা! আপনি কি ভেবেছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন বিডিও-এসডিওদের প্রত্যক্ষ মদতে বা তাদের নাকের ডগায় এরকম বেনজির ‘গণনা লুঠ’ হবে যার জন্য আজও নদী-নালা-পুকুর ডোবায় অথবা বন জঙ্গলে গুচ্ছ গুচ্ছ ছাপ মারা ব্যালট উদ্ধার হচ্ছে! আপনি কি আশা করেছিলেন, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের সাজা মুকব করে দিয়ে সরকার তাদেরকে জেল থেকে ছেড়ে দেবে! আপনি কি জানতেন, আমার আপনার ভোটে নির্বাচিত সাংসদ-বিধায়করা গরু-ছাগলের মত বিক্রি হবেন ও দল বদলাবেন, সরকার গড়বেন ও ফেলবেন! আপনি কি জানতেন দুর্নীতি থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো সরকারে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেওয়া! কিন্তু যখন এতকিছু জানলেন ও দেখলেন এবং সেইসঙ্গে এটাও বুঝলেন যে স্বয়ং সরকার বাহাদুর ও তার প্রশাসনই আপনাকে এসমস্ত অনাচার থেকে আইনি পথে সুবিচার দিতে চায় না, তখন স্বাভাবিক ভাবেই আপনাকে আদালতের দারস্থ হতে হলো।

কাজেই এই যে আপনার আমার স্বাভাবিক নিয়মে সুবিচার পাওয়ার ভরসাটা প্রতি নিয়ত বুলডোজড হচ্ছে, তারই ফলশ্রুতিতে এই আদালতে ছোটাছুটি, আইনজীবীদের শরণাপন্ন হওয়া। আর তাই এই যে কপিল সিব্বাল, অভিষেক মনু সিংভি, মুকুল রোহতাগি, বিকাশ ভট্টাচার্য্য অথবা হরিশ সালভের মত দুঁদে আইনজীবীরা আমজনতার ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়লেন, আমাদের অতি পরিচিত নাম হয়ে উঠলেন তা মোটেই খুব একটা ভালো সঙ্কেত দিচ্ছে না। আজকাল তো স্বয়ং নির্বাচিত সরকার নিজে দুর্নীতির তদন্ত আটকাতে আম জনতার ট্যাক্সের টাকা খরচা করে এই সমস্ত দুঁদে আইনজীবীদের নিয়োগ করছে!

তা যাইহোক, এই যখন আম জনতার অবস্থা, তার আইনের শাসনের ভরসার স্থলটা যখন টলমল বা বুলডোজড, তখন সেই ক্ষতে মলম লাগাতে বাজারে এসেছে বুলডোজার জাস্টিস।

এটা ঠিক কি রকম! কোন অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক কিছু প্রমাণ পেলেই তার বাড়িঘর-কাজের জায়গা-ব্যবসাপত্তর বা দোকানপাট যা আছে সব সরকারের তরফে বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে! হ্যাঁ, আদালতে দোষী প্রমাণ হওয়ার আগেই। মানে সোজাকথা হাতেগরম বিচার! কিন্তু আপনি যদি একটু খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই বুলডোজার চলে মূলতঃ সমাজের প্রান্তিক গরীব মানুষদের ঘরবাড়িতে। সরকারের দাবী এরা সরকারের জমি জবর দখল করে ঘরবাড়ি বানিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার ঘর-বাড়ি দোকানপাটের অবৈধ অংশটুকুই শুধু ভাঙা হয়। মানে যা করা হয় যতটা সম্ভব আইন বাঁচিয়ে করা হয়। এর সাথে ঐ সংশ্লিষ্ট অপরাধীর করা অপরাধের খাতায় কলমে সরাসরি কোন সংযোগ নেই। অথচ খবরের কাগজে অথবা নিউজ চ্যানেলে প্রোপাগান্ডা চলে সরকার আম-জনতাকে হাতেগরম বিচার পাইয়ে দিলো! দুষ্টের দমনে সরকার বাহাদুর কাউকে রেয়াত করে না এমনই একটা ভাবমূর্তি বানাবার নিরন্তর সুপ্ত চেষ্টা চালানো হয়! কিন্তু সত্যি কি তাই? এই যে এত রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে গাদা-গাদা দুর্নীতি-স্বজনপোষণের অভিযোগ ও প্রমাণ, তাদের ঘর বাড়িতে বুলডোজার চলে না কেন? এই যে সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে বরণ করা হলো তারই বা কি হবে? এই যে দলবদলু বিশ্বাসঘাতক জনপ্রতিনিধিরা আমার আপনার মতামতের তোয়াক্কা না করেই দুর্নীতির আঁচ থেকে বাঁচতে অথবা ক্ষমতার ক্ষীর খেতে এক দল থেকে জিতে অন্যদলে চলে যাচ্ছেন তাদেরকে ধরবে কে? এদের ঘরবাড়িতে কি বুলডোজার যাবে?

উত্তর স্পষ্ট।

“না।“

কেন “না”, বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রতিবেদনের শুরুতে। আইনের মত বুলডোজারেরও নিজের কোন হাত পা নেই। তাকে চালায় সরকার -পুলিশ-প্রশাসন। মানে আইন আইনের পথে চলবে বলে যারা বেআইনি কাজকর্ম করে বেড়ায় তাদের হাতেই তো বুলডোজারের স্টিয়ারিং! কাজেই তার কাছে ন্যয়-বিচারের আশা করাটা বোকামি!

বুলডোজার আসলে ‘অলরেডি বুলডোজড’ আম জনতার মন ভুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবার একটা অপচেষ্টা মাত্র।

এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি সুপ্রিম কোর্টের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এই বুলডোজার চালানোর ওপর। এভাবে বুলডোজার চালানো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস