“পুকুরে” (পলি)ট্রিক্স / River Vs. Pond

দিনটা ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছিলেন, তৃণমূলের সন্ত্রাস কায়েমী স্বার্থে হচ্ছে এবং মমতা বন্দোপাধ্যায় এই বিষয়ে জানেন কিনা তাই নিয়ে তিনি সন্দিহান। তারপর ভাগীরথী দিয়ে যেমন অনেক জল গড়িয়েছে, তেমন ভাবেই সম্প্রতি হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে অধীরবাবুর নিজের জেলা মুর্শিদাবাদেও গড়িয়েছে বহু কংগ্রেস কর্মীর রক্ত।

দিন কয়েক আগে এক হিন্দী বেসরকারি চ্যানেলের টক শো’তে অধীর বাবুকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তিনি অতি সতর্কতার বোঝালেন, নদী আর পুকুরের পার্থক্য। যার ফলে বাংলার কংগ্রেস কর্মী সমর্থকদের মনে তৈরি হয়েছে প্রবল বিভ্রান্তি! বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃনমূলের বিরূদ্ধে বামের সাথে হাত মিলিয়ে প্রবল লড়াই করলেও বাংলার কংগ্রেস কর্মীর কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, আগামী লোকসভা নির্বাচনে তাঁরা পুকুরে সাঁতার কাটবেন নাকি নদীতে? অনেকের আবার আশঙ্কা অধীর বাবুর পরিণতি বায়রনের মত না হয়ে যায়! কারণ তীব্র সন্ত্রাসের মধ্যেও বহরমপুর কেন্দ্রে সিপিআইএম, বিজেপির ভোট বাড়লেও, কংগ্রেসের ৩ লক্ষের বেশি ভোট কমেছে। তার ওপর লোকসভার বিরোধী দলনেতা হলেও, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাত্তা পাওয়ার ব্যাপারে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব অনেকটাই পিছিয়ে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অধীরের থেকেও অনেক বেশি পাত্তা পান প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রী এবং বর্তমান তৃণমুল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই পুকুর না নদী, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সেই তত্ত্বই হয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ন।

যেমন কয়েকদিন আগে, “ইন্ডিয়া” জোটে থাকা বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা অধীর বাবুর নেতৃত্বে গিয়েছিলেন মনিপুর। বেশ। কিন্তু, আপনারা কি জানেন, অধীরবাবু মণিপুর যাত্রার বিমানে বসেছিলেন তৃণমূল নেত্রী সুস্মিতা দেবের পাশে, যিনি কয়েক বছর আগে কংগ্রেসটাই করতেন।

একথা সকলেরই জানা, তৃণমুল সরকার এবং তাদের নেতাদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে হয়ে মামলা লড়ছেন কংগ্রেস সাংসদ অভিষেক মনু সিংভি, চিদাম্বরম ও প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল। আর কৌস্তভ বাগচীর মত কিছু তরুণ প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের সামনেই কেন্দ্রীয় নেতার উদ্দেশে উগরে দিচ্ছেন ক্ষোভ। এসব দেখে প্রদেশ কংগ্রেস কর্মীরা ঘেঁটে ঘ।

বছরের পর বছর কংগ্রেস দলকে ভেঙে গোটা বাংলা দখল করার পরে, নীচু তলার কংগ্রেস কর্মীদেরকে মুড়ি মুড়কির মত নানান কেসে ফাঁসানোর পরেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সাগরদিঘী হারিয়ে নদী প্রেম দেখে কংগ্রেস কর্মীদের আশ্চর্য হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় আছে কিনা, তা এই মুহূর্তে সত্যিই বোঝা মুশকিল। আর এরই নির্বাচনী ফায়দা তুলতে মরিয়া রাজ্যের শাসক তৃনমূল কংগ্রেস এবং দেশের শাসক বিজেপি।

অসমর্থিত সূত্রের খবর যা পাওয়া যাচ্ছে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তৃণমুল কংগ্রেস ৩৯টি এবং কংগ্রেস তিনটি আসনের লড়াই করতে চলেছে। তৃণমূলের পক্ষে কংগ্রেসকে যে তিনটে সিট ছাড়া হতে পারে খবর, সেগুলো হল, বহরমপুর , রায়গঞ্জ আর মালদা দক্ষিণ। এমনটা হলে বামেদের ৪২ আসনে একা লড়াই করা ছাড়া উপায় নেই এবং যার ফলে বামেদের ভোট শতাংশ বাড়লেও আসন পাওয়ার লড়াইতে তারা অনেকখানি পিছিয়ে যাবে। এদিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ৪২ আসনেই। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় ১৬% সমর্থন হারালেও আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদলের তকমাটা টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে খানিকটা সহজ হবে।

যদিও বাংলায় বিজেপি’র ফল নির্ভর করবে, মূলত তিন রকমের সমীকরণের ওপর।

সমীকরণ এক। কংগ্রেস এবং বামেরা একসাথে তৃনমূলের সাথে একটিও আসনে সমঝোতায় গেলে, সবচেয়ে বেশি লাভের গুড় তুলতে পারে বিজেপি এবং অল্প কিছুটা তৃনমূল। সেক্ষেত্রে বাংলা থেকে সম্পূর্ন মুছে যেতে পারে বাম কংগ্রেস।

সমীকরন দুই। তৃনমূল কংগ্রেস যদি কোনো কারনে ইণ্ডিয়া জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বাম কংগ্রেসের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। সাথে সামান্য লাভবান হতে পারে বিজেপিও! তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে তৃনমূল কংগ্রেসের। সেই ভোটের একটা বড় অংশ চলে যেতে বাম কংগ্রেসের ঝুলিতে।

সমীকরণ তিন। ধরা যাক, কংগ্রেসের সাথে তৃণমুলের জোট হল, আর বামেরা একা লড়াই করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ৪২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দিল। সেক্ষেত্রে মুহূর্তের মধ্যে অভিযোগ উঠবে, বিরোধী ভোট ভাগ করে বিজেপির সুবিধে করে দেওয়ার। তবে তাতে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বামেরা বেকায়দায় পড়তে পারে। তবে এই সমীকরনে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট সামনে আসতে পারে। যেমন কংগ্রেসের মুসলিম ভোট ব্যাংকের ওপরে সম্বল করে তৃনমূল নিজেকে বিজেপি বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, হারিয়ে যাওয়া সংখ্যালঘু ভোট ফেরানোর চেষ্টা করতে পারে। এমনটা হলে যেটা হবে, সেটা হলো বামেদের “ইণ্ডিয়া জোট” বিরোধী দেখিয়ে আরও একবার বিরাট পরিমাণে রাম-বাম প্রচার করা হবে। আর অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বামেদের ফল খারাপ হলে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের তেমন কোন সমস্যা নেই। এমনকি রাজ্য কংগ্রেস উঠে গেলেও হাইকম্যান্ডের তেমন কোন হেলদোল হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আর সেই সুযোগে বামেদের ভোট ব্যাঙ্কের দখল নেবে বিজেপি। কিন্তু এরপরেও একটা যদি আছে। লোকসভা নির্বাচন আসতে আসতে পশ্চিমবঙ্গের নানান কেলেঙ্কারিতে তৃনমূল কংগ্রেসের অতি প্রভাবশালী নেতারা ধরা না পড়লে অথবা জেলবন্দী প্রভাবশালীরা জামিন পেয়ে গেলে, কিন্তু এই রাজ্যে বিজেপির সম্ভাবনা প্রায় শেষ। কারণ বামেরা সেক্ষেত্রে সেটিং প্রচারকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে এবং তাতে তাদের হৃত গৌরব কিছুটা হলেও ফিরতে পারে। জুটতে পারে কিছু আসনও।

কাজেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কি হতে চলেছে এই বাংলায়, তা এই মুহূর্তে বলা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এই ভোট তৃনমূল, বিজেপি, বাম এবং কংগ্রেসের কাছে যে এক্কেরে শাঁখের করাত, তা বুঝতে খুব বেশি রাজনৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। নাউ, ওয়েট অ্যান্ড ফিল দ্যা ওয়েভ।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস